সাহিত্য চলচ্চিত্রে অনূদিত নয়, রূপান্তরিত হয়: গৌতম ঘোষ

চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশে প্রযুক্তি আধিপত্য বিস্তার করছে বলে মনে করেন প্রখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ।

জয়ন্ত সাহাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Jan 2018, 06:39 AM
Updated : 15 Jan 2018, 07:07 AM

তার মতে, প্রযুক্তির বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় সিনেমার ভাষা ও নির্মাণশৈলী। আর সাহিত্য নির্ভরতা থেকে ক্রমেই বের হয়ে এসে স্বাধীন শিল্পমাধ্যম হয়ে উঠছে চলচ্চিত্র।

ঢাকায় ‘আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন’ এ যোগ দিতে এসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় সাহিত্যের সঙ্গে চলচ্চিত্রের সংযোগের বিভিন্ন দিকে নিয়ে কথা বলেন ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ খ্যাত পরিচালক গৌতম।

রোববার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি নিজের চলচ্চিত্র ভাবনার সঙ্গে বাংলাদেশের তরুণদের নিয়ে তার উচ্ছ্বাসের কথাও শোনালেন।

চলচ্চিত্রে প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে বলতে গিয়ে গৌতম ঘোষ বলেন, “চলচ্চিত্র একেবারে এক প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প। প্রযুক্তি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্রের ভাষা, নির্মাণ কৌশল সব পাল্টে যায়। যেমনটা নির্বাক থেকে সবাক হয়েছিল চলচ্চিত্র, ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট থেকে কালার হয়েছিল, এনালগ থেকে ডিজিটাল হয়েছে। প্রযুক্তির বদলের সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে চলচ্চিত্রের অভিব্যক্তি বদলে যাচ্ছে।“

সাহিত্যের সঙ্গে চলচ্চিত্রের সংযোগের বিচারে তিনি বলেন, এখন চলচ্চিত্রকে ক্রমেই এক স্বাধীন শিল্পমাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে দেখছেন তিনি।

“সাহিত্য নির্ভরতা থেকে ক্রমেই বেরিয়ে আসছে শিল্প। প্রযুক্তির প্রভাবে এমন এক দিন আসছে, যেদিন সাহিত্যের ধারেকাছে আসবে না সিনেমা। এক স্বাধীন শিল্পমাধ্যম হিসেবে সে আত্মপ্রকাশ করবে।”

চলচ্চিত্র ও সাহিত্যের চিত্রকল্প রচনা করতে গিয়ে নানা তফাৎ খুঁজে পেলেও গৌতম দৃঢ় কণ্ঠে বলছেন, সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের মধ্যে আসলে কোনো বিরোধ নেই।

সাহিত্যের নানা উপাদানকে নিয়ে চলচ্চিত্র বিভিন্ন সময়ে ঋদ্ধ হয়েছে মন্তব্য করে সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রেরও প্রশংসা করেন তিনি।

সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে গৌতম বলেন, “চলচ্চিত্রে প্রকৃতির রূপ, মানুষের অভিব্যক্তি যেভাবে দেখানো যাবে, সাহিত্যে সেটা সম্ভব না। চলচ্চিত্র খেলে সময় ও গতি নিয়ে, সাহিত্য তা করে না। সাহিত্য পাঠের সময় শব্দ, বাক্য সমন্বয়ে নানা চিত্রকল্প রচিত হয়। কিন্তু সিনেমাতে সেটা ভিন্ন ব্যাপার। সবাই কিন্তু একইসময়ে একই জিনিস দেখছে। পরে দর্শক নিজের মতো করে তা ভাবতে বসে।

“সাহিত্য আর চলচ্চিত্রের মধ্যে তফাৎ থাকলেও তাদের মধ্যে আসলে কোনো বিরোধ নেই। এখন কথা হল, আমরা কিভাবে এ দুটো ব্যাপারকে দেখছি।”

বাংলাদেশ ও ভারত- দুই দেশেই শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার জিতে নেওয়া গৌতম ঘোষ বলেন, “চলচ্চিত্রে সাহিত্য কখনো অনূদিত হয় না, রূপান্তরিত হয়। সবচেয়ে ভালো হয়, সাহিত্যিকের যে অভিজ্ঞতা তার অনুভূতির সঙ্গে পরিচালকের অভিজ্ঞতা মিশে যায়। তখন সেটা হয় মণিকাঞ্চনযোগ।”

পৃথিবীর খ্যাতনামা চলচ্চিত্রকাররা সাহিত্যনির্ভর সিনেমা নির্মাণ করতে গিয়ে কখনো সফল হয়েছেন, কখনো সাহিত্যের অনুগামী না হয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। সময়-কাল বিবেচনায় পরিচালকরা উপন্যাস বা কথাসাহিত্যে নানা পরিবর্তন এনে তবেই চিত্রনাট্য তৈরি করেন।

‘পদ্মানদীর মাঝি’ সিনেমাটি নির্মাণের সময় বাংলাদেশের একদল শিক্ষার্থীর নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়েছে বলে জানান তিনি।

“পাঠ্যপুস্তকে পাঠ্য ছিল মানিক বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাসটি। ছেলেমেয়েরা একাধিকবার পড়েছে, তারপর তারা চলচ্চিত্রটি দেখেছে। সিনেমাটি দেখার পর, তারা আমাকে প্রচুর চিঠি লিখল। তাদের অভিযোগ, অনুযোগের বিষয় হল, কেন আমি নানা জায়গায় পরিবর্তন এনেছি। কখনো ভাবি, কে বড়? সাহিত্যিক না চলচ্চিত্রকার? আসলে এ ব্যাপারটি একান্তই শিল্পের। শিল্পের জায়গা থেকে চলচ্চিত্রটি কতটা উত্তীর্ণ হল, সেটাই বিবেচ্য বিষয়। অবশ্য বেশকটা অসাহিত্য নিয়ে বাজে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।”

চলচ্চিত্রের কথা ভেবে সাহিত্যকর্ম রচনা হলে তাতে ‘দোষের কিছু‘ খুঁজে পান না গৌতম ঘোষ।

তিনি বলেন, “চলচ্চিত্রের জন্য রচিত সাহিত্যে চিত্রকল্প খুঁজতে হবে। এমন একটি চিত্রকল্প রচিত হতে হবে, যার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে সিনেমায়। নৌকার গলুইয়ে বসে মানুষের দুটি চোখ, সে চোখ পুরো ঘটনার সাক্ষী-আঁকতে হবে এমন চিত্রকল্প।”

প্রযুক্তি-নির্ভর চলচ্চিত্র নিয়েই শেষ কথাটি বলেন তিনি। ডিজিটাল প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতারা চলচ্চিত্রের নতুন ভাষা খোঁজায় ব্রতী হওয়ায় তাদের নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন তিনি। 

কখনো মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, কখনো সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’, কখনো আবার কুমার মজুমদারের ‘মহাযাত্রা; আবার কখনো সায়ন্তনী পুততুণ্ডুর দেশভাগ নিয়ে লেখা উপন্যাস, সমরেশ বসুর সামাজিক উপন্যাসগুলোকে নানারূপে পর্দায় তুলে ধরেছেন গৌতম। এতে সাফল্যও এসেছে বারবার। ঝুলিতে তাই পুরেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের রাষ্ট্রীয় পুরস্কারসহ অসংখ্য বেসরকারি খেতাব ও পুরস্কার।

৬৮ বছর বয়সী নির্মাতা গৌতম ঘোষের জন্ম বাংলাদেশের ফরিদপুরে। প্রথম জীবনে ফটোসাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরুর পরে তিনি শুরু করেন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ। পরে সাহিত্যপ্রেমী এই নির্মাতা সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র বানিয়ে খ্যাতি কুড়াতে শুরু করেন।