বড়দিনে বড়ঘুমে চ্যাপলিন

২৫ডিসেম্বর ১৯৭৭ চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রশিল্পী চার্লস চ্যাপলিন । দুইমাস পর সমাধি থেকে চুরি হল তার শবদেহ । কেন এই ঘটনা?

প্রদীপ করবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Dec 2017, 01:51 PM
Updated : 25 Dec 2017, 03:48 PM

“শিল্পসৃষ্টির এক মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের নাম যদি কোনও দিন হারিয়েও যায়, তা হলেও চ্যাপলিনের নাম বেঁচে থাকবে। চ্যাপলিন অমর।”

মহান চলচ্চিত্রশিল্পী চার্লি চ্যাপলিন সম্পর্কে এ উচ্চারণ আরেক মহান চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের।

মৃত্যুর চল্লিশ বছর পরও চ্যাপলিন পুরোমাত্রায় জীবিত। জীবন যতো বেশি জটিল হবে, চ্যাপলিন ততো প্রয়োজনীয় হবেন। জীবন যতো যন্ত্রণাময় হবে, চ্যাপলিন ততোবেশি অনিবার্য হয়ে উঠবেন।

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কিছু দার্শনিক আলোর দরকার, চার্লস চ্যাপলিন সেই দিকদর্শী আলোক।

কেন চ্যাপলিন? এরকম বৈপরীত্যের সমন্বয় আর কেই বা হতে পারেন?

বিশ্বপরিচিত ট্র্যাম্প-এর চেহারাটির কথা একবার ভাবুন, মাথায় ছোটো বওল টুপি অথচ পায়ে বড়ো  জুতো; গায়ে চাপা কোট, পায়ে ঢোলা প্যান্ট! বহিরঙ্গের এই বৈপরীত্যের মধ্যেই যেন চার্লি চ্যাপলিনের অমোঘ দর্শন নিহিত আছে।

ফুটপাথে নাচ করে খাদ্য অন্বেষণ করতেন যে শিশু, তিনিই হয়ে উঠলেন হলিউডের ধনকুবের। নিজের জীবন দিয়েই প্রমাণ করেছেন, দারিদ্রের নিষ্ঠুর তীব্রতা থেকেই যেন প্রাচুর্যের, স্বাচ্ছন্দ্যের জন্ম হয়, যন্ত্রণাকে অস্ত্রের মতো ব্যবহার করে যদি কেউ সঠিক সংগ্রাম করতে সক্ষম হয়।

 

সিনেমাতেও তো তাই বলতে চেয়েছেন সারাজীবন ধরে। অতিসাধারণভাবে কৌতুকের জন্ম দিতে দিতে ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’, ‘ম্যসিয়ে ভের্দু’, কিংবা ‘আ কিং ইন নিউ ইয়র্ক’-এ যখন পৌঁছলেন, আমরা দেখলাম মানবতার লাঞ্ছনাকে চিহ্নিত করতে করতে, অসংগতিগুলোকে কৌতুকে বদলে দিতে দিতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ফ্যাসিবাদ, পুঁজিবাদের হিংস্রতা পেরিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন যোদ্ধা। ক্ষুধার্ত, দরিদ্র, লাঞ্ছিত, শোষিত মানুষের সহযোদ্ধা।

এই সংগ্রাম তাকে দিয়েছে অনেক কিছুই। লন্ডনের ফুটপাথ কিংবা কেনিংটনের বস্তিতে শৈশব হারিয়ে ফেলা  এক  জীবন কীভাবে বদলে গেল! ১৯১৬ সালে, চার্লির বয়স যখন মাত্র সাতাশ, তখন তিনি মিউচুয়্যাল ফিল্ম কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করছেন, সপ্তাহে বেতন ২ হাজার পাউন্ড পারিশ্রমিক।

বিশ্বখ্যাত মানুষটি ফুটপাথ থেকে রাজপ্রাসাদে পৌঁছেছিলেন আত্মবিশ্বাস আর অমানুষিক পরিশ্রমে ভর করেই। সম্মান, পুরস্কার খ্যাতি যতটা অর্জন করেছিলেন, লাঞ্ছনা, অপমান, তিরস্কারও পেয়েছিলেন বোধহয়, সমপরিমানেই।

যে হলিউড তাকে কেন্দ্র করেই সাবালক হয়ে উঠলো, মার্কিন সমালোচকরা তখনই তাঁকে বলছেন, “the biggest single fact in the motion picture industry” সেই চ্যাপলিনেরও নাগরিকত্ব কেড়ে নিল আমেরিকা। ওখানকার পত্রপত্রিকায় নিন্দামন্দ আর কুৎসা।

চার্লি চ্যাপলিন ও উনা

সারাজীবন ধরে অশান্তি আর অসুখী এই মানুষটি এবার ঘর বাঁধলেন সুইজারল্যান্ডে। সঙ্গী চতুর্থ স্ত্রী উনা। ৮৮ বছরের দীর্ঘ জীবনে শেষের এই তিনটি দশক ছিল তুলনামূলক শান্তির।

চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন (এক ‘কাউন্টেস ফ্রম হংকং’ বাদ দিলে) । তাদের দাম্পত্যে ৮ জন ছেলেমেয়ে নিয়ে এক্কেবারে সংসার ধর্মে মনোযোগী চ্যাপলিন।

জীবনের শেষবেলায় বৃদ্ধ চ্যাপলিন চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন, ঘন্টার পর ঘন্টা উনার হাত ধরে বসে থেকেছেন। স্তব্ধ, বিষন্ন, নীরবতার মধ্যে এই স্পর্শই ছিল তার একমাত্র ভাষা। তিনি হয়তো টের পাচ্ছিলেন মৃত্যুর অদ্ভুত শীতলতাকে। উনার এই স্পর্শই ছিল তার জীবনের অন্তিম উষ্ণতা।

১৯৭৭-এর ২৫ ডিসেম্বর চ্যাপলিনের ভেভির বাড়িতে যখন একত্রিত হয়েছে পরিবারের সব সদস্য, ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি সকলেই মেতে উঠেছে বড় দিনের অনুষ্ঠানে, তিনি পাশের ঘর থেকে শুয়ে শুয়ে  দেখছেন সব।

শিশুদের উৎসব যাপন দেখতে দেখতেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। ক্রিসমাস নাইটে ছোটোদের উপহার দিতে এসে সান্তা ক্লজ বুড়ো চ্যাপলিনকে উপহার দিয়ে গেলেন চিরঘুমের দেশ। ঘুমের মধ্যেই মারা গেলেন চ্যাপলিন।

তার শেষ ইচ্ছানুসারেই, অনাড়ম্বরভাবে, সুইজারল্যান্ডের ভেভিতে ২৭ ডিসেম্বর সমাধিস্থ করা হল তাকে।

সমাধি দেওয়ার দুইমাস পর ১৯৭৮- এর ১ মার্চ কবরখানার এক রক্ষীর নজরে আসে চ্যাপলিনের বিখ্যাত কবরটি খোঁড়াখুঁড়ি হয়ে রয়েছে। উধাও চ্যাপলিনের শবাধার।

সপরিবারে চ্যাপলিন

দুনিয়াজুড়ে চ্যাপলিন আবারও গণমাধ্যমের শিরোনামে। আবারও তাকে নিয়ে আলোচনার অন্ত নেই। এ ঘটনা কি ফ্যাসিস্টদের প্রতিশোধ? নাকি, ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ নির্মাতাকে নাৎসি সমর্থকেরা এভাবেই বিলুপ্ত করতে চায়? নাকি, অতি উৎসাহী কোনো ভক্তের পাগলামী! এমন মহান চলচ্চিত্রশিল্পীর দেহাবশেষ নিজের কাছে ধরে রাখতে চায়?

কয়েকদিন পর মি. কোহাট নামের এক ব্যক্তি, চ্যাপলিনের বাসায় ফোন করে, ছয় লক্ষ সুইস ফ্রাঁ মুক্তিপন দাবি করে চ্যাপলিনের শবাধারের।

চ্যাপলিনের স্ত্রী উনা তখন বলেছিলেন, ‘আমি এ শর্তে রাজি নই। আমার স্বামী আছেন আমার হৃদয়ে আর স্বর্গে’।

ছিনতাইকারীরা চ্যাপলিনের ছোটো ছেলেকেও হত্যার হুমকি দিল। তখন চ্যাপলিনের বড় মেয়ে জেরালডিন তাদের পারিবারিক উকিলকে নিয়ে পুলিশের সহায়তা নেয়। পুলিশের তৎপরতায় প্রায় ১৬ দিন পর, ১৭ মার্চ ধরা পড়ে দুই মৃতদেহ চোর।

একজন চল্লিশ বছরের যুবক রোমান ওয়ার্ডস, বেকার অটোমোবাইল মেকানিক; দ্বিতীয়জন জানেড, এক বুলগেরিয়ান মেকানিক। দু’জনই অপেশাদার ছিনতাইকারী। কিছুদিন আগেই তারা সংবাদপত্রে পড়েছিল, ইতালির এক শিল্পপতির মরদেহ চুরি করে প্রচুর টাকা আয় করেছে কয়েকজন চোর!

এর পরই তারা চ্যাপলিনের সমাধি করায়ত্ত করে প্রচুর টাকা মুক্তিপন দাবি করে। তারা স্বীকার করে এক বৃষ্টির রাত্রে অনেক পরিশ্রম করে চার্লির সমাধি থেকে কফিন তুলে নিয়ে গিয়ে দূরের এক গমক্ষেতের মাঝখানে তারা অস্থায়ী সমাধি দেয়।

যখন সেখান থেকে চ্যাপলিনের কফিন উদ্ধার করা হয়, তখন সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছিলেন দু’জন মানুষ । 

একজন, গমক্ষেতের দরিদ্র চাষি, তার নগন্য কৃষিক্ষেত হঠাৎ করেই জগৎ সেরা এক মানুষের শরীর স্পর্শ করল, মর্যাদাবৃদ্ধি হল তার জমির!

আর দ্বিতীয়জন উনা চ্যাপলিন, বিস্তৃত গমক্ষেতের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলেন, শান্ত উদার প্রশস্ত এই জায়গাটিই কি চ্যাপলিন বেছে নিয়েছিলেন চির প্রশান্তির জন্য?

সারাজীবন যে মানুষ অন্যদের আনন্দে রাখতে চেয়ে নিজে ছিলেন অসুখী, পৃথিবীকে শান্তির পথে এগিয়ে দিতে গিয়ে তার তো মরেও শান্তি নেই!!

জন্মের পর থেকে মৃত্যু পরবর্তী সমস্ত ক্ষেত্রে এরকম বৈপরীত্যের সমাহার যার জীবন, তিনিই তো পারবেন মানুষের অশ্রুকে হাসিতে রূপান্তর করতে।