তারকার চোখে যুদ্ধদেশ

১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকেই ছিলেন শিশু-কিশোর। এমন কয়েকজন তারকার কথায় সেই মর্মান্তিক দৃশ্যের প্রত্যক্ষ বিবরণ।

রুদ্র রুদ্রাক্ষবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2017, 11:34 AM
Updated : 16 Dec 2017, 11:53 AM
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল:

আমি তখন ১৫ বছরের কিশোর। দেশে যুদ্ধ আসলো,আমার চারপাশ রক্তাক্ত হল। আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। আমার বড় ভাই টুটুল ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করার আগে তার নির্দেশে ঢাকার নিউমার্কেটে পাকিস্তানী সেনাদের গাড়িতে গ্রেনেড ছুঁড়ে মেরেছিলাম। ওটাই শুরু।

এরপর যুদ্ধচলাকালীন ২ অক্টোবর আমাকে গ্রেফতার করা হয়। নিয়ে যাওয়া হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলে। শহীদ বাতেন, শহীদ নজরুলসহ মোট বাহান্ন জন মুক্তিযোদ্ধা সেখানে ছিলাম। এর মধ্যে বেয়াল্লিশ জনকে আমার চোখের সামনে হত্যা করা হয়।

আমাদের মৃত্যুও নিশ্চিত। এক রাতে আমরা চারজন জেল থেকে পালিয়ে নৌকার মাঝি সেজে ঢাকায় চলে আসি।

কিন্তু মাত্র একদিনের ব্যবধানে আজিমপুরের বাসা থেকে আবার গ্রেফতার হই। এবার আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যান্টনমেন্টে। সেকি বীভৎস দৃশ্য। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষের মৃতদেহ। সেখানেই আমার উপর নির্যাতন চালানো হয়।

এরপর যখন জ্ঞান ফেরে তখন নিজেকে আবিষ্কার করি রমনা থানায়। সেখানে মোট ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ওখান থেকে কখনো এক সপ্তাহ বা কখনও দুই সপ্তাহ পরপর সাতজন করে নিয়ে যাওয়া হত রাজারবাগে। সেখানেই হত্যা করা হত তাঁদের। আর আমরা বসে বসে মৃত্যুর জন্য দিন গুনতাম।

ভাইয়ের সামনে ভাইকে হত্যার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া যে কতটা যন্ত্রনার সেটা বলে বোঝানো যাবেনা। এরকম ভাবে আমরা ১৪ জন অবশিষ্ট ছিলাম।

১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর, মুক্তিযোদ্ধারা এখান থেকে আমাদের উদ্ধার করেন। ১৭ ডিসেম্বরের বাংলাদেশ দেখে আমি বুক ভরে 'মা' বলে ডেকে উঠেছিলাম।

মুশফিকুর রহমান গুলজার:

আমার তখন বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করে বেড়ানোর বয়স। কিন্তু সেই ১০ বছর বয়সেই দেখতে হয়েছে যুদ্ধের বীভৎসতা।

আমার বাড়ি গোপালগঞ্জে। ওখানে যুদ্ধ শুরুর পরেই শুরু হয় ব্যপক তৎপরতা। বাঁশ লাঠি নিয়ে বড়রা যখন মার্চ করতো আমিও তখন তাদের সাথে মার্চ করতাম। কিন্তু আমাদের মূল কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার সংগ্রহ করা।

আমরা সমস্ত গ্রাম হেঁটে হেঁটে খাবার সংগ্রহ করতাম আর সেগুলো দিয়ে আসতাম গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের অফিসে। সেখান থেকে খাবার বণ্টন করা হত মুক্তিযোদ্ধাদের।

এরপর যখন পাকিস্তানীরা গোপালগঞ্জ আক্রমণ করলো তখন আমার বাবা চলে যান যুদ্ধে। আর আমরা গোপালগঞ্জ শহর থেকে চলে যাই গভীর গ্রামে। ঐ সময়ে দেখতাম মানুষের মাথার খুলি হাড় রাস্তায় পড়ে আছে।

সেই বীভৎস স্মৃতি ঘুমের ঘোরেও তাড়া করে বেড়াতো। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা হল আমি সে সময় কান্না করতে ভুলে গেছিলাম। ওইটুকু বয়সে আমার মাথার ভেতরে ঢুকে গেছিল যুদ্ধদেশে কাঁদতে নেই, বুক চিতিয়ে প্রতিরোধ করতে হয় শুধু।

ইলিয়াস কাঞ্চন:

আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। তখন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনি। সেই ভাষণ আমাকে উজ্জীবিত করেছিলো যুদ্ধে যেতে। এরপর আমি আর আমার এক বন্ধু বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই।

আমার একজন শিক্ষক আব্দুল কুদ্দুস মাখনের কাছে একটা চিঠি লিখে দিয়েছিলেন, সাথে দিয়েছিলেন একটা ম্যাপ। আমরা যখন ঘুইন্নারচর বাজারে পৌঁছাই তখন স্থানীয়রা আমাদের পাকিস্তানী গুপ্তচর ভেবে আটকে ফেলে।

এলাকায় জানাজানি হয়ে যায়। এরপর এমপি সাহেবের লোক এসে আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়। কিন্তু ততক্ষণে পাশের রাজাকার সমৃদ্ধ এলাকায় খবরটা পৌঁছে যায়। তখন ওখানকার লোকজন আমাদের ফিরে আসতে বলে বাড়িতে। আমরা ফিরে আসি।  

ঢাকায় ফিরে একদিন টিকাটুলির পুঁথিঘরে বই কিনতে গেলাম। যখন সেখানে পৌঁছাই তখন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। বই কেনার সিদ্ধান্ত বদলে তখন বৃষ্টিতে ভেজার সিদ্ধান্ত নেই।

আমরা যখন টিকাটুলি থেকে ওয়ারী পৌঁছাই তখন পাকিস্তানী আর্মিদের গাড়ির মুখোমুখি হই।

সবাইকে রেখে আমার কাছেই তারা জানতে চাইলো 'ইন্ডিয়া থেকে কবে এসেছো?'। আমি বললাম আমি তো ছাত্র, বই কিনতে গিয়েছিলাম। আর্মির ভ্যানে তখন একজন বৃদ্ধমত আর্মি ছিলেন। তিনি মেজরকে বলছেন 'ওদের নিয়ে চলো, ওরা মুক্তিবাহিনি'।

কিন্তু মেজর ওনার কথা শোনেন নি। আমাকে জিজ্ঞেস করা হল, 'তোর বাপ কাকে ভোট দিয়েছে?' আমি জানিনা বলতেই একটা থাপ্পড় মারলো। গাল ফুলে উঠেছিল সেই এক থাপ্পড়ে।

বাসায় গিয়ে চাচাকে পুরোটা বলতে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন। মামাতো ভাইয়ের সাথে যখন গ্রামে যাচ্ছি চাচা তখন সাবধান করেছিলেন লাল ক্যাপ ও সবুজ ক্যাপ পরা আর্মি সম্পর্কে। বললেন, লাল ক্যাপ পরা আর্মিদের থেকে সাবধানে থাকতে। ওরা নাকি মানুষ মেরে ফেলে।

দুর্ভাগ্যক্রমে ট্রেনে উঠেই এক লাল ক্যাপ পরা আর্মির মুখোমুখি হই। সে আমার কাছে এগোতেই ট্রেন ছাড়ার জন্য হুইশেল দেয়। তখন তিনি এক বিডিআরকে আমার ব্যাগ সার্চ করতে বলে নেমে গেলেন। বিডিআর তন্ন তন্ন করে আমার ব্যাগ সার্চ করলেন।

এরপর ট্রেন যখন নরসিংদী পৌঁছায় তখন সংবাদ আসে ট্রেন আর যাবেনা। ভৈরবের ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা তখন নেমে যাই। রাতে স্থানীয় এক আওয়ামলীগ নেতার বাড়িতে থাকি।

সকালে শুনি ওখানকার কটিয়াদি গ্রামের বাজারে আর্মিরা আক্রমণ করেছে। কিন্তু ঐ পথ দিয়েই আমাদের বাড়ি যেতে হবে। আরেকটা পথ ছিল সেটা আরও ৫০ কিলোমিটার বেশি। সেই পথ ধরে হেঁটেই বাড়ি যাই। একটা সময় কান্না পাচ্ছিল, আর হাঁটতে পারছিলাম না।

এরপর অনেক পথ পরিক্রমায় দেশ যখন স্বাধীন হল তখন সে কি আনন্দ। মনে হচ্ছিল চারিদিকে একটা উৎসব নেমেছে। আমাদের এখানে বিজয় মিছিল হয়েছিল। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম দিন সেই ১৬ ডিসেম্বর।

মাসুম রেজা:

৭১ সালে আমার বয়স ছিল ৬ বছর। সমস্ত স্মৃতিটা মনে আছে এখনও। কুষ্টিয়া মূলত আক্রান্ত হয় ২৫ মার্চের পরপরই। আমরা কুষ্টিয়া থেকে পালিয়ে ফুপুর বাড়ি পোড়াদহে যাচ্ছি দলবেঁধে। আমাদের সাথে তখন শত শত মানুষের লাইন। হঠাৎ করে বিমান থেকে গুলি করা শুরু করে পাকিস্তানী হানাদারেরা। তখন যে যার মত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই।

খুব ভয় পেয়েছিলাম সেদিন। কুষ্টিয়া হানাদার মুক্ত হয় ৮ ডিসেম্বর। আমরা কুষ্টিয়ায় ফিরি ১৬ ডিসেম্বর। ফিরে দেখি একজন রাজাকারকে দলবেঁধে নিয়ে যাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা। এরপর আমিও সেই মিছিলে যোগ দেই।

যুদ্ধপরবর্তী যে শৈশবটা ছিল সেখানে আমাদের প্রধান খেলা ছিল রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা খেলা।

চিন্তা করুন পাকিস্তানী বাহিনী ও তাঁদের এদেশীয় দোসরদের অত্যাচার শিশুদের মনেও এতটা দাগ কেটেছিল যে কেউই রাজাকার হতে চাইতো না।

কবরী:

৭১ সালে ঢাকা যখন আক্রান্ত হয় তখন আমি স্বামী ও দুই সন্তান সহ গ্রামে চলে যাই। সেখান থেকে তিন দিন তিন রাত হেঁটে দু’জন দালালের সাহায্যে চট্টগ্রামের নারায়ণহাটে যাই। নারায়ণহাট তখনও মুক্ত এলাকা ছিল।

আমাদের সৈন্যরা সন্ধ্যায় জিপ নিয়ে সেখানে আসতো। আর এক জিপ এক জিপ করে মানুষ নিয়ে সাবরুম বর্ডারের উদ্দেশ্যে রওনা হত। এরকম এক সন্ধ্যায় তাদের গাড়িতে ছিল ক্যাপ্টেন কাদের। তিনি আমাকে চিনতে পারেন। আমাদের যখন ক্যাপ্টেন কাদের জিপে ওঠান তখন পেছন থেকে হাজার হাজার মানুষ জিপ টেনে ধরে। সে দৃশ্য আজও ভুলতে পারিনা।

বাঁচার জন্য মানুষের সেই হাহাকার এখনও বুকের ভেতর পাথর হয়ে আছে। এরপর আমরা সাবরুম বর্ডারে আসি। ওখানকার ওসি রাতে তার বাড়িতে থাকতে দেন আমাদের। খুব ভোরে বের হয়ে যাই সেখান থেকে। এরপর গিয়ে পৌঁছাই ভারতের আগরতলায়। ওখানে আমাদের সাহায্য করেন যুগান্তর পত্রিকার আগরতলা করেসপন্ডেন্ট অনিল ভট্টাচার্য।

এসময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একটা হিন্দি সিনেমাতে অভিনয় শুরু করি। সিনেমাটির নাম ছিল 'জয় বাংলা'। সিনেমাটিতে অভিনয়ের জন্য সেসময়ে বিশ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। সেখান থেকে দশ হাজার টাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছিলাম।

এছাড়াও কলকাতা, হায়দারাবাদসহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে দেশের জন্য জনমত তৈরি করেছি।

এরপর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হল। তখন আমরা মুম্বাইতে। বিবিসি, রয়টার্স থেকে সাংবাদিকেরা এল আমাদের ছবি তুলতে। তাদের মুখেই শুনলাম বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।

ওটা শোনার পর কয়েক মিনিটের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিলাম। কন্ঠটা ভারি হয়ে গিয়েছিল, গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছিল না। ভাবছিলাম আমি হয়তো বোবা হয়ে গেছি।