বিদেশী নির্মাতাদের চোখে মুক্তিযুদ্ধ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গল্প দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভাবনার বিষয় হয়ে উঠেছে বিদেশী নির্মাতাদেরও বিদেশী নির্মাতাদের চোখে কেমন ছিলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ? বিজয় দিবসে এরকমই কিছু সিনেমার কথা।

প্রমা সঞ্চিতাঅত্রিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2017, 07:24 AM
Updated : 16 Dec 2017, 07:44 AM

বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রয়েছে অনেক সিনেমা। ‘ওরা ১১ জন’ থেকে শুরু করে ‘আগুনের পরশমণি’, ‘অরুনোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘জয়যাত্রা’, ‘গেরিলা’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ ও সর্বশেষ ‘ভুবনমাঝি’তে আমরা দেখি মুক্তিযুদ্ধের উপস্থাপন।

তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভাবনার বিষয় হয়ে উঠেছে বিদেশী নির্মাতাদেরও। বিশেষ করে ভারতীয় সিনেমায় আমরা দেখি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশ কিছু কাজ। তেমনই কিছু সিনেমা নিয়ে সাজানো হলো এ বিশেষ প্রতিবেদন।

১. ‘মুক্তির গান’ (১৯৯৫):

‘মুক্তির গান’ বাংলাভাষায় নির্মিত তথ্যচিত্র হলেও পরিচালক হিসেবে এতে তারেক মাসুদের পাশাপাশি মার্কিন নির্মাতাক্যাথরিন মাসুদের নামও দেখতে পাই আমরা। তবে ১৯৭১ সালে মূল তথ্যচিত্রটি ধারণ করেছিলেন মার্কিন চলচ্চিত্রনির্মাতা লিয়ার লেভিন।

১৯৭১ সালে ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামের একটি সাংস্কৃতিক দলের সদস্যরা যুদ্ধ-কবলিত বাংলাদেশেরমুক্তাঞ্চলগুলোতে ঘুরে ঘুরে ‘মুক্তির গান’ পরিবেশন করতো।

গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে গান, কবিতা, ছায়া নাটক, পুতুল নাচ ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের অণুপ্রাণিত করতো।শিল্পী গোষ্ঠীর সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অংশ ও ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ঘুরে অসহায় ও দুঃস্থ জনগণের দুর্দশার চিত্রক্যামেরাবন্দী করেন লিয়ার লেভিন।

পরবর্তীতে এ ফুটেজগুলো তার কাছ থেকে সংরক্ষণ করেন বাংলাদেশী চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদ।

প্রাপ্ত ফুটেজের সঙ্গে সুর ও ন্যারেটিভ জুড়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের সংরক্ষিত কিছু ফুটেজ ব্যবহার করে একে ‘মুক্তির গান’ (সংঅফ ফ্রিডম) শিরোনামে প্রামাণ্যচিত্র আকারে সবার সামনে আনেন তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ।

 

একাত্তরের দুর্লভ দলিল হিসেবে আজও দেশে-বিদেশে সমাদৃত ‘মুক্তির গান’।

২. ‘১৬ ডিসেম্বর’ (২০০২):

বলিউড অ্যাকশন স্পাই থ্রিলার ‘১৬ ডিসেম্বর’ পরিচালনা করেন মনি শঙ্কর। এতে অভিনয় করেন ড্যানি ডেনজংপা,গুলশান গ্রোভার, মিলিন্দ সোমান, দীপান্বিতা শর্মা, সুশান্ত সিং প্রমুখ।

১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী পরাজয় বরণ করে নেয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে। আত্মসমর্পণেরঐতিহাসিক ঘটনাকে পটভূমি করে নির্মিত হয়েছে এ সিনেমাটি।

সিনেমায় দেখা গেছে একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য পরাজয়ের অপমান ভুলতে না পেরে ‘কালাখানজার’ নামের একটি অপরাধী চক্র গড়ে তোলে। ভারতে এ দলটি গোপনে মানি লন্ডারিং সহ নানা অনৈতিক কাজচালিয়ে যায়।

 

ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর চার সদস্যকে দেওয়া হয় ‘কালা খানজার’ ধ্বংস করে দেওয়ার মিশন। ঘটনাচক্রে ২০০১সালের ১৬ ডিসেম্বর নয়া দিল্লিতে একটি জঙ্গি হামলা চালানোর পরিকল্পনা করে ‘কালা খানজার’।

১৯৭১ সালের সালে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের দিনটির কথা মাথায় রেখেই এই তারিখ নির্ধারণ করেতারা।অসীম সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এ জঙ্গি হামলা প্রতিহত করে চার গোয়েন্দা বিজয়, বিক্রম, শীবা ও ভিক্টর।

৩. ‘১৯৭১’ (২০০৭):

অমৃত সাগর পরিচালিত বলিউড ওয়ার সিনেমা ‘১৯৭১’ এ পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছয় ভারতীয় সৈন্যের পালিয়েভারতে আসার গল্প বলা হয়।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে লড়তে আসা ছয় ভারতীয় সৈনিক বন্দী হয় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। ছয় বছরকারাবন্দী থাকার পর ১৯৭৭ সালে জেল পালিয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন তারা। এমনই এক চমকপ্রদ গল্প নিয়ে নির্মিতহয়েছে সিনেমাটি।

রহস্য ও রোমাঞ্চে ভরপুর এ সিনেমাটিকে বলিউডের অন্যতম সেরা ক্লাসিক ছবির স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

সিনেমার শুরুতে দেখানো হয় বাংলাদেশে যুদ্ধরত ছয় ভারতীয় সৈন্যকে। এ সিনেমায় সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ দেখানো নাহলেও ঘটনা পরম্পরায় উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন খন্ডচিত্র।

এতে অভিনয় করেছেন মনোজ বাজপায়ী, রবি কিষান, কুমুদ মিশ্র, মানব কউল, দীপক দব্রিয়াল, পিযূষ মিশ্র প্রমুখ।

অসাধারণ নির্মাণশৈলী ও চমৎকার অভিনয়ের জন্য সিনেমাটি সমালোচকদের দৃষ্টি কাড়ে। ২০০৭ সালের সেরা সিনেমাহিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে ‘১৯৭১’।

৪. ‘গয়নার বাক্স’ (২০১৩):

অপর্না সেন পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় হরর কমেডি ‘গয়নার বাক্স’তে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছেবাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।

তিন প্রজন্মের তিন নারীর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া গহনা নিয়ে তৈরি হওয়া জটিলতার গল্প মজার ছলে উঠে এসেছে এসিনেমায়।

সিনেমায় আমরা দেখি ১৯৪৭ এর দেশভাগে পূর্ববাংলা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমানো হিন্দু বিধবা নারী রশোমনিরগচ্ছিত গহনা মৃত্যুর পর পায় তার ভাইয়ের ছেলের বউ সোমালতা।

মারা যাওয়ার পরও গহনার মায়া ভুলতে না পেরে ভূত হয়ে গহনা পাহারা দিতে আসেন রশোমনি। তারই পরামর্শে গহনারকিছু অংশ বিক্রি করে স্বামীকে ব্যবসার অর্থ যোগান দেয় সোমলতা।

পরবর্তীতে গহনার মালিকানা পায় সোমলতার মেয়ে চৈতালি। আধুনিক যুগের মেয়ে চৈতালি যখন বড় হয় তখনই পূর্ববঙ্গেশুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ।

২৫ মার্চের নির্মম গণহত্যার পর পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে পালিয়ে আসে অসংখ্য শরণার্থী।যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে শুরুহয় মুক্তিবাহিনী গঠন। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে চৈতালি তার সমস্ত গহনা দান করে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করতে।

 

এ সিনেমায় অত্যন্ত আবেগী ও মর্মস্পর্শীভাবে উঠে এসেছ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।

এ সিনেমায় ভূত রশোমনি ও সোমলতা চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জেতেন অভিনেত্রী মৌসুমীচ্যাটার্জী ও কঙ্কনা সেন শর্মা।

৫. ‘যুদ্ধশিশু-চ্রিলড্রেন অফ ওয়ার’ (২০১৪):

নবীন পরিচালক মৃতুঞ্জয় দেবব্রত’র পরিচালনায় প্রথমবারের মতো মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয় ভারতীয়হিন্দি সিনেমা ‘যুদ্ধশিশু’ বা ‘চিলড্রেন অফ ওয়ার’।

প্রথমে এ সিনেমার নাম ‘দ্য বাস্টার্ড চাইল্ড’ রাখা হয়েছিলে। তবে সেন্সরবোর্ডে ‘বাস্টার্ড’ শব্দটি নিয়ে আপত্তি ওঠায়পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করেন নির্মাতা।

২৫ মার্চের গণহত্যা থেকে শুরু করে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নারী নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরাহয়েছে সিনেমায়।বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনা নারীদের উপর পাকিস্তানী বাহিনীর অকথ্য নির্যাতনের চিত্র এসিনেমায় দেখতে পাই আমরা।

তিনটি ভিন্ন গল্পে এ সিনেমায় যুদ্ধের চিত্র তুলে ধরেছেন পরিচালক। গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা দুই ভাই-বোন, এক শহুরেসাংবাদিক ও তার স্ত্রীর বিচ্ছেদ এবং একটি মুক্তিফৌজ ও কিছু গেরিলা যোদ্ধার কাহিনির মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে ‘চিলড্রেনঅফ ওয়ার’ সিনেমাটি।

চমৎকার দৃশ্যায়ন এবং ঋদ্ধি সেন, রুচা ইনামদার, রুদ্রনীল, রাইমা সেন, পবন মালহোত্রা ও ভিক্টর ব্যানার্জীর অনবদ্যঅভিনয় প্রশংশিত হয়েছে এ সিনেমায়। তবে ইতিহাস বর্ণনায় কিছু দুর্বলতা ও মাত্রাতিরিক্ত নৃশংসতা উপস্থাপনের কারণেসমালোচিত হয়েছে সিনেমাটি।

 
৬. ‘গুন্ডে’ (২০১৪):

আলী আব্বাস জাফর পরিচালিত ও যশরাজ ফিল্মস এর ব্যানারে নির্মিত সাড়াজাগানো বলিউড অ্যাকশন থ্রিলার‘গুন্ডে’কে নিয়ে বাংলাদেশে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে পালিয়ে আসা দুই এতিম শিশু বিক্রম ও বালার গুন্ডা হয়ে ওঠার গল্পনিয়ে নির্মিত এ সিনেমাটিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ উঠেছিল।

রণবীর সিং, অর্জুন কাপুর, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, ইরফান খান প্রমুখ অভিনীত এ সিনেমায় ‘ভারত-পাকিস্তানের তৃতীয় যুদ্ধেরফসল বাংলাদেশ’- এমন সংলাপ থাকায় এ নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বাংলাদেশে।

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে প্রচার করাকে মেনে নিতে পারেনি বাংলাদেশও পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসবিদরাও।

প্রতিবাদ ও বিতর্কের মুখে ‘যশরাজ ফিল্মস’ কর্তৃপক্ষ ক্ষমা চাইলেও সিনেমা থেকে সংলাপটি বাদ দেয়নি ভারতের সেন্সরবোর্ড।

 

৭. দ্য গাজী অ্যাটাক (২০১৭):

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত ও পাকিস্তান বাহিনীর নৌ-যুদ্ধ নিয়ে নির্মিত সিনেমা ‘দ্য গাজী অ্যাটাক’।জনপ্রিয়বলিউড পরিচালক করণ জোহরের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘ধর্ম প্রডাকশন’-এর ব্যানারে নির্মিত এ সিনেমায় অভিনয় করেছনরানা দগ্গুবতী, অতুল কুলকার্নি, তাপসী পান্নু, কে কে মেনন প্রমুখ।

বিজয় নিশ্চিত হওয়ার অল্প কিছুদিন আগে ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর বঙ্গোপোসাগরে রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যায়পাকিস্তানী সাবমেরিন পিএনএস গাজী।

গাজীর চেয়ে কম শক্তিসম্পন্ন ‘আইএনএস রাজপুত’ দিয়ে শক্তিশালী এ সাবমেরিন ডুবিয়ে দেওয়ার পুরো কৃতিত্বই ছিলোভারতীয় নৌ-বাহিনীর কর্মকর্তা রণবিজয় সিং ও অর্জুন ভার্মার।

এ সিনেমায় বাংলাদেশী শরনার্থী নারীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন ‘পিঙ্ক’ অভিনেত্রী তাপসী পান্নু।

 

সমালোচকদের দৃষ্টি কাড়লেও বক্সঅফিসে খুব একটা সাড়া ফেলতে পারেনি সিনেমাটি।

৮. ‘মুক্তি- বার্থ অফ আ নেশন’ (২০১৭):

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চমৎকার একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মুক্তি’। মনু চোবে পরিচালিত এ ২২ মিনিটের সিনেমায়দেখানো হয়েছে কীভাবে ভারতীয় লেফটেনেন্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকবের কারণে পাল্টে গিয়েছিল যুদ্ধেরগতিপ্রবাহ।

ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর ইহুদি অফিসার জে এফ আর জ্যাকব যাকে ‘জেইক সুইটি’ নামেও ডাকা হতো, বাংলাদেশেরস্বাধীনতায় তার ভূমিকার কথা আমরা অনেকেই হয়ত জানি না।

পূর্ব বাংলায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সংকটময় একটি সময়ে পাকিস্তানি জেনারেল এ এ খান নিয়াজীর সঙ্গে জ্যাকবেরচৌকস ও বুদ্ধিদীপ্ত কথোপকথন বদলে দিয়েছিল যুদ্ধের ইতিহাস।

মিলিন্দ সোমান, যশপাল শর্মা অভিনীত এ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটিকে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম তথ্যসমৃদ্ধ একটি সিনেমা হিসেবেবিবেচনা করা হয়।