উনি কতবড় চলচ্চিত্রকার ছিলেন, কী কী পুরুস্কার পেয়েছেন আর কী কী পুরুস্কার পান নি এটা আমার লেখার বিষয় না। ওনার এসব বিষয়ে আগ্রহও ছিলনা কোনো দিন।
তাঁর প্রথম তৈরি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বাংলাদেশের সেন্সরে বোর্ডের চৌকাঠ যখন পার হতে পারলো না। তখন তিনি ছবিটি পাঠাতে শুরু করলেন বিভিন্ন বিদেশী উৎসবে।
এসব বিষয়ে তাঁর অনেক আক্ষেপ ছিল। এমন অনেক বিষয়ে তাঁর সাথে কথা হয়েছে, দিনের পর দিন। উনার উপর ছবি করবার সময় আমি একটা বিষয়ই ধরতে চেষ্টা করেছি। একটা মানুষ কীভাবে এত সহজ সরল করে সিনেমার ভাষাকে মনের ভাষার মতো করে ব্যক্ত করে!
তাঁর ভিতরের সত্যটা কী? এটা আমি বুঝতে চেষ্টা করেছি। সামান্যই পেরেছি, আর বেশিটুকই পারিনি। অকালেই যে চলে গেলেন!
আমাদের দেশে প্রতিভার কদর আর সাংস্কৃতিককর্মীর জ্ঞানের আদর খুব কমই হয়। মরে গেলে হয় যার নামে রাস্তা, মরার আগে সে সস্তা -এ যেন আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক কর্মীদের চিরন্তন দুর্ভাগ্যের ললাট।
এই অভিশাপময় রূপহীন অবস্থা আমাদের কারণেও তৈরি হয়েছে কিছুটা। দিনের পর দিন ধরে আমাদের হীনমন্যতাও এর জন্য অনেকখানি দায়ী।
আমরা নিজেরা নিজেদের কাজকে বলতে চাই মহান আর অপরের কাজের করি দুর্নাম। এমন পরিবেশে চলচ্চিত্রে একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটলো, তারেক মাসুদ।
তার কর্ম-পদ্ধতি একটু আলাদা গোছের। এইলোক প্রায়ই গ্রামে থাকে, থাকে ঢাকায় ও আমেরিকায়ও। ভদ্র সমাজের অনেক মানুষ তার ছবির অনুরাগী। দেশ বিদেশের অনেক চাকচিক্যময় পুরস্কার পাবার পরও গ্রামে থাকবার ভুতুড়ে নেশা তাকে অদ্ভুতভাবে পেয়ে বসে।
মাঝে মধ্যে তাঁকে চলচ্চিত্র বিষয়ে পত্র-পত্রিকায় লিখতে বা টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিতে দেখা যেত। কথার যাদুতে আবদ্ধ করে রাখার তীব্র এক গুণ তার প্রতি তার দর্শক, পাঠক ও শ্রোতাদের আবদ্ধ করে রাখতো।
এক সময়ে চলচ্চিত্র নিয়ে তাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের স্বপ্নের বিলাসিতা বাস্তবে রূপ পেতে শুরু করল।
বর্তমান সময়ে যারা, যে সব চলচ্চিত্র নির্মাতারা, চলচ্চিত্রে নতুন এক সময়ের কথা বলছেন তাঁদের প্রত্যেকের স্বপ্নের বীজ যে তারেক মাসুদ নামক চলচ্চিত্র বৃক্ষের, এটা এই নির্মাতারা প্রত্যেকেই এক কথায় স্বীকার করবেন বলে আমার বিশ্বাস।
এমন অবস্থায়, মনে হলো একদিন তারেক ভাই থাকবেনা, জহির রায়হান যেমন নেই। চাইলেও তার কোনো কথা কোনোদিন আমরা আর শুনতে পাব না। চলচ্চিত্র নিয়ে এই যে যুদ্ধ তাঁরা করে গেছেন। কেন করেছেন? কি সেই উৎস? যা, তাদের যুগে যুগে পরিবর্তনের প্রবল আকাঙ্ক্ষায় পাগল করে হাতে তুলে নেন ক্যামেরা!
এই তাড়নায় তারেক মাসুদের উপর ছবি বানাতে তার সাথে যোগাযোগ । তারপর ক্যামেরা কাঁধে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তার সাথে ঘুরে ঘুরে তৈরি হলো তারেক মাসুদ, তার দর্শন ও চলচ্চিত্রযাত্রার উপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘সুলতান’।
বলতেন “সুলতান ভাইয়ের উপর ছবি করতে আমার সাত বছর লেগেছে। সাত বছরে মানুষ হয়তো তেরোটা ছবি করে। কিন্তু, আমার জীবনে পরববর্তীতে যা অর্জন সবই এই সাত বছরের জন্য অর্জিত হয়েছে।”
আমাদের ধীরে চলা কর্মপদ্ধতি দেখে বলতেন তার জীবনের মিলে যাওয়া স্মৃতির কথা। সুলতান ভাইয়ের সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো, বিজয় সরকারের মেলা দেখতে যাওয়ার গল্প, সব ধূসর চোখে যেন দেখতে পেতাম আমরা তারেক ভাইয়ের চোখ দিয়ে। রাত ভোর করে গল্প করা সে জাদুকরের কথা আমাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখাতো।
আমাদের দেশে তখনও অ্যানালগ পদ্ধতিতে সিনেমা প্রদর্শিত হতো সব জায়গাতেই। সবাই এটা জানেন যে, তিনি তার কর্মব্যস্ততার একটা বড় অংশ ব্যয় করতেন দেশের সিনেমাকে ডিজিটাল ব্যবস্থায় নির্মাণ ও প্রদর্শনী করার বিষয়টি সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে।
তখন অনেকেই ভাবতে পারতেন না একদিন ফিল্মে বানানো (সেলুলয়েড ফিতায়) সিনেমা থাকবে না।
তারেক ভাই তখনই বলতেন “অ্যানালগ সিনেমা বানানোর এ পদ্ধতি খুব দ্রুত জাদুঘরে চলে যাবে। তোমাদের সময়ে ডিজিটাল হবে সব, সিনেমা বানানো ও দেখানো পুরো বিষয়টাই হবে ডিজিটাল। যে সুযোগ আমরা পাইনি তা তোমরা পাবে, তৈরি হও। সিনেমা পরিচালককে নন্দনতত্ত্বের পারদর্শিতার সাথে সাথে প্রযুক্তিতেও পারদর্শী হতে হয়। Cinema always dills with technology।”
হল সংস্কারে সরকারী-বেসরকারী অনীহা ও সিনেমা হলের জন্য সরকার থেকে জায়গা বরাদ্দ নিয়ে হল মালিকদের ব্যক্তিস্বার্থে সিনেমা হল ভেঙে বাণিজ্যিক মার্কেট করা তাঁর বড় দুঃখের কারণ ছিল। এ নিয়ে অনেক আন্দোলনও করেছিলেন তিনি।
তিনি বলতেন, “একজন তরুণ ইভ টিজিং করবে না, মাদকে যাবে, সন্ত্রাসে যাবে না তো সে কী করবে? কোথায় যাবে? তখন সে আরো বাজে জায়গায় যাবে। তাই রাষ্ট্রের জন্য, সমাজের জন্য সিনেমা ও সিনেমা হলকে টিকিয়ে রাখতে হবে।”
সিনেমা বানানোর কৌশল নিয়ে বলতে গিয়ে বলতেন, “এই যে ডিজিটাল সিনেমা বানানো ও প্রদর্শনীর যে প্রতিবন্ধকতা এখন দেখছো সেটা একদিন থাকবেনা, যারা ডিজিটাল সিনেমার বিরোধিতা করছেন তাঁরা একদিন বুঝবেন তাঁরা ভুল করছেন। আমি সিনেমার ক্ষতি করছি বলে যারা ভাবছেন, তাঁরা বুঝবেন আমি সিনেমার শত্রু না। একদিন আমাদের এ যুদ্ধটা হয়তো করতে হবে না, কিন্তু হয়তো সেদিন আমরা থাকব না। সেদিন হয়তো তোমাদের অন্য কোনো যুদ্ধ করতে হবে, তোমরা সেই যুদ্ধটা চালিয়ে যেও।”
মহান শিল্পী এস এম সুলতান এর কথা প্রায়ই বলতেন। বলতেন, “আমি গ্রামের ছেলে কিন্তু সত্যিকারের গ্রাম দেখতে শিখেছি সুলতান ভাইয়ের চোখ দিয়ে।”
বলতেন, “আমরা একটা কিছু করলেই ভাবি, আমি বিরাট কিছু করে ফেলেছি, এবার সমাজ আমাকে তার প্রতিদান দিক। এটা আমাদের মধ্যে হয়। অথচ সুলতান ভাইকে দেখতাম দেশ বিদেশের সব নেম-ফেম ফেলে দিয়ে একজন এত বড়ো শিল্পী এই গ্রামীন সমাজে নিজের আত্মাকে খোঁজার চেষ্টা করছেন।
তাই একজন সত্যিকারের শিল্পীর এটাই বোধ হওয়া উচিৎ যে সমাজ আমার জন্য কী করছে এটা না, আমি যতদিন বেঁচে আছি, আমি সমাজের জন্য কী করছি এ প্রশ্নের যথাযথ উত্তরের দিকে নিজেকে নিয়ে যাওয়া।”