‘হুমায়ূন নামা’ থেকে..

নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের ‘চন্দ্রকথা’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে অভিনয়ে যাত্রা শুরু করেন স্বাধীন খসরু। এ নির্মাতার পরিচালনায় শতাধিক নাটক, গোটা বিশেক টেলিফিল্ম আর চারটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে হুমায়ূনের চরিত্র হিসেবে জনপ্রিয় মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। শুধু নির্মাতা-অভিনেতা সম্পর্কই নয়, হুমায়ূনের সঙ্গে ছিলো তার দীর্ঘ যাপন। সেসব স্মৃতি নিয়েই স্বাধীন খসরু প্রকাশ করতে যাচ্ছেন ‘হুমায়ূন নামা’। হুমায়ূন আহমেদের ৭০তম জন্মবার্ষিকীতে অপ্রকাশিত ‘হুমায়ূন নামা’থেকে কিছু অংশ..

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Nov 2017, 11:59 AM
Updated : 13 Nov 2017, 11:59 AM

‘চন্দ্রকথা’ মু‌ক্তি হওয়ার এক মাস পর আমি আবার লন্ডন চ‌লে আসি। লন্ডন ফি‌রে আসার দুই সপ্তাহ পর ‘অন্য‌দি‌ন’-এর মাজহার ভাইয়ের ফোন,

কেমন আছেন?

ভা‌লো আছি,

স্বাধীন, স্যার কথা বল‌বে। যথারীতি ‘দক্ষিন হাওয়া’য় আড্ডা চল‌ছে।

স্বাধীন কি অবস্থা?

ভা‌লো, আপ‌নি কেমন আছেন?

বেঁচে আছি। এখা‌নে সবাই তোমা‌কে মিস কর‌ছে। শোন আমার ইচ্ছে ছি‌লো না যাওয়ার, কিন্তু যে‌তে হ‌চ্ছে।

জি‌গ্গ্যেস করলাম কোথায়?

অ্যা‌মে‌রিকায়, ওখা‌নে ঢা‌লিউড অ্যাওয়ার্ড হ‌চ্ছে, আমরা যা‌বো! বল‌লেন, তোমার‌তো ভিসা লাগ‌বে না, তু‌মি চ‌লে এসো! কথা শেষ না ক‌রে ব‌ল‌লেন, ধ‌রো মাজহার এর সা‌থে কথা ব‌লো।

মাজহার ভাই ব‌লেন, স্বাধীন এখান থে‌কে আমি, স্যার আর শাওন যাচ্ছি, আপ‌নি ওখান থে‌কে চ‌লে আসেন! আর শো‌নেন, মাসুম আসবে কানাডা থে‌কে।

দিন তা‌রিখ ঠিক হ‌লো, হুমায়ূন ভাইরা আমার এক‌দিন আগে চ‌লে গে‌লেন নিউইয়র্ক। আমি এক‌দিন পর JFK এয়ার‌পোর্ট পৌঁছালাম, বের হ‌য়ে দেখতে পেলাম মাজহার ভাই আমা‌কে নিতে এসে‌ছেন। এয়ার‌পোর্ট থে‌কে সোজা ম্যানহা‌টেন হিলটন হো‌টে‌লে। হোটেল পৌঁছে দেখলাম পর্যাপ্ত প‌রিমান সরঞ্জাম নি‌য়ে হুমায়ুন ভাই রা‌তের আড্ডার জন্য প্রস্তুত।

রু‌মে ঢুক‌তেই হুমায়ূন ভাই বল‌লেন, স্বাধীন ওয়েলকাম, আসো ব‌সে সময় নষ্ট না ক‌রে ব‌সে পড়ো। বল‌লেন, মাসুম আস‌বে ট্রেইনে ক‌রে ট‌রেন্টো থে‌কে।

ঘন্টাখা‌নেক পর মাসুম এসে উপস্থিত। হুমায়ূন ভাই বল‌লেন, দরজা লক ক‌রো, শুরু হ‌লো পু‌রোদ‌মে চু‌টি‌য়ে আড্ডা, সা‌থে আরেকজন আছেন নিউইয়র্ক প্রবা‌সী খোকন ভাই (যা‌কে আমি ‘হাঁস ভাই’ ব‌লে ডা‌কি)।

হো‌টে‌ল ভ‌র্তি তখন বাংলা‌শের শি‌ল্পী, সাংবা‌দিক। প‌রের দিন যথাসম‌য়ে অনুষ্ঠান হ‌লো, অনুষ্ঠা‌নে বোম্বের রানি মুখা‌র্জিও ছি‌লেন। অনুষ্ঠা‌নে হুমায়ূন ভাইয়ের লেখা ছোট নাটকে অভিনয় করলাম, আমি, শাওন আর ম‌নির খান শিমুল।

অনুষ্ঠান শে‌ষে হো‌টে‌লে ফির‌তেই মাজহার ভাই আর আমা‌কে হুমায়ূন ভাই রু‌মে ডে‌কে নি‌য়ে বল‌লেন, শোন, খোকন‌কে ব‌লো নী‌চে গা‌ড়ি নি‌য়ে রে‌ডি থাক‌তে। বল‌লেন, ‌কেউ যে‌ন বুঝ‌তে না পা‌রে, যার যার জি‌নিসপত্র নি‌য়ে একজন একজন ক‌রে গা‌ড়ি‌তে গি‌য়ে উঠো।

উনার কথাম‌তো সবই হ‌লো, কেউ কিছু বোঝার আগে আমরা গা‌ড়ি‌তে উঠলাম, শুধু জি‌গ্গেস কর‌লেন কেউ বুঝ‌তে পা‌রে‌নি ‌তো?

রা‌তের নিউইয়র্কের রাস্তায় ঘোরাঘু‌রি, টুইন টাওয়ার জি‌রো প‌য়ে‌ন্টে কিছুক্ষন। তারপর হুমায়ূন ভাইয়ের পুর্বপ‌রি‌চি‌ত নিউইয়র্ক প্রবা‌সী আবে‌দিন ভাই, জ‌লি আপার বাসায় গি‌য়ে উপস্থিত। অনেক রাতে আড্ডা শে‌ষে রা‌ত্রি যাপন। প‌রের‌দিন নাস্তা শে‌ষে মি‌নিবাস ভাড়া ক‌রে নায়াগ্রা ফলস উদ্দে‌শ্যে যাত্রা, চালক খোকন ভাই।

যাত্রা শুরুর কিছুক্ষন প‌রে সা‌র্ভিস স্টেশন থামলো গা‌ড়ি, কিনলাম ক‌য়েকটা স্ক্রাচ কার্ড। গা‌ড়ি চল‌তে শুরু কর‌ল, আমি কার্ডগু‌লো ক‌য়েন দি‌য়ে ঘষ‌তে শুরু করলাম, যাত্রাপ‌থের ভাগ্য প‌রীক্ষা!

খেয়াল করলাম হুমায়ূন ভাইয়ের উৎসুক দু‌টি চোখ আমার দি‌কে, স্বাধীন কী ক‌রো?

বললাম হুমায়ূন ভাই এটা স্ক্রাচ কার্ড, ভাগ্য প‌রীক্ষা ক‌রে নি‌চ্ছি।

তাই না‌কি, রেজাল্ট কি কিছু পে‌য়ে‌ছ?

বললাম, দুটো কার্ড, একটা কা‌র্ডে ১০ ডলার পে‌য়ে‌ছি।

আবার প্রশ্ন, কত দি‌য়ে কার্ড কি‌নে‌ছ?

দুই ডলার।

বাহঃ ভালই‌ তো আট ডলার প্র‌ফিট!

এর ম‌ধ্যে গা‌ড়ি আরেকটা সার্ভিস স্টেশনের কাছে, হুমায়ুন ভাইয়ের ক‌ঠিন আদেশ, গা‌ড়ি থাম‌বে।

গা‌ড়ি থাম‌লো, আমি ১০ডলার ক্যাশ করলাম। দেখলাম হুমায়ুন ভাই কার্ড নি‌চ্ছেন, জান‌তে চাইলাম কয়টা, উত্তর ১০টা, বল‌লেন মাজহার, মাসুম, খোকন, কুসুম (শাওন ভাবী‌কে কুসুম ডা‌কেন) সবাই কার্ড কি‌নো।

শুরু হ‌লো কার্ড কেনা আর গা‌ড়ি‌তে উঠে কার্ড ঘষা! হুমায়ুন ভাই কার্ড ঘ‌ষে প্রথ‌মে নি‌জে দে‌খেন তারপর মাজহার দে‌খো‌তো, স্বাধীন দে‌খোতো। নিউইউর্ক থে‌কে নায়াগ্রা ফলস ১৩ ঘন্টার যাত্রা, আধা ঘন্টা পর পর সা‌র্ভিস স্টেশন, প্র‌তি‌টি স্টেশ‌নে আমরা থা‌মি টাকা ক্যাশ ক‌রি, আবার কি‌নি, গা‌ড়ি‌তে উঠে ঘ‌ষি, উনি আবার ব্যস্ত কার কত লাভ লোকসান। এভা‌বে পু‌রোটা যাত্রাপ‌থে চল‌ল কার্ড কাহিনি।

পৌঁছালাম নায়াগ্রা, স‌ন্ধে ৮টা বা‌জে। হো‌টেল খোঁজা‌খুঁজি, হো‌টে‌ল ঠিক করা হ‌লো নায়াগ্রা ফলসের পা‌শে, রুম থে‌কে দেখা যায়, ফলসের শব্দ শোনা যায়। যার যার রু‌মে যাওয়ার প‌থে ব‌লে দি‌লেন সবাই‌কে, হাত মুখ ধু‌য়ে দেরি না ক‌রে তাড়াতা‌ড়ি আমার রু‌মে আসো।

জ‌ড়ো হলাম উনার রু‌মে, বল‌লেন স্বাধীন লম্বা যাত্রাটা তোমার বদৌল‌তে ভালই কাট‌ল, কি ব‌লো সবাই? সবার হ্যাঁ সূচক উত্তর তারপর হিসাব, জানাম‌তে, মাজহার ভাই ছাড়া আমরা সবাই জি‌তে‌ছি কম‌বে‌শি।

যথারী‌তি আড্ডা হ‌লো, রাত্রিযাপন হ‌লো, প‌রের দিন ভোর! নাস্তা সে‌রে আমরা নায়াগ্রা ফলস দেখ‌তে যা‌বো, নীচে নাম‌বো। আমা‌দের সা‌থে যোগ হ‌লেন আরো দু’জন অতিথি কানাডা থে‌কে। নায়াগ্রা ফল‌সের পা‌শে ছোট একটা নদী, এপা‌শে আমে‌রিকা আর ওপা‌শে কানাডা, ছোট একটা সেতু দি‌য়ে কানাডা যাওয়া যায়। নায়াগ্রা ফল‌সে সারা‌দিন কাটা‌নোর পর ঠিক করা হ‌লো আমরা কানাডা পা‌রে যা‌ব, গি‌য়ে ক‌ফি খে‌য়ে আস‌ব কিন্তু বাধ সাধ‌ল ভিসা, পাস‌পোর্ট!

আমি ছাড়া হুমায়ূন ভাই, মাজহার ভাই, খোকন ভাই, শাওন ভাবী কাউ‌কে যে‌তে দেওয়া হ‌বেনা, কারণ বাংলা‌দেশী পাস‌পোর্ট, কানাডা যাওয়ার ভিসা নাই। শুধু আমি যে‌তে পার‌ব কারণ আমার বৃ‌টিশ পাস‌পোর্ট।

সবার মন খারাপ! হুমায়ূন ভাই আমা‌কে বল‌লেন স্বাধীন তু‌মি যাও, ঘু‌রে এসো। এর ম‌ধ্যে কানাডা‌ থে‌কে যোগ দেওয়া একজন অতি‌থি (সম্ভবত এলাহী ভাই) আমা‌কে নি‌য়ে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হ‌য়ে হুমায়ূন ভাই‌কে অনু‌রোধ জানা‌লেন। আমি বারবার না কর‌ছিলাম যে আমি একা যে‌তে চাই না।

হুমায়ুন ভাই খু‌শি ম‌নে আমা‌কে যাওয়ার অনুম‌তি দি‌লেন, আর বল‌লেন স্বাধীন যাও, যে‌তে পার‌লে তো আমরাও যেতাম। বল‌লেন, ওরা এত ক‌রে যখন বল‌ছে যাও আজ রা‌তে ওখা‌নে তা‌দের সা‌থে থা‌কো, কাল ভো‌রে নাস্তা ক‌রে চ‌লে এসো।

আমি সবার অনুম‌তি পে‌য়ে ‌নি‌জের ইচ্ছের বি‌রু‌দ্ধে ছোট সেতু পার হ‌য়ে কানাডা পা‌রে গেলাম!

ওপা‌রে গি‌য়ে প্রথ‌মে একটা ক‌ফি স‌পে ঢুকলাম ক‌ফি খাওয়ার জন্য।

ক‌ফি খাওয়া শেষ হয়‌নি, মাজহার ভাইয়ের ফোন!

কি মাজহার ভাই?

মাজহার ভাই ফিস ফিস ক‌রে কথা বল‌ছে, স্বাধীন আপ‌নি কতদূর গে‌ছেন?

না বেশি দূ‌রে না, কে‌ন?

আর যা‌বেন না, ফি‌রে চ‌লে আসেন প্লিজ!

জি‌গ্গ্যেস করলাম কী হ‌য়ে‌ছে?

উত্তর, হুমায়ূন ভাই মন খারাপ ক‌রে ব‌সে আছে, আমার ম‌নে হয় এভা‌বে আপনার যাওয়া ঠিক হ‌বেনা, য‌দিও উনি যে‌তে ব‌লে‌ছেন। আর বল‌ল, আমি ফোন কর‌ছি উনি জা‌নেন না।

আমি কিছু না ব‌লে ফোন কে‌টে দিলাম।

ফি‌রে আসলাম হো‌টে‌লে, দে‌খি হুমায়ূন ভাই একা ল‌বি‌তে ব‌সে আছেন। পেছন থে‌কে সালাম দিলাম, দেখলাম হুমায়ুন ভাইয়ের ভালবাসা মাখা‌নো হা‌সি, ছল ছল চোখ...‌কিন্তু আমার ফি‌রে আসা দে‌খে মো‌টেও অবাক না!

ছবি: লেখক