আমার পথচলা সব সময় নিঃসঙ্গ শেরপা’র পথচলা: ফারুকী

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নির্মাণে বরাবরই সরব। তার নতুন নির্মাণ মানেই নতুন আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘ডুব’  মুক্তির পর দেশজুড়ে তেমনই এক ঝড়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গ্লিটজের সঙ্গে সব প্রশ্নের  খোলামেলা উত্তর দিয়েছেন তিনি..

রুদ্র হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Nov 2017, 02:05 PM
Updated : 8 Nov 2017, 07:02 PM

গ্লিটজ: ডুব মুক্তির পর নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। নির্মাতা হিসেবে আপনার কাছে জানতে চাইব, কেন এমন হচ্ছে? ডুব আসলে কেমন ছবি? এর ম্যাজিকটা আসলে কোথায়?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : যে কোনো কারণে আপনি দেখবেন যে, আমার প্রথম ছবি থেকে শুরু করে, আমার ছবি সবসময় অপিনিয়ন ডিভাইডেড করে দেয়। আলোচনা সমালোচনার ঝড় ওঠে, আমি জানি। আমার মনে আছে ‘ব্যাচেলর’ যখন মুক্তি পায়, আমার চারপাশের বেশিরভাগ মানুষই বলেছিলো যে, আমি বাংলাদেশের সমাজটাকে ধ্বংস করে দিতে এসছি। তখন ডেইলি স্টার পত্রিকায় চিঠিপত্র কলামে প্রচুর চিঠি ছাপা হতো। প্রতিদিন বিভিন্ন চিঠি ছাপানো হতো। ‘ব্যাচেলর’যখন মুক্তি পায় তখন চিঠিপত্র পাতার অর্ধেকেরও বেশি জায়গা নিয়ে নিল ছবিটি। তার বেশিরভাগই একধরনের আক্রমণ এবং গালিগালাজে পরিপূর্ণ ছিলো। গালিগালাজ মানে ওই অর্থে গালিগালাজ না আক্রমণাত্মক ভাষা অর্থে বলছি। 

এরপর আমি করলাম ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। এটা নিয়েও মোটামুটি সমালোচনা হলো। ওটা খুব বেশি ওয়াইড রিলিজ হয়নি তাই সমালোচনাটাও খুব বেশি হয়নি।

এর পর আসলো ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’। আপনার মনে আছে বোধহয়, তখন তো সোস্যাল মিডিয়া ওইরকম অ্যাকটিভ বা পপুলার ছিল না বাংলাদেশে। কিন্তু আমার মনে হয়, এর চাইতেও (ডুব) বেশি আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছিল।

কিন্তু আমি কখনও এগুলোর দিকে তাকাই না। আমি তাকাই ভালোবাসার দিকে। আমি সবসময় তাকাই ইচ্ছুক মানুষদের দিকে। যারা আমার এই নতুন ভাষা, হতে পারে এ ভাষা কর্কশ, হতে পারে এগুলো  বিদঘুটে। কিন্তু এই বিদঘুটে এবং কর্কশ স্বরটাই যাদের ভালো লাগে, যারা ভালোবেসে আমাদের ছবিটা দেখেন, আমি তাদের দিকে তাকাই।

দর্শক বলতে  সর্বজনীন কোনো চেহারা নাই। আমি তো জানি, এমন কোনো ছবি বানানো সম্ভব না । আমার সব ছবি দেখেই লোকে বলে যে আমার সাধারণ দর্শকের জন্য ছবি বানানো উচিত।

তখন আমি বলি যে, দেখেন আমি যে ছবিগুলো বানাই তার দর্শকতো সাধারণই। তারা কি অসাধারণ দর্শক? যে মহিলা হিজাব মাথায় পরে সিনেমা দেখে এসে ক্যামেরার সামনে বলছেন, ওনার বুক ফেটে গেছে কান্নায়, সে তো সাধারণ মানুষই।

শাকিব খানের কথাই যদি ধরি, শাকিব খানের ছবি কি সব দর্শক দেখে? সে তো মেইনস্ট্রিম। সেটা হয়তো একটা বিশেষ শ্রেণিকে রিপ্রেজেন্ট করে। সকল ছবির, সকল আর্টের এমনকি সকল পণ্যেরও নিশ্চয়ই  নিজস্ব একটি ভোক্তা শ্রেণি আছে।

গ্লিটজ: ঝড়টা কেন ওঠে আসলে?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : ঝড়টা ওই জন্য ওঠে আসলে, যে তার পূর্বধারণার সাথে এটা মিলছে না। কিন্তু দর্শকের ভালো লাগা মন্দ লাগা দুইটাকেই আমি রেসপেক্ট করি।  কিন্তু এবার আমি একটা নতুন চিত্র দেখেছি।

 ‘ডুব’এর ক্ষেত্রে। সেটা খুব অ্যালার্মিং। দেশের সিনেমার জন্য কিংবা নতুন কিছুর জন্য। একটা হচ্ছে আপনার ভালো লাগছে-একটা হচ্ছে আপনার ভালো লাগছে না। এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আপনার ভালো লাগছে না বলে, আপনি একটা সংঘবদ্ধ দল নিয়ে বলছেন, প্লিজ ছবিটা দেখতে যাবেন না।

অর্থাৎ কারো ভালো লাগছে কি লাগছে না সেটার চেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে ক্যাম্পেইনটা ‘ প্লিজ ছবিটা দেখতে যাবেন না’।  এখন ধরা যাক, যারা এটা বলেছেন-তাদের যদি এটা খারাপও লাগে, আমার তখন বিনীত প্রশ্ন জেগেছে, আপনার যেটা খারাপ লাগবে, সেটা কেন আপনার ‘বেড়া’ দিতে হবে আরেকজন গিয়ে উপভোগ করার ক্ষেত্রে?। আপনার রুচি তো আরেকজনের ওপর চাপানোরা প্রয়োজন নাই। এটা দেখতে গিয়ে ওনার ভালোও লাগতে পারে, খারাপও লাগতে পারে।

এই যে আতঙ্কটা, দেখবেন না দেখবেন না, এটা কি ভালো লেগে যাওয়ার ভয় আছে? আতঙ্কটা কেন?

ঔচিত্যবোধের একটা অদ্ভুত সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, যেমন, আমি যেটা পছন্দ করি না সেটা তুমি করতে পারবা না প্লিজ!

এটাকেই তো বলে এক্সট্রিমিজম, এটাকে ধর্মীয় এক্সট্রিমিজমও বলে, লিবারালদের মধ্যেও আছে- আমার ভালো লাগছে না এটা তুমি করো না প্লিজ।  যে ছবি আমি দেখতে ভালোবাসি না সেটা তুমি দেখো না। এটা একধরণের ইনটলারেন্ট এনভায়রনমেন্টও ক্রিয়েট করবে। এবং এটা যে কোনো, শিল্পের বিকাশের জন্য ভালো না।

পাশাপাশি, আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই, প্রথম দিনের যে কো অর্ডিনেটেড হেট ক্যাম্পেইনটা হয়েছে বাংলাদেশের অনলাইনে, এই বেড়াটাকে ডিঙিয়ে, এ বেড়াটাকে ভেদ করে, যেসব সাধারণ মানুষ ছবিটা দেখতে গেছেন, এবং ছবি দেখে এসে ওনাদের ভালো লাগার কথা বলেছেন, কোথায় কোথায় তাদের হৃদয় স্পর্শ করেছে, কোথায় কোথায় তারা কেঁদেছেন,  কোথায় কোথায় তাদের হাহাকার লেগেছে, তাদের সবার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা, সবাইকে আমি সালাম জানাই।

গ্লিটজ: ব্যাপারটা কি এমন হয়ে গেছে ,যে,মানুষ একই সঙ্গে ফারুকীর হেটার্স এবং একই সঙ্গে তাকে ভালোওবাসে..

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : আমি জানি না আসলে। আমার পথচলা সবসময় নিঃসঙ্গ শেরপার পথচলা। যদি আপনি মনে করে দেখেন,আমার প্রথম থেকে, টিভি ফিকশনের যুগ থেকেই, আমার পথচলা সবসময়ই একলা পথচলা ছিল। আমার সঙ্গে সবসময় বাংলার দর্শকরাই পাশে ছিলেন। ইন্ডাস্ট্রি বা ক্রিটিকরা বা খুব বেশি মানুষ যাদের সংঘ আছে, শর্ট ফিল্ম ফোরাম বলেন বা পরিচালক সমিতি বলেন বা মেইনস্ট্রিম ঘরানা বা অমুক ঘরানা, আমি আসলে কারো সঙ্গেই খুব একটা সময় কাটাই না। ফলে তারা কখনও কখনও আমার ব্যাপারে অ্যালার্জিক ছিলেন। আমি জানি না এটা কেন।

ছবি: নয়ন কুমার

এটার কারণ খুঁজতে গিয়েও আমি সময় ব্যয় করতে চাইনি। কেউ যদি আমাকে ভালোবাসে, বলে আল্লাহ আপনাকে বাঁচায়া রাখুক, তখন আমার চোখ ভিজে যায়। কেউ যদি আমাকে পছন্দ না করে, আমি দুঃখ পাই, কিন্তু আমার কিছু বলবার থাকে না।

গ্লিটজ: ফিল্মের প্রসঙ্গে ফিরে আসি, আমরা দেখেছি যে আপনার ছবিগুলোর নাম একেক সময় একেকরকম হয়, ‘ব্যাচেলর’, ‘মেড ইন বাংলাদেশ’, ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’, ‘টেলিভিশন’। সর্বশেষ আপনার  ছবি ‘ডুব’। এই ‘ডুব’ নামটা আসলে কেন?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : ‘ডুব’ আসলে যোগাযোগহীনতার ছবি। ছবির চরিত্রগুলার মধ্যে যোগাযোগ নাই। বাবা মেয়েকে তার কথাটা বলতে পারছে না। মেয়ে বাবাকে তার কথাটা বলতে পারছে না। স্বামী প্রথম স্ত্রীকে বোঝাতে পারছে না, প্রথম স্ত্রী স্বামীকে বোঝাতে পারছে না, কেন তার রাগ লাগছে। দ্বিতীয় স্ত্রী স্বামীকে বিয়ে করেছে, দ্বিতীয় স্ত্রী তার স্বামীকে বোঝাতে পারছে না সে তো তার স্বামীকে ভালোবাসে, কিন্তু তার কী প্রয়োজন গোপনে চুরি করে তার জন্য আইপ্যাড নিয়ে যেতে, তাকে জানিয়ে গেলেই তো হয়-সে তো জানেই সব।

প্রত্যেকটা মানুষের সঙ্গে এই যে প্রত্যেকটা মানুষের যে যোগাযোগহীনতা, যোগাযোগহীনতাই এ ছবির নৈঃশব্দের ভাষা তৈরি করে দিয়েছে। আমি যে ছবিটার নাম ‘ডুব’ বলছি, এটি হলো অনন্ত নৈঃশব্দের সাগরে ‘ডুব’। অনন্ত বেদনার সাগরে ‘ডুব’। অনন্ত হাহাকারের সাগরে ‘ডুব’। ঠিক হাউমাউ কান্নার সাগরে না, একটা হাহাকারের সাগরে ‘ডুব’। চারটা চরিত্রই যেখাবে ডুবে আছে। অথবা পাঁচটা চরিত্র।

গ্লিটজ: সেই চার অথবা পাঁচ চরিত্রের মধ্যে চলচ্চিত্রটি যাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে,  একজন  নির্মাতা, জাভেদ, তার পরিবারের ক্রাইসিস, তার বহুগামী মন অথবা ব্যক্তিজীবনের অতৃপ্তির জায়গা থেকে হয়তো সে একটা নতুন সম্পর্কে যায়, এবং তার ফলে যে জটিলতাটা তৈরি হয়, সেখানে আমরা ডুব দিই।

কিন্তু সেখানে কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের জীবনের সঙ্গে মিলে যাওয়া কিছু ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যে আমাদের একজন  হুমায়ূন ছিলেন। সিনেমার প্রচারেও হুমায়ূনের প্রসঙ্গ এসেছে, কিন্তু আপনি তো একটা নতুন গল্প নতুন ভাষায় দেখাতে চেয়েছেন। সেখানে হুমায়ূনের উপস্থিতিটা কতটা জরুরি ছিল?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী :যেটা আমি প্রথম থেকেই বলে এসেছি, যে হুমায়ূন আহমেদের ইন্সপিরিশন বা যে কারোরই ইন্সপিরিশন এ ছবির ক্ষেত্রে থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। যদি ছবি দেখে কারো মনে হয় হুমায়ূনের জীবনের ইন্সপিরিশন আছে তাহলে আছে, যদি মনে করে নাই তাহলে নাই।

কিন্তু আমরা এটাকে দাবি করতে পারিনা এটা হুমায়ূন আহমেদের জীবনের সত্য ঘটনা। ফলে এ কারণে আমরা তো কোথাও বায়োপিক দাবি করিনি। আমি যদি বায়োপিক দাবি করি, আপনি বলতে পারেন যে, নীতু তো কখনো এভাবে দেয়াল টপকে যায়নি, আপনি কেন দেখিয়েছেন। সে কারণে আমিতো এটা দাবি করতে পারি না। ফলে আমি সেটা দাবি করিনি।

গ্লিটজ: একজন  সচেতন নির্মাতা হিসেবে, এ মিলে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাটা আসলেই ছিল কি ?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : মিলে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাটা কিন্তু তৈরি হয়নি, মিলে যায় কারণ গল্পটা এভাবে তৈরি হয় বলে। মেলাতে হবে বলে আমরা মিলিয়েছি বিষয়টা কিন্তু তা না।

গল্প তৈরি হয় কখন? গল্প তৈরি হয় যখন কিছু ঘটনা কিছু সময়, শিল্পীকে বেদনা দেয়, অথবা আনন্দ দেয় বা টর্চার করতে থাকে, শিল্পী তখন ওই বেদনা ওই আনন্দ ওই টর্চার ওই ইন্সপিরেশন নিয়ে ঘুমাতে পারেন না। এবং ঘুমাতে পারেন না বলেই শিল্পী তখন গল্পটা বানান।

এভাবে হুমায়ূন আহমেদও গল্প লিখতেন। পৃথিবীর সব গল্পকারই এভাবে গল্প লিখতেন। পৃথিবীর সব ফিল্মমেকারও এভাবে ফিল্ম লেখেন-এটাতো স্বাভাবিক, এটাতো এমন কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা না। পৃথিবীতে এটা প্রথম ঘটেছে তাও না।

গ্লিটজ: হুমায়ূনের কিছু ঘটনা কি আপনাকে নাড়া দিয়েছিল? তার প্রতিফলন কি এ সিনেমায় আছে?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : সেটা দেখে যদি মনে হয় আছে, তাহলে আছে। যদি মনে হয় নেই তাহলে নেই।

গ্লিটজ: আপনার নিজের কী মনে হয়?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : আমি এটা ক্লেইম করতে চাইনা এ কারণে, যে দেখুন ঋতুপর্ণ ঘোষের কি কখনো বলবার প্রয়োজন পড়েছে যে ‘আবহমান’ সত্যজিৎ রায়ের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত? মানে আপনি গল্পটা দেখবেন, দেখার পর আপনার যদি মনে হয় অনুপ্রাণিত তাহলে তো অনুপ্রাণিত বটেই।

যেটা পর্দায় আছে সেটাতো লুকানোর কিছু নাই। এটাতো প্রতারণার কিছু নাই। যেটা ওখানে আছে ওটা ওখানে আছেই। সেটা ওখানে গেলেই আপনি দেখবেন। শিল্পীর এটা বলবার প্রয়োজন নাই।

যেমন হুমায়ূণ আহমেদেরও বলবার প্রয়োজন পড়েনি উনি কোন গল্পের ইন্সপিরেশন কোন গল্প থেকে নিয়েছেন। যদি কখনো আমি আমার স্মৃতিকথায় বলবার প্রয়োজন মনে করি যে কোনোদিন কোনো রাতে বা কোনো বর্ষায়, তখন হয়তো লিখব। ইন্সপিরেশন বা গল্পের চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হলো ছবিটাতে আমি কী বলতে চেয়েছি বা কোন অনুভূতির কথা বলতে চেয়েছি।

গ্লিটজ: মুক্তির পর প্রতিক্রিয়া হিসেবে জানতে চাই, প্রচারণায় বা গল্পের উপাদান হিসেবে মিশে গিয়ে হুমায়ূনের প্রসঙ্গ আপনার চলচ্চিত্রের আসল অভিষ্টকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে কি ?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : ছবি মুক্তির আগে এ বিষয় নিয়ে আলোচনাটা কারো কারো ক্ষেত্রে ছবি দেখার স্বাদকে বাধাগ্রস্ত করতেও পারে। আমার হাতে যদি সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রণ থাকতো, পুরো সবকিছু যদি আমার নিয়ন্ত্রণে চলতো, তাহলে হয়তো আমি চাইতাম না ছবি মুক্তির আগে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হোক। এর বাইরে আমি আপাতত কিছু বলতে পারছি না।

গ্লিটজ: দর্শক এবং নির্মাতার সম্পর্কটা আসলে কেমন? নির্মাতা কি তার নির্মাণে দর্শকের কথা মাথায় রাখবেন ?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী :নির্মাতা তো দর্শকের কথা মাথায় রাখেন। কিন্তু এটা সচেতনভাবে না। এটা অবচেতনভাবে। এটা হয়তো তার কালেকটিভ আনকনসাশে থাকে, বা সাবকনসাশে থাকে। দর্শকের কথা মাথায় থাকে এ জন্য যে আমি আসলে কাকে কম্যুনিকেট করতে যাচ্ছি এটাতো আসলে ব্যাক অফ দ্য মাইন্ড মাথায় থাকেই। এটার কারণে নির্মাতা তার কণ্ঠকে পরিবর্তন করেন কিনা আমি জানি না। শিল্পী বোধহয় করেন না।

গ্লিটজ: আপনি বলছিলেন যে, প্রত্যাশার সংগে সংঘর্ষ করেই নতুন নির্মাণে যেতে হয়..

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী :ঠিক তাই..

গ্লিটজ: কেউ কেউ বলছেন ‘ডুব’ আপনার শ্রেষ্ঠ নির্মাণ..

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী :আমি যেটা বলেছি, আমাকে কেউ ভালোবাসা দিলে আমি শিশুর মতো আনন্দিত হই, কেউ অবজ্ঞা করলে দুঃখ পাই, দুঃখ পেয়ে তাকে কিছু বলতে চাই না। আস্তে করে সরে যাই। নিজের ব্যর্থতা নিয়ে নিজে থাকি।

যারা বলছেন এটা আমার সেরা কাজ, অনেকে বলছেন বাংলাদেশের সিনেমায় এটা নতুন ভিজ্যুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজের জন্ম দিয়েছে, অনেকে বলছেন। তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা, বড় ক্রিটিকরাও তাই বলেছেন-কৃতজ্ঞতা।

কিন্তু আমি আবারও বলছি, এ প্রশংসা বা এ নিন্দা কোনোটার দ্বারাই আমার পরবর্তী কণ্ঠস্বর নির্ধারিত হবে না। নিন্দার মুখে হয়তো আমি দৃঢ় উত্তর দেই, কিন্তু সেটা আমার অহংকার ভেবে ভুল করবেন না।

গ্লিটজ: ছবির চিত্রায়ন বেশ প্রশংসিত হয়েছে। দৃশ্যময়তার যে কাব্যিকরূপ আমরা ছবিটাতে দেখতে পাই তা নিয়ে আপনার অনুভবের জায়গাটা জানতে চাই। কোন দৃশ্যের প্রতি আপনার বিশেষ দুর্বলতা আছে কিনা?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : আমাকে অনেক দর্শক অনেক দৃশ্যের কথা বলেছে। কেউ বলেছে, ওই কাশবনের দৃশ্যটা-তিশা এবং প্রাচী আপার। বলেছে এ দৃশ্য তারা বহুদিন ভুলবে না। অনেকে বলেছে তাদের বুক হুহু করে উঠেছে। অনেকে বলেছে তারা নারী হিসেবে খুব শক্তি খুঁজে পেয়েছে সেখানে। অনেকে ড্রাইভিং সিকোয়েন্সের কথাও বলেছে- ‘ড্রাইভিংটাতো প্র্যাক্টিসে রাখা উচিত, স্টিয়ারিং ছেড়ো না।’ অনেকে ছেলের সঙ্গে বাবার দৃশ্যের কথাও বলেছে। অনেকে সাবেরীর পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়ার কথা বলেছে। অনেকে বলেছে-প্রাচী আপা যখন বলেন, ‘তুমি মারা গেছো শুনে আমি খুশী হইছিলাম’। সে দৃশ্যে অনেকেই কেঁদেছে বলেছে। অনেকে শেষ দৃশ্যে তিশা যখন কাঁদে তখন কান্না ধরে রাখতে পারেনাই বলেছে। সব দৃশ্যই আমার প্রিয়। এমনকি যে দৃশ্যে বাতাসে ঘাস নড়ছে, সেটাও আমার প্রিয় দৃশ্য। আমি আলাদা করে কোনোটা বলতে পারব না।

গ্লিটজ: নির্মাতার দৃষ্টিতে ‘ডুব’-এর মূল দর্শন যে সংলাপে ফুটে উঠেছে..

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : ছবির ফিলোসফি ক্যারি করে বোধ হয়- ‘মৃত্যু, ভালোবাসা মমতা সম্মান সব ফিরিয়ে দেয়’। ডেথ ইজ দ্য গ্রেট ইক্যুলাইজার। মৃত্যু সব সমান করে দেয়।

গ্লিটজ: অনেকেই বলছেন, এ ছবিতে ভারতের জনপ্রিয় অভিনেতা ইরফান খান থাকলেও এ ছবির হিরো মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। আপনার কাছেই জানতে চাই, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী চরিত্রটা আসলে কেমন?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : মোস্তফা সরয়ার ফারুকী আসলে নারকেলের মতো, বাইরেটা খুব শক্ত। ভেতরটা খুব নরম। এটা আশ-পাশ থেকে আমাকে যারা দেখে তারা বলতে পারবে। এটা আমার অ্যাসেসমেন্ট। অন্যরা আমার সম্পর্কে অন্যরকম অ্যাসেসমেন্ট করতে পারে। অ্যান্ড দে আর এনটাইটেলড টু ডু দ্যাট..

আর আমার পথ চলা, আমার বিকাশ..মাত্র তো শুরু। আমিতো আরও বহুদূর যাবো ইনশাল্লাহ..।এটাই আমার বিকাশের শেষ না।

কারণ, শিল্পকর্মটা হচ্ছে আসলে সেরকম, প্রতিদিন ওস্তাদ যেরকম সেতারে ইম্প্রোভাইজ করে, ফিল্মের ক্ষেত্রেও তো তাই। গল্পই আমাকে নতুন স্টাইল নতুন সুর তৈরি করতে বলবে। সেটা করতে করতেই তো এগোতে থাকবো।

কবরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ছবি বানানো চলবে। কবরে যাওয়ার পর ছবি বানানোর কোনো প্রক্রিয়া আছে কিনা আমার জানা নাই। যদি থাকে সেখানেও একই কাজ করবো ইনশাল্লাহ!

ফারুকীর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপে উঠে এসেছে ‘ডুব’ মুক্তি পরবর্তী নানা বিষয়ে দর্শক ও বোদ্ধামহলের সমালোচনার প্রসঙ্গগুলোও।সমালোচনা ও বিতর্কের জবাব দিতে গিয়ে উঠে এসেছে-নির্মাতার চিত্রনাট্য নির্মাণ পদ্ধতি, নির্মাণ কৌশল। কেমন ছিলো ‘ডুব’ নির্মাণে নির্মাতা ফারুকীর চিন্তা ও দর্শন। ভিডিও সাক্ষাৎকারে দেখুন সেইসব উত্তর..