নাট্যশিল্পী ঋত্বিক

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি ঋত্বিক ঘটকের জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার জিন্দাবাজারে । তার চলচ্চিত্র ভাবনা নিয়ে আলোচনা বিশ্বজুড়েই।  ৯২তম জন্মদিনে মঞ্চনাটকে তার ভূমিকা নিয়েই এই প্রতিবেদন ।

প্রদীপ করবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Nov 2017, 04:05 PM
Updated : 5 Nov 2017, 02:06 PM

“আমাদের দেশের অভিনেতাদের মঞ্চের প্রতি একটি বিশেষ পক্ষপাত আছে। বহুকালের ঘনিষ্ঠতা তার একটি কারণ। সেক্ষেত্রে ছবির অভিনয় আমরা দেখেছি চিনেছি অল্পকাল, ভালো করে তার প্রধান সমস্যাগুলো নিয়ে মাথা ঘামাইনি। বহু বিখ্যাত ও কৃতিত্ব সম্পন্ন মঞ্চ অভিনেতারা তাই এমন কথাও বলেন, চিত্রে অভিনয় নাকি আসল অভিনয় নয়; পরিচালকদের হাতে থাকে প্রায় সব স্বাধীনতা, তাঁরা যা খুশি করেন। আর অভিনেতাও তাঁদেরই হাতের অনেকটা যন্ত্রের মতোই।”

‘অভিনয়ে নব অধ্যায়’ শিরোনামে ঋত্বিক ঘটকের এ লেখা প্রকাশিত হয় কমলকুমার মজুমদার সম্পাদিত ‘চলচ্চিত্র’ পত্রিকায় ১৯৫০সালে। তখন ঋত্বিকের বয়স ২৫বছর। এই ১৯৫০ সালেই নিমাই ঘোষ পরিচালিত বাংলা সিনেমা ‘ছিন্নমূল’-এ অভিনেতা এবং সহকারী পরিচালকের কাজ করছেন ঋত্বিক।

তবুও উপর্যুক্ত লেখার অংশটি থেকে বুঝতে অসুবিধে হয়না ঋত্বিক সিনেমার চেয়ে মঞ্চ-নাটকের অভিনয়ের প্রতিই পক্ষপাত করতে চেয়েছেন।

কবিতা গল্প দিয়ে শুরু হলেও ঋত্বিক গণমানসে পরিচিত হয়ে ওঠেন নাট্যকর্মী হিসেবেই; বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠা তার অনেক পরে।

ঋত্বিক কুমার ঘটকের বাবা সুরেশচন্দ্র ঘটক জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হলেও কবিতা ও নাটক লিখতেন

নিয়মিত ভাবেই। মা ইন্দুবালা পিয়ানো বাজিয়ে গান গাইতেন। বড়ভাই মনীশ ঘটক ছিলেন খ্যাতিমান লেখক। বাড়িতে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার পরিবেশ ছিলোই।

মনীশ ঘটকের মেয়ে সাহিত্যিক মহাশ্বেতাদেবী পারিবারিক স্মৃতিকথায় বলছেন, “ও (ঋত্বিক) আমাদের বাড়িতে থাকতো। ভীষণ দুরন্ত আর দুষ্টু ছিল। খেলার পাশাপাশি অসম্ভব বই পড়তে ভালোবাসতো।

আমাদের খুব বড় পরিবার ছিল। পিসিদের উৎসাহে বাড়ির ছাদে চৌকি তুলে মঞ্চ তৈরি করা হতো। থিয়েটার করতাম সকলে।...”

রাজশাহীতে থাকাকালীন ছাত্রজীবনে নাট্যাভিনয়ের স্মৃতিকথা লিখেছেন ঋত্বিকের বন্ধু বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব কুমার রায়, “রাজশাহীর দিনগুলি সেই সূচনা পর্বে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় -আমাদের কাছে। রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’, ‘পরিত্রান’ দু’টি নাটক আমরা করেছি সেখানে। সেই পদ্মা নদী, নদীর বাঁধ, মাছ, নৌকো, সাধারণ মানুষ, ... আমাদের সংবেদনশীল মনে এই দেশ ভাগ, পদ্মা নদী চিরকালের একটা ছাপ ফেলে গেল। এসবের মধ্যে ওর মনটা থিতু হতে পারলনা। এই অ-স্থিত মনটাই যেন তার সকল কাজে প্রতীয়মান ছিল।"

প্রসঙ্গত, কলকাতার সুবিখ্যাত নাট্যদলের নাট্য নির্দেশক কুমার রায়কে ‘বহুরূপী’তে প্রথম নিয়ে গিয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক-ই।

বন্ধু ঋত্বিক সম্পর্কে কুমার রায় যে কথা বলেছেন দেশ বিভাগের যন্ত্রণা ঋত্বিককে অ-স্থির করেছিল, একথা আমরা সকলেই জানি, ঋত্বিক তার সারাজীবনের সৃজনে নির্মাণে সেই যন্ত্রণাকেই শিল্পরূপ দিয়েছেন।

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৪৭এর ভারত ভাগের ফল স্বরূপ অনেক অনেক পরিবারের সঙ্গে  ছিন্নমূল হয়ে ঘটক পরিবারও কলকাতায় চলে যেতে বাধ্য হয়।

নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করে শরণার্থী হিসেবে অন্যত্র বসবাসের যন্ত্রণা সারাজীবন ধরেই ঋত্বিককে তাড়িত করেছে।

সেই মর্মবেদনাই প্রতিভাত হতে দেখি তার সৃষ্টিসমগ্রে।

ঋত্বিকের বড়ভাই মনীশ ঘটক ছিলেন কল্লোল যুগের খ্যাতিমান কবি। সেইসূত্রেই বাড়িতে শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য্য, গোপাল হালদার, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের আসা যাওয়া ছিল নিয়মিত ভাবেই। এখান থেকেই ঋত্বিক ঘটকও যোগ দিলেন  ‘নবান্ন’ নাটকে, সদস্য হলেন আইপিটিএ-র ।

এইসময়েই নাট্যনির্মাণ এবং অভিনয়ে রীতিমত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’, বীরু মুখোপাধ্যায়ের ‘ঢেউ’, পানু পালের ‘ভাঙাবন্দর’ ইত্যাদি নাটকে তিনি উল্লেখযোগ্য অভিনয় করেন। ‘বিসর্জন’ নাটকে রঘুপতির চরিত্রে তার অভিনয় ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। নাট্যচক্রের ‘নীলদর্পন,’ শম্ভু মিত্র পরিচারিত ‘নবান্ন’ নাটক এবং উৎপল দত্ত নির্দেশিত ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে তার অভিনয় ছিল বহুল প্রশংসিত।

শুধুমাত্র মঞ্চনাটকে অভিনয় নয়, মৌলিক নাটক রচনাতেও তার ভূমিকা অনস্বীকার্য।

ঋত্বিক ঘটকের লেখা মৌলিক নাটক মাত্র পাঁচটি। জ্বালা, দলিল, সাঁকো, জ্বলন্ত এবং সেইমেয়ে।

তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন বেট্রোল্ট ব্রেশট-এর দ্য লাইফ অফ গ্যালিলিও অবলম্বনে ‘গ্যালিলিও চরিত্র’ এবং দ্য ককেশিয়ান চক সার্কল থেকে ‘খড়ির গন্ডি’। নিকোলাই গোগোল-এর গভর্নমেন্ট ইন্সপেক্টর অবলম্বনে ‘অফিসার’ এবং ম্যাক্সিম গোর্কির দ্য লোয়ার ডেপথস থেকে ‘নিচের মহল’।

‘জ্বালা’ ঋত্বিক ঘটকের লেখা প্রথম নাটক (১৯৫০)। এই সময় কলকাতা শহরে একমাসে একত্রিশ জন আত্মহত্যা করে। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য কীভাবে যন্ত্রণা কাতর মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিয়ে যায় এবং অসংখ্য মৃত্যুর মধ্য থেকে জীবনের উজ্জীবন এই নাটকের বিষয়। একত্রিশটি আত্মহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে নাট্যকারের বিক্ষুব্ধ রাগের প্রকাশ ঘটেছে ‘জ্বালা’ নাটকে।

নাটকটি কলকাতা বেতার কেন্দ্রে প্রচার হলে ভীষণই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। হিন্দি ভাষায় অনূদিত হয়ে পাটনা এবং দিল্লি বেতারেও সম্প্রচারিত হয়।

১৯৫৩ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পায় ঋত্বিকের দ্বিতীয় নাটক ‘দলিল’। এই নাটকে ‘পদ্মা’ চরিত্রে অভিনয় করে তৃপ্তি মিত্র সুনাম অর্জন করেন। এই নাটক প্রসঙ্গে ঋত্বিক লিখছেন, “পদ্মার স্রোতের মতোই বাস্তুচ্যুত বাঙালির ধারা এগিয়ে চলেছে এক অলঙ্ঘ্য পরিণতির দিকে।”

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ বাঙালির জনমানসে যে সুগভীর ক্ষত তৈরি করেছিল তারই নাট্যরূপ ঋত্বিক ঘটকের  ‘সাঁকো’ (১৯৫৫)। সাম্প্রদায়িক হানাহানি, মানুষে মানুষে মারামারি, বাঙালি হত্যা করছে আরেক বাঙালিকে এই দিয়ে নাট্যের সূচনা, অনুশোচনা, মর্মপীড়নের মধ্য দিয়ে গভীর উপলব্ধি, নিবিড় ভালোবাসায় নাটকের সমাপন।

১৯৫৫তেই ভারতীয় গণনাট্য সংঘ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন ঋত্বিক। একটু একটু করে জড়িয়ে পড়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাণে।

গণনাট্য সংঘ ছেড়ে দিলেও তিনি চিরকাল পাশে থেকেছেন বঞ্চিত, শোষিত, নিপীড়িত, ছিন্নমূল অসহায় মানুষের পাশেই। ‘নাগরিক’ (যদিও নির্মাণের ২৪বছর পর, ঋত্বিকের মৃত্যুর পর মুক্তি পেয়েছিল, তবুও এটিই ঋত্বিকের প্রথম নির্মাণ, ১৯৫২), ‘অযান্ত্রিক’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬৯), ‘কোমল গান্ধার’ (১৯৬১), ‘সুবর্ণরেখা’ (১৯৬২), ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ (১৯৭৪) এই সমস্ত নির্মাণেই ঋত্বিকের জীবন-দর্শন একই ধারায় প্রবাহিত।

যুক্তি তক্কো- র পরেপরেই বিষ্ণুপ্রিয়া নামে একটি ছবি তৈরির পরিকল্পনা থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এই বিষয় নিয়েই রচনা করলেন তার চতুর্থ নাটক ‘জ্বলন্ত’ (১৯৭৪) মাস্তানদের বীভৎসতার শিকার হয়ে একটি নিষ্পাপ মেয়ে কীভাবে অগ্নিকান্ডে শেষ হয়ে গেল তারই ‘জ্বলন্ত’ কাহিনি ।

১৯৭৫-এ কলকাতার একাডেমি অফ ফাইন আর্টসে প্রথম মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। এই নাটকের রচনা, সংগীত, মঞ্চ, আলো এবং পরিচালনা সমস্তই ঋত্বিক ঘটকের।

১৯৬৯এর জুলাই মাসে কিছু দিনের জন্য তিনি মানসিক অসুস্থতার কারণে ভর্তি ছিলেন মানসিক হাসপাতালে। হাসপাতাল থেকে ফিরেই লিখে ফেলেন নাটক ‘সেইমেয়ে’।

কলকাতার গোবরা মানসিক হাসপাতালের রোগীদের নিয়ে সেই নাটকের অভিনয়ও করেন। নাটকের একটি গানের সুর সংযোজন করেন পন্ডিত রবিশঙ্কর।

মানসিক হাসপাতালের চিকিৎসাধীন সন্তানহারা এক মায়ের বেদনার আলেখ্য ‘সেইমেয়ে’।

নাট্য পরিচালক হিসেবে ঋত্বিক ঘটক ছিলেন উল্লেখযোগ্য রকমের খ্যাতিমান। তার পরিচালিত নাটকের সংখ্যাও কম নয়-

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক ‘অচলায়তন’ অভিনয় ছাড়াও দৃশ্যপট নির্মাণ এবং পরিচালনা করেন। ‘ডাকঘর’ নাটকে নির্দেশনা, অভিনয়, আলো, মঞ্চ এবং আবহ সবই ছিল তার। তাঁর লেখা প্রথম মৌলিক নাটক ‘জ্বালা’তে নির্দেশনা ছাড়াও পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করেন। ‘সাঁকো’ নাটকে নির্দেশনার পাশাপাশি তসলিম মিঞার চরিত্রে অভিনয় করেন ঋত্বিক।

১৯৫৬তে ‘মুসাফির কে লিয়ে’ নামে একটি হিন্দি নাটকের নির্দেশক ছিলেন তিনি। ম্যাক্সিম গোর্কির এই নাটকটির অনুবাদ করেন গোবিন্দ মালি। অভিনয়ে ছিলেন এ, কে, হাঙ্গাল, গোবিন্দ মালি, বলরাজ সাহনি, বিমল দলভি প্রমুখ। নাটকটির সংগীত পরিচালনা করেন সলিল চৌধুরী।

“আমরা যখন মাঠে ময়দানে নাটক করতাম, তখন চার পাঁচ হাজার লোক জমা হতো, নাটক করে তাদের এক সঙ্গে rous করা যেত... ” বলছেন ঋত্বিক।

অধিক মানুষের কাছে তার বক্তব্য, তার ভাবনা পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ ছিল ঋত্বিকের। তাই কবিতা-গল্প ছেড়ে নাটক আবার নাটক থেকে বেরিয়ে সিনেমা-যা, “লাখ লাখ লোককে একসঙ্গে মোচড় দিতে পারে।”

অসংখ্য মানুষের কাছে কী বলতে চেয়েছিলেন তিনি?

অসহায় মানুষের অশ্রুর ইতিহাস। দেশ ভাগের ক্ষত, সাম্প্রদায়িক বিভেদ প্রভৃতির বিপ্রতীপে তিনি শুনিয়েছেন ভালোবাসার জয়গান । মানবতার অবক্ষয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার শিল্প ছিল প্রতিবাদের অন্যরূপ।

জীবনে যাপনে সৃজনে দর্শনে ঋত্বিক ঘটক সেই কারণেই এখনও অনন্য ।