তখন মনে হচ্ছিল, এটা পাকিস্তান: ফারুক

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য ছিলেন চিত্রনায়ক ফারুক। আটবছর বয়স থেকে কাজ করেছেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। তার ভাষণ শুনেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন একাত্তরে। ১৫ অগাস্ট শোক দিবসে সাইমুম সাদের কাছে স্মৃতির ঝাঁপি খুললেন এই অভিনেতা।

>>বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 August 2017, 01:35 PM
Updated : 15 August 2017, 04:14 PM

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম যেদিন দেখা হয় তখন উনি ‘বঙ্গবন্ধু’ ছিলেন না। সাধারণ একজন নেতা ছিলেন। তবে  খুব সাধারণও বলা যায় না। তাঁর ইতিহাস খুললে দেখা যায়, ব্রিটিশ আমল থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে গিয়েছিলেন উনি। ছোটবেলা থেকেই প্রতিবাদী ছিলেন। গরীব-দুঃখী মানুষের কথা বলতেন।

যখন উনি একদম ইয়াং আর আমি তখন খুব ছোট। মা মারা যাওয়ার পর আমি একটু বোহেমিয়ান টাইপের হয়ে গিয়েছিলাম। স্কুলে ফাঁকি দিয়ে রাস্তাঘাটে ঘোরাঘুরি করতাম। ঘুরতে ঘুরতে একদিন গুলিস্তান সিনেমা হলের দিকে গেলাম। মাইকে মিটিংয়ের আওয়াজ পেয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। দেখি তাঁর বক্তব্য কিছু মানুষ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছেন।

বক্তব্য ছিল এমন, ‘আমার দেশ, আমার মাটিতে আমরা বাংলায় কথা বলব।’ প্রথমদিনই তার বক্তৃতা আমার খুব ভালো লেগে গেল। এরপর থেকে প্রায়ই উনার বক্তব্য শুনতে গুলিস্তানে হাজির হতাম। আস্তে আস্তে উনার সঙ্গে পরিচিতি বাড়তে থাকে।

আমার সঙ্গে আরো কয়েকজন তখন মিটিংয়ে যেতেন। ওরা বলতো, ‘সিঙ্গারা খামু। নেতার কাছ থেকে টাকা লইস।’ একদিন বক্তৃতা শেষে নেতাকে ধরলাম, ‘আমাদের দিবেন না?’ উনি বললেন, ‘তোরা আবার কী চাস?’ বললাম, ‘কিছু খাবো। টাকা দেন।’ উনি দুই টাকা দিলেন। বললাম,  ‘দুই টাকায় হবে না।’ পরে দশ টাকা দিলেন।

এটা একটা মজার ঘটনা ছিল, প্রত্যেক দলেই কিছু কর্মী থাকে যারা টুপাইস কামাতো। আমিও সেই ধরনেরই ছিলাম। মিথ্যা কথা বলিনা, সত্যিই বলি সবসময়। ওই মুহূর্তে কর্মী কাকে বলে বুঝতাম না। পলেটিক্স কাকে বলে সেটাও ভালো জানতাম না। এই মজার ঘটনাগুলো জীবনেও ভুলব না।

আজকে আমি অভিনেতা ফারুক। তার স্নেহেই এই জায়গায় এসেছি আমি। তবে আমি যে টুকটাক অভিনয় করি সেটা কিন্তু শুরুতে এটা উনি জানতেনও না। অনেক পরে জেনেছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর।

পাকিস্তান আমলে ‘জলছবি’ নামে একটি সিনেমা করলাম। পরে ৬৮ শেষে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান শুরু হলো।

তারপর ৭১। যুদ্ধে গেলাম। স্বাধীনতার পর আমি একটা ছবির কাজ শুরু করি। সেটা বঙ্গবন্ধুকে জানাতেই গিয়েছিলাম রমনা পার্কের পাশের একটি সেমিনার হলে। দেখা হতেই উনি চিৎকার করে বললেন, ‘তুই নাকি রঙ মেখে ঢঙ শুরু করেছিস আবার?’

উনার কথা শুনে খুব ইমোশনাল হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, কী করি এখন! তার আগেই উনি হেঁটে কাছে এসে কাঁধে হাত রাখলেন। তাকিয়ে দেখি, মুচকি মুচকি হাসছেন। বললেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম চলচ্চিত্র। তুই এখানেই থাক। এখান থেকেই কিছু করবি ভবিষ্যতে। যদি কোনো অন্যায় অত্যাচার হয়, এখান থেকেই তুই কথা বলতে পারবি। পলেটিশিয়ানরা হাজার বার বললে যেটা হবে, সেটা তুই একবার বললেই হবে। আর এই আমি যদি কোনোদিন মানুষের সঙ্গে অন্যায় করি, তখন তো দেশের মানুষের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু তুই চলচ্চিত্রে বলতে পারবি।’

বঙ্গন্ধুকে ঘিরে এমন হাজারো স্মৃতি আছে আমার। বলে শেষ করতে পারবো না। শেষ করবো ১৫ অগাস্টের ঘটনা দিয়ে।

সেদিন রাত বারোটার দিকে গাড়িতে চেপে ক্যান্টনমেন্ট থেকে মগবাজারের দিকে যাচ্ছিলাম। রাস্তায় দেখলাম দু’তিনটা ট্যাঙ্ক যাচ্ছে। মনে একটু খটকা লাগল। বাসায় ফিরে সুজা ভাইকে বললাম, ‘বুঝলাম না রে ভাই। রাত্রের বেলা ট্যাঙ্ক কিসের?’ ও বললো, ‘নেতা ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে সকালে সেকারণে হতে পারে।’ বিষয়টি নিয়ে আর মাথা ঘামালাম না।

ঘুমভাঙলো ভোরবেলা। আমার কাছে এসে থরথর করে কাঁপছে সুজা। বলল, ‘রেডিও শোন। বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলছে। আমাদেরও মেরে ফেলবে। জলদি পালা।’ রেডিও অন করলাম। হত্যাকারীরা রেডিওতে বলেছে, ‘আমরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছি।’ সেইদিন ভয় লাগেনি খুব বেশি। কিন্তু পরেরদিন থেকে একটু চিন্তাভাবনা করে চলতে হয়েছে আমাদের। ডালিমরা তো আমারে মেরে ফেলার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজেছিল। কোনো কথা বলা যেত না।

ত্রিশ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে রাষ্ট্র স্বাধীনের পরও তখন মনে হচ্ছিল, এটা বাংলাদেশ না, পাকিস্তান।