বঙ্গবন্ধু নিঃস্বার্থভাবে দেশকে ভালোবাসতেন : ডলি জহুর

জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য ছিলেন অভিনেত্রী ডলি জহুর। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে তার সখ্যতা সেই ছোটবেলা থেকেই। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল তাঁর। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা তার খুব কাছের বন্ধু, পুত্র শেখ কামাল ডিপার্টমেন্টের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) বড়ভাই, আরেককন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘আপা’ বলে সম্বোধন করেন তিনি। ১৫ অগাস্ট শোক দিবসে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে ঘিরে স্মৃতির ঝাঁপি খুললেন ডলি জহুর।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 August 2017, 08:51 AM
Updated : 15 August 2017, 11:51 AM

গ্লিটজ: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার প্রথম সাক্ষাত কবে হয়েছিল?

ডলি জহুর: তখন তো বেশ ছোট ছিলাম। সেভাবে মনে করতে পারছি না। তবে প্রায়ই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসায় যাতায়াত ছিল। সেখানেই মূলত দেখা হত।

গ্লিটজ: ৩২ নম্বর বাসায় যাতায়াত শুরু কবে থেকে?

ডলি জহুর: স্কুললাইফে। রেহানার (শেখ রেহানা) সঙ্গে আমার খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল। ওর সঙ্গে মাঝে মাঝেই যেতাম। তবে সবচেয়ে বেশি গেছি জেলি আপার সঙ্গে। উনি ইডেন কলেজে পড়তেন। আমার সিনিয়র। খুবই ঠান্ডা প্রকৃতির মেয়ে। কথা খুব কম বলত। খুব আদর করতেন আমাকে। প্রায়ই বলতেন, ‘ডলি তোর কাজ আছে রে?’ বলতাম, ‘না নাই।’ উনি বলতেন, ‘চল ৩২ নম্বরে একটু যাবো।’

গ্লিটজ: বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে আপনার স্মরণীয় কোনো স্মৃতি...

ডলি জহুর: প্রায়ই বাসায় গিয়ে দেখতাম, উনি (বঙ্গবন্ধু) বাইরে বেরুচ্ছেন অথবা দুপুরে খাচ্ছেন। দেখা হলেই জিজ্ঞাসা করতেন, ‘কেমন আছিস?’ আমার তখন চুল বেশ লম্বা ছিল, বেণী করতাম। একদিন চুল ধরে আমাকে বললেন, ‘কীরে আসল না নকল?’ খুব মজার মানুষ উনি। সামনে যাকে পেতেন কখনো কথা না বলে অ্যাভয়েড করতেন না।

গ্লিটজ: উনি কী আপনার অভিনয় দেখেছেন কখনো?

ডলি জহুর:
তখনো আমি টিভিতে নাটক শুরু করিনি। তবে পাড়ার মঞ্চে পারফর্ম করতাম। গ্রীনরোডে ভূতের গলিতে বাৎসরিক অনুষ্ঠান হতো। বড় ভাইরা আয়োজন করতো। আমি নাচ কিংবা গান করতাম। ছাত্রলীগ থেকে অনুষ্ঠানে কামাল ভাইকে আনা হতো। উনিও (বঙ্গবন্ধু) থাকতেন অনুষ্ঠানে।

গ্লিটজ: বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামালকে আপনি বড়ভাই গণ্য করতেন। উনার সঙ্গে পরিচিতি কীভাবে?

ডলি জহুর: ওই যে পাড়ার অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতাম। কামাল ভাই সেখানে গেস্ট হিসেবে থাকতেন। সেখান থেকেই পরিচয়। তবে উনার সঙ্গে আরো ভালো পরিচিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে। সেবার খালাকে নিয়ে গেলাম ঢাবিতে ভর্তি হতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে দেখে কামাল ভাই বললেন, ‘ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে আইছিস? দেখি ফরম দেখি।’ ফরম নিয়ে বললেন, ‘আমার বোন আমার বিভাগ ছেড়ে অন্য বিভাগে-এটা হয় কোনদিন?’- বলেই ফরমটা ছিঁড়লেন। বললেন, ‘আয় আমার সঙ্গে।’ ওনার বিভাগ সমাজবিজ্ঞানে ভর্তি করে দিলেন।

গ্লিটজ: একসঙ্গে তো মঞ্চে কাজও করেছেন?

ডলি জহুর: হ্যাঁ। অনেক কাজই করেছি। এর মধ্যে বাংলা একাডেমিতে ‘নবান্ন’ নামে একটি মঞ্চনাটক করেছিলাম। তখন তো দিনকাল ভালো ছিল না। সন্ধ্যার পর কোথাও কোথাও কারফিউ দিয়ে রাখত। কামাল ভাই আমাকে রিক্সায় বাসায় নামিয়ে দিত। উনি যে প্রাইম মিনিস্টারের ছেলে একটা বোঝার উপায় ছিল না। খুবই সাধারণ ভাবে চলতেন।

গ্লিটজ: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও তো আপনার ভালো সম্পর্ক আছে...

ডলি জহুর: সেই সময়ে উনি (শেখ হাসিনা) জানতেন, আমি কোথায় থাকি, কী করি। আজিমপুর গার্লস স্কুলে প্রোগ্রাম হত, সেখানে আপার সঙ্গে দেখা হতো। উনি ডাকত, ‘এই মেয়ে!’ তার কাছে ধরা দিতাম না। আমি ভাবতাম, তুমি তোমার জায়গায়, আমি আমার জায়গায়। এগুলো দেখে অন্যরা অবাক হত। আমার এক বন্ধু বলে, ‘দোস্ত তুই এইরকম করিস কেন? নেত্রী তোকে ডাকে যাস না কেন?’ আমি বলি, ‘কেন? আমি কি রাজনীতি করব নাকি?’ অ্যাভয়েড করতাম। সবাই জানে উনার কাছে কখনোই যেতাম না গায়ে পড়ে। আমি আমার ক্ষেত্রে কাজ করে খাই। আমার দরকার কি পলেটিক্সে যাওয়ার? আমার কাছে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কার্ড আসে। কখনোই যাই না। অনেকে অবাক হয়। বলে যাস না কেনো? আমি বলি, ‘খামোখা কেনো যাবো?’ যাওয়ার লোক আছে। যারা যাওয়ার তারা যাবে। আমার ভালো লাগে না। আমি সবসময় নিজেকে আড়াল করে রাখতে ভালোবাসি।

গ্লিটজ: এবার আসি ১৫ অগাস্টে। সেদিনের ঘটনাটা আপনার কাছ থেকে জানতে চাই।

ডলি জহুর:
১৫ অগাস্ট আমাদের ইউনিভার্সিটির প্রোগ্রামে বঙ্গবন্ধুর থাকার কথা ছিল। ১৪ অগাস্ট দিনভর ডিপার্টমেন্ট (সমাজবিজ্ঞান) থেকে অনুষ্ঠানের যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েছিলাম আমরা। বঙ্গবন্ধু আমাদের প্রোগ্রামে আসবেন-সেটা অনেক বড় ব্যাপার। অনুষ্ঠানের জন্য আলাদা ড্রেস পেয়েছিলাম আমরা। মেয়েদের জন্য সবুজের মধ্যে লাল পেড়ে তাঁতের শাড়ি। ছেলেদের জন্য পাঞ্জাবি। ছেলে-মেয়েরা রিহার্সেল করলাম সারাদিন। বিকেলে কামাল ভাই এলো। বললেন, ‘কীরে তোরা এখনো যাসনি? সন্ধ্যা হয়ে গেল তো।’ আমরা চলে গেলাম। পরদিন অনুষ্ঠানে ফিরব বলে। ঘুমিয়ে গেলাম একটু আগেভাগেই। ভোরে ঘুম ভাঙল গুলির শব্দে।

গ্লিটজ: ভোরে কী ঘটলো?

ডলি জহুর: গ্রীনরোডের ভূতের গলির বাসায় ছিলাম আমরা। ঘরের ভেতরের খাট অবধি নড়ে উঠছে। এতো বোম্বিং হয়েছে। আব্বা ফজরের সময় নামাজে যাওয়ার জন্য উঠল। আব্বা বললেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে খুন করা হয়েছে।’ সবাই বেরুলাম রাস্তায়। হুলুস্থুল ব্যাপার। সেই সময়ে ভয়ানক পরিস্থিতি বলে বোঝানো যাবে না।

গ্লিটজ: এই সময়ে বঙ্গবন্ধুকে কতটা মিস করছেন?

ডলি জহুর: উনার মতো আর কেউ যদি থাকত তাহলে দেশের এই অবস্থা হত না। উনি দেশকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতেন, দেশের ভালো চাইতেন। আজ উনি নাই। কিন্তু ওনার মনমানসিকতার কেউ থাকলে অবশ্যই কিছু হত। উনি চলে গেলেন বলে আর কেউ তৈরি হবেন না? কেউই তো তৈরি হলো না। নিঃস্বার্থভাবে কেউই ভালোবাসলো না। সব স্বার্থের জন্য এলো। নিজের গদির চিন্তা করে, টাকা পয়সার চিন্তা করে। ব্যক্তিগত চিন্তা সব। দশের জন্য যদি কেউ চিন্তা করত সেটা উনিই করতেন।

গ্লিটজ: বঙ্গবন্ধু পরিবারের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতে চান…

ডলি জহুর: যারা মারা যায় তাদের জন্য যেমন দোয়া করি, বঙ্গবন্ধু পরিবারের জন্যও প্রাণভরে দোয়া করি। সবাইকে যেন আল্লাহ শান্তি দেই। আজকে যদি মানুষের দোয়া না থাকতো তাহলে এইরকম আগুনের মধ্যে বাস করে তাঁর (শেখ হাসিনা) বেঁচে থাকার কথা না। মানুষের দোয়া আছে বলেই সে আগুনের মধ্যেও বেঁচে আছে। মানুষ তো আর সারাজীবন বেঁচে থাকে না। একটা সময় তাকেও দুনিয়া থেকে চলে যেতেই হবে। কিন্তু যতদিন উনি বেঁচে আছেন ততদিন যেন আল্লাহ তাকে হেফাজতে থাকেন।