সালমান শাহ: রঙিন পর্দার রাজপুত্র

পারিবারিক নাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। চলচ্চিত্রে নাম লিখিয়ে হয়ে যান ‘সালমান শাহ’। ক্ষণজন্মা এই তারকার জীবনটাই একটা চলচ্চিত্রের মতো। তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা, অভিনয়জীবন থেকে আকস্মিক মৃত্যু নিয়েই এই প্রতিবেদন। 

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 August 2017, 01:21 PM
Updated : 14 August 2017, 02:16 PM

মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনে, ৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম। বাংলাদেশ ও সালমানের বয়স অনেকটাই কাছাকাছি। স্বাধীন বাংলাদেশে হাঁটি হাঁটি পা করে বেড়ে উঠেছেন। সিলেটের এক সবুজে ঘেরা গ্রামে ঘাস ফড়িংয়ের পেছনে ছুটেই কেটেছে দুরন্ত শৈশব। ছিলেন বেজায় ডানপিটে। ছোটবেলায় ক্রিকেটের প্রতি ছিল আলাদা ঝোঁক। মাঝে মধ্যে গানও করতেন পরিবারের বৈঠকি আসরে।

বেশিদিন সিলেটে থাকা হয়নি। খুলনায় এসে ভর্তি হন বয়রা মডেল হাইস্কুলে। পড়া শেষ হওয়ার আগেই চলে আসেন ঢাকায়। ধানমন্ডি আরব মিশন স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। মূলত স্কুলজীবনেই অভিনেতা হওয়ার পোকাটা মাথায় ঢোকে তার। বন্ধুরাও উৎসাহিত করেছিলেন।

স্ত্রী ও পরিবারের সঙ্গে

ছিলেন তুমুল আড্ডাবাজ। তাঁর উপস্থিতিতে গুমোট পরিস্থিতিও মুহূর্তেই পাল্টে যেত। অন্যদের অনুকরণ করতে পারতেন দারুণভাবে। প্রথমবারের মতো ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান আশির দশকের মাঝমাঝিতে। জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র একটি গানে মডেলিংয়ের মধ্য দিয়েই ছোটপর্দায় অভিষেক হয়েছিল তাঁর।

গানে একজন মাদকাসক্ত কিশোরের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপক হানিফ সংকেত তার ফেইসবুকে জানিয়েছেন, “সালমান শাহ, অকাল প্রয়াত এই অভিনয় শিল্পী তারকার দ্যুতি নিয়ে উজ্জ্বল করেছিলেন আমাদের চলচ্চিত্রের আকাশকে। এমনকি তার মৃত্যুর বহু বছর পর আজও চলচ্চিত্রের দর্শক তাকে তারকার মর্যাদাতেই স্মরণ করেন। ‘ইত্যাদি’র গানটিতে সালমানের সঙ্গে মা নীলা চৌধুরীও অভিনয় করেছেন।”

কেয়ামত থেকে কেয়ামত সিনেমার পোস্টার

সালমানকে নিয়ে তখন পত্রপত্রিকায় বেশ লেখালেখি হয়েছিলো। ‘ইমন নামের একটি বালক’ শিরোনামে বেশকিছু সংবাদের পেপারকাটিং এখনো দেখা যায় ফেইসবুকে। তখনই সহজাত অভিনয় দিয়ে জানান দিয়েছিলেন, আমি ফুরিয়ে যেতে আসিনি।

অল্প সময়েই পরিচালকদের নজরে আসেন। ‘পাথর সময়’ নামে একটি ধারাবাহিকে ডাক পান। এটিই তাঁর প্রথম নাটক। পরবর্তীতে ‘আকাশ ছোয়াঁ’ নামে আরো একটি নাটকে দেখা যায় তাকে। এরপর একে একে ‘দেয়াল’, ‘সব পাখি ঘরে ফিরে’, ‘সৈকতে সারস’, ‘পাথর সময়’ নাটকে অভিনয় করে পরিচিত পান। মাঝে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ধানমন্ডির মালেকা সায়েন্স কলেজ থেকে বি.কম পাস করেন।

ছোটপর্দায় টুকটাক কাজ করলেও তখনো বড়পর্দায় নাম লেখাননি। ‘তারকা’খ্যাতি পাওয়ার আগেই ১৯৯২ সালের ১২ আগস্ট বিয়ে করেন। স্ত্রী  সামিরা বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক উইকেটকিপার এবং অধিনায়ক শফিকুল হক হীরার মেয়ে।

কেমন ছিল সালমান-সামিরার সেই দিনগুলি?

সামিরার বরাত দিয়ে শফিকুল হক হীরা গ্লিটজকে জানালেন, “দু’জনের ছয়মাসের মতো প্রেম ছিল। বয়স আর কতোই হবে বাইশের মতো। একজন আরেকজনকে খুব ভালোবাসতো। আর সালমানকে নিয়ে সামিরা সবসময়ই গর্ববোধ করতো। শুটিংয়ের সেটে একসঙ্গেই থাকতো বেশিরভাগ সময়। প্রথম প্রেমকে কেউই ভুলতে পারে না, সামিরাও পারেনি। চারবছরের সংসার তাদের। চাইলেই ভুলে থাকা যায় না। এখনো ভীষণ মিস করে সালমানকে।”

স্ত্রী সামিরার সঙ্গে

বিয়ের পর ঢাকাতেই সংসার পেতেছিলেন সালমান-সামিরা। শ্বশুরবাড়ি চট্টগ্রামে মাঝে মধ্যেই বেড়াতে যেতেন। শ্বশুরের সঙ্গে তার বোঝাপড়াটা দারুণ ছিল।

সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে হীরা বললেন, “সালমানের ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁক ছিল। মিডিয়াম পেস বোলিং করতে পারত দারুণ। মাঝে মধ্যেই দু’জন ক্রিকেট খেলতাম। সালমান আমার কাছে বায়না ধরেছিল চিটাগাং ক্লাবে খেলবে। কিন্তু আমি তাকে সুযোগ দিতে পারিনি। কারণ তখন ক্লাব সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল না।”

শাহরুখ খানের সঙ্গে

তবে সালমানের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় চমকটা আসে নির্মাতা সোহানুর রহমানের হাত ধরে। সেই সময়ের জনপ্রিয় হিন্দি চলচ্চিত্র ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’-এর বাংলায় পুনঃনির্মাণের কপিরাইট কিনে নেন সোহান। সিনেমার জন্য তৌকির আহমেদকে অফার করা হলে তিনি রিমেক করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন। সেকারণে নতুন মুখ খুঁজছিলেন পরিচালক। সেই ছবিতে সালমানকে কাস্ট করেন।

সালমানকে কিভাবে খুঁজে পেলেন?

সোহান গ্লিটজকে বললেন, “চিত্রনায়ক আলমগীরের স্ত্রী খোশনূর আমাকে ইমনের কথা জানিয়েছিলেন। প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে যায় ওকে। তবে ওর নামটা ইমন থেকে পরিবর্তন করে সালমান শাহ করি।”

তাঁর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞাতাও জানালেন সোহান, “নতুন হলেও চরিত্রটা ঠিকঠাক মতো রিড করতে পেরেছিলো। আমি যেমনটা চেয়েছি তেমনই অভিনয় করে গেছে। আর সর্বদা ও খুব হাস্যোজ্জ্বল ছিল।”

সোহানের ভাষ্যে, “সালমানের মৃত্যুর পর তার শূন্যতা আজও পূরণ হয়নি। তিনি আমাদের সিনেমার জন্য সম্পদ। কখনো তার বিকল্প কাউকে পাবো না আর আমরা।”

সহকর্মী মৌসুমীর সঙ্গে সিনেমার শুটিংয়ে

ছবিটিতে জুটি বেঁধেছিলেন মৌসুমীর সঙ্গে। মুক্তি পাওয়ার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। দেশজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন।

এরপর ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘দেনমোহর’, ‘তোমাকে চাই’, ‘বিক্ষোভ’, ‘বিচার হবে’, ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘আশা ভালবাসা’, ‘জীবন সংসার’, ‘মহামিলন’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘এই ঘর এই সংসার’, ‘আঞ্জুমান’সহ মোট ২৭টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। অধিকাংশ সিনেমাই দারুণ দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল।

বেশিরভাগ সিনেমায় মৌসুমী ও শাবনূরের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি।

সহকর্মী শাবনূরের সঙ্গে সিনেমার শুটিংয়ে

শাবনূর গ্লিটজকে জানালেন, “দারুণ বন্ধুবৎসল ছিলেন উনি। আমি তাকে বড়ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করতাম। উনি আমাকে ছোটবোন মনে করতেন। ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতেন। ওনার শূন্যতা কখনোই পূরণ হবার নয়।”

আরেক অভিনেত্রী মুনমুন ফেইসবুক স্ট্যাটাসে স্মৃতিচারণা করেছেন, “সালমান ভাইয়ের সাথে আমার কিছু মজার স্মৃতি আছে। তিনি অনেক চঞ্চল ছিলেন। যেন ছোট্ট শিশুর মতো। তার কোনো অহংকার ছিল না। আমার মতো নতুন নায়িকাকেও আনন্দের সাথেই স্বাগত জানিয়েছিলেন।”

জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা অবস্থায় ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মৃত্যু হয় তাঁর। রাজধানী ঢাকার ইস্কাটনে তাঁর নিজ বাস ভবনে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় তাঁর লাশ পাওয়া যায়। ময়না তদন্ত রিপোর্টে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হলেও তাঁর মৃত্যু নিয়ে রহস্য এখনো কাটেনি।