প্রাঙ্গনে মোর রবীন্দ্রনাথ

মঞ্চেই কেটেছে তার প্রায় তিনযুগ। রবীন্দ্রনাথের প্রেমে পড়েছিলেন সেই ছোটবেলাতেই। সেই প্রেমের পরিণতি পেলো নির্দেশনায় এসে। ‘প্রাঙ্গনেমোর’ নাট্যদলের হয়ে চারটি রবীন্দ্র-নাটক নির্দেশনা দিয়েছেন অভিনেত্রী ও নির্দেশক নূনা আফরোজ। বিশ্বকবির ৭৬তম প্রয়াণদিবসে লিখলেন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তার নাট্যভ্রমণের গল্প।

নূনা আফরোজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 August 2017, 02:54 PM
Updated : 6 August 2017, 04:00 PM

খুব ছোটবেলা আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে একজন ‘বাঁশীওয়ালা’ কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলো।  কবিতাটি শুনে আমার এতো ভালো লেগেছিলো যে বুঝে না বুঝে রবীন্দ্রনাথকে ভালবেসে ফেলেছিলাম। সেই থেকে মানে পঞ্চম শ্রেণি থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’ আমার নিত্যসঙ্গী। তারপর একটু একটু করে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, এমনকি গানও পড়তে শুরু করলাম। যেখানে যা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লেখা পেতাম, পড়ে ফেলতাম। খুব বুঝে পড়েছি বলবো না কিন্তু কেমন যেন একটা দুর্বার আকর্ষণ বোধ করতাম।

এরপর থিয়েটারের সাথে যুক্ত হলাম স্কুল জীবনেই, ১৯৮৭ সালে।

স্বদেশী

দীর্ঘ কয়েক বছর অভিনয় করার পর যখন নির্দেশনার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম তখন কী নাটক নির্দেশনা দেবো ভাবছিলাম কিন্তু ঘুরে ফিরে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। অবশেষে ‘চার অধ্যায়’ ঠিক করলাম। কিন্তু নাট্যরূপ? নাট্যরূপ দেবে কে? প্রথম নির্দেশনা ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড উত্তেজনা কাজ করছে, কাকে দেবো নাট্যরূপ দিতে সে আবার কতটা দেরি করবে কে জানে। তর সইছিলোনা। সাহস করে নিজেই নাট্যরূপ দিয়ে ফেললাম।

মঞ্চে এলো ২০০৫ এর ২ অক্টোবর। ভয় ছিলো মনে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কাজ। কে কী বলেন আল্লাহ্‌ই  জানেন। তা ছাড়া শম্ভু মিত্র ছাড়া ‘চার অধ্যায়’খুব একটা মঞ্চসফল কারো হাতে হয়নি বলে শোনা যায়, সে ভয়টাও মনে ছিল।

যাক, ২০০৫ এর ২ অক্টোবর ‘চার অধ্যায়’ ‘স্বদেশী’ নামে মঞ্চে এলো, প্রশংসিত হল। প্রাঙ্গনেমোর-এর এত ভালো নাটকের ভীড়ে এখনো অনেক দর্শক বন্ধুদের বলতে শুনি ‘স্বদেশী’ নাটকের মত ওয়েল অ্যাক্টেড নাটক কম আছে। শুনি-ভালোই লাগে কিন্তু আমাদের এতো নাটকের ভীড়ে ‘স্বদেশী’ নাটকের প্রদর্শনী আর সম্ভব হয়ে ওঠেনা।

দু’বছর বাদে আবার দল থেকে দায়িত্ব অর্পণ হলো নাটক নির্দেশনা দেবার। এবার কি নির্দেশনা দেই ভেবে কূল পাই না। ঘুরে ফিরে রবীন্দ্রনাথতো আমার মাথা থেকে যায় না। সিদ্ধান্ত নিলাম ‘রক্তকরবী’ করবো। সুপ্ত বাসনাও ছিলো নন্দিনী করবার। নন্দিনী একটি আলোর দূত বহনকারী চরিত্র। সভ্যতা, মানবিকতা, বিদ্রোহ ও প্রতিবাদ করার দুর্দমনীয় সাহস এই নন্দিনী চরিত্রটির। নন্দিনী একটি সর্বকালের সর্বজনীন চরিত্র।

রক্তকরবী

বিশ্বসেরা নাট্যকার শেক্সপিয়ারের ‘হ্যামলেট’ যেমন। সকল সময় সকল দেশে সকল কালে শিক্ষিত ও পরীক্ষিত সকল অভিনেতা নিজেকে প্রমাণ করার শেষ চরিত্র ‘হ্যামলেট’, ঠিক তেমনি নন্দিনীও সর্বকালের সকল শিক্ষিত ও পরীক্ষিত অভিনেত্রীর নিজেকে প্রমাণ করবার শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার।

তাছাড়া আমার নিজ দলে রাজা করবার মত শক্তিশালী অভিনেতা রয়েছে অনন্ত হীরা, বিশু পাগল করবার মত শক্তিশালী অভিনেতা রামিজ রাজু, ফাগুলাল করবার মত মামুন বা রিগ্যান এবং চন্দ্রা করবার মত চৈতালি সমদ্দার বা শুভেচ্ছা, আমাকে আর রক্তকরবী করতে ঠেকায় কে।

ভয়ে ভয়ে মঞ্চে এলো ২০০৮ এ। এবং দেশে বিদেশে বহুল প্রশংসিত হলো বলতে ইচ্ছ করছে সকল বাঙালির প্রাণের শিল্পী কিংবদন্তি বাংলা গানের শিল্পী মান্না দে ‘রক্তকরবী’ দেখে সস্ত্রীক মঞ্চে উঠে এসেছিলেন। নাটকের এবং গানের খুব প্রশংসা করেছিলেন। আত্মবিশ্বাস কিছুটা বেড়েই গেলো।

মান্না দে ও রক্তকরবী’র শিল্পীরা

তৃতীয় নির্দেশনাও রবীন্দ্রনাথই, ‘শেষের কবিতা’। নাট্যরূপ দিলো বন্ধু শিল্পসঙ্গী অনন্ত হীরা। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কাজ করার সাহস একটু বেড়ে গেলেও ‘শেষের কবিতা’ নিয়ে অন্যরকম একটা ভয় কাজ করছিলো কারণ ‘শেষের কবিতা’ একটি উপন্যাস এবং বহুল পঠিত একটি উপন্যাস।

পাঠক যখন পড়েন তখন তার ভাবনার গতি কেউ রোধ করতে পারেনা বা কল্পনার পথে ডানা মেলতেও বাধা থাকে না। এই পাঠক যখন দর্শক হবেন তখন আমি কয়েক ফিট বাই কয়েক ফিট মঞ্চে কীভাবে তৃপ্ত করবো যে পাঠক কল্পনায় শিলং পাহাড় আগেই ঘুরে এসেছে বা ভালোবাসার এবং কষ্টের বন্যায় যে আগেই ভেসেছে।

যাক, ভেবেছি যখন করতে তো হবেই। কলকাতার সৌমিত্র মিত্র তাঁদের দেশ বিদেশের নাট্যমেলাতে আমাদের ‘শেষের কবিতা’ নাটকের উদ্বোধনী প্রদর্শনী করবার আমন্ত্রণ জানালেন। ২০১১ এর ২৬ আগষ্ট কলকাতার মধুসূদন মঞ্চে মঞ্চায়ন হলো ‘শেষের কবিতা’।

শেষের কবিতা

অনেক গণ্যমান্য দর্শকের মধ্যে যাদের নাম না বললেই নয় তাঁরা ছিলেন বাংলাদেশের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তী, ঊষা গাঙ্গুলিসহ আরও অনেকে। আমি ভাবতেই পারিনি ‘শেষের কবিতা’ এতটা প্রশংসিত হবে যা আমার কল্পনার অতীত ছিল। দ্বিতীয় প্রদর্শনী করলাম ২৮ আগষ্ট ২০১১ তীর্থস্থান রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের লিপিকা মঞ্চে। দর্শক বন্ধুরা আমাদের প্রশংসার বন্যায় ভাসালেন। শুধু তাই নয়, মুম্বাইয়ের দর্শকও ফিরিয়ে দেননি আমাদের। তাঁদের প্রাণঢালা ভালোবাসা আমাদের অন্যরকম আনন্দে মাতালো।

২০১৪, এবার?এবার আমি কি করবো?

রবীন্দ্রনাথের বাইরে ভাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুই মনে ধরাতে পারছি না। দিন যায়, মাস যায়, নাহ! কিছুই ভাবতে পারছি না। কী করি! কী করি!

একদিন তিন বন্ধু মিলে শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি দেখতে গেলাম। নিছক দেখে বেড়ানোই উদ্দেশ্য। কিন্তু এখানেই ঘটে গেলো আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘটনা। কুঠিবাড়ি ঢুকেই আমার ভেতরে কেমন একটা ঘোর কাজ করছিলো।

আমি ও রবীন্দ্রনাথ

সময়টা সন্ধ্যা হয়, বাইরে তুমুল বৃষ্টি। কোনো দর্শনার্থী নেই। আমরা তিন বন্ধু শুধু। অতি উৎসাহী আমি বন্ধুদের ফেলেই দোতলায় সিঁড়ি দিয়ে একাই উঠে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেলো। যেন দেখলাম রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং উপরের সিঁড়িতে দাঁড়ানো। হাত বাড়িয়ে আহ্বান করছেন আমাকে।

সেই মুহূর্তের অনুভূতি আমি বলে, লিখে বোঝাতে পারবো না। যাই হোক, সেই মুহূর্তের অনুভূতির ওপর ভর করেই লিখে ফেললাম ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’। নির্দেশনাও দিলাম। ২০১৬’র ১১ ফেব্রুয়ারি মঞ্চে এলো। প্রশংসিত হলো, হচ্ছে। একটি দৈনিকে নাট্যজন মাসুম রেজা রিভিউতে লিখলেন ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’ বাংলা নাট্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

বাংলাদেশ ও ভারতে প্রশংসিত হচ্ছে, দিল্লির বাঙালি ও অবাঙালি দর্শক ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’ দেখে আবারও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আসছে ১৬ ডিসেম্বর প্রদর্শনী করবার জন্য। দর্শক ভালেবাসা বা প্রশংসা তো যেকোনও সৃজনশীল কাজকে বাঁচিয়ে রাখবার অক্সিজেন ও নতুন কাজ করবার প্রেরণা। কিন্তু মানস সরোবরে যে রবীন্দ্রনাথ জীবন্ত ভাসেন সেতো আমার প্রতিদিনের প্রতিক্ষণের অক্সিজেন।

নূনা আফরোজ, অভিনেত্রী ও নাট্যনির্দেশক, প্রাঙ্গনেমোর নাট্যদল