খুব ছোটবেলা আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে একজন ‘বাঁশীওয়ালা’ কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলো। কবিতাটি শুনে আমার এতো ভালো লেগেছিলো যে বুঝে না বুঝে রবীন্দ্রনাথকে ভালবেসে ফেলেছিলাম। সেই থেকে মানে পঞ্চম শ্রেণি থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’ আমার নিত্যসঙ্গী। তারপর একটু একটু করে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, এমনকি গানও পড়তে শুরু করলাম। যেখানে যা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লেখা পেতাম, পড়ে ফেলতাম। খুব বুঝে পড়েছি বলবো না কিন্তু কেমন যেন একটা দুর্বার আকর্ষণ বোধ করতাম।
এরপর থিয়েটারের সাথে যুক্ত হলাম স্কুল জীবনেই, ১৯৮৭ সালে।
মঞ্চে এলো ২০০৫ এর ২ অক্টোবর। ভয় ছিলো মনে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কাজ। কে কী বলেন আল্লাহ্ই জানেন। তা ছাড়া শম্ভু মিত্র ছাড়া ‘চার অধ্যায়’খুব একটা মঞ্চসফল কারো হাতে হয়নি বলে শোনা যায়, সে ভয়টাও মনে ছিল।
যাক, ২০০৫ এর ২ অক্টোবর ‘চার অধ্যায়’ ‘স্বদেশী’ নামে মঞ্চে এলো, প্রশংসিত হল। প্রাঙ্গনেমোর-এর এত ভালো নাটকের ভীড়ে এখনো অনেক দর্শক বন্ধুদের বলতে শুনি ‘স্বদেশী’ নাটকের মত ওয়েল অ্যাক্টেড নাটক কম আছে। শুনি-ভালোই লাগে কিন্তু আমাদের এতো নাটকের ভীড়ে ‘স্বদেশী’ নাটকের প্রদর্শনী আর সম্ভব হয়ে ওঠেনা।
দু’বছর বাদে আবার দল থেকে দায়িত্ব অর্পণ হলো নাটক নির্দেশনা দেবার। এবার কি নির্দেশনা দেই ভেবে কূল পাই না। ঘুরে ফিরে রবীন্দ্রনাথতো আমার মাথা থেকে যায় না। সিদ্ধান্ত নিলাম ‘রক্তকরবী’ করবো। সুপ্ত বাসনাও ছিলো নন্দিনী করবার। নন্দিনী একটি আলোর দূত বহনকারী চরিত্র। সভ্যতা, মানবিকতা, বিদ্রোহ ও প্রতিবাদ করার দুর্দমনীয় সাহস এই নন্দিনী চরিত্রটির। নন্দিনী একটি সর্বকালের সর্বজনীন চরিত্র।
তাছাড়া আমার নিজ দলে রাজা করবার মত শক্তিশালী অভিনেতা রয়েছে অনন্ত হীরা, বিশু পাগল করবার মত শক্তিশালী অভিনেতা রামিজ রাজু, ফাগুলাল করবার মত মামুন বা রিগ্যান এবং চন্দ্রা করবার মত চৈতালি সমদ্দার বা শুভেচ্ছা, আমাকে আর রক্তকরবী করতে ঠেকায় কে।
ভয়ে ভয়ে মঞ্চে এলো ২০০৮ এ। এবং দেশে বিদেশে বহুল প্রশংসিত হলো বলতে ইচ্ছ করছে সকল বাঙালির প্রাণের শিল্পী কিংবদন্তি বাংলা গানের শিল্পী মান্না দে ‘রক্তকরবী’ দেখে সস্ত্রীক মঞ্চে উঠে এসেছিলেন। নাটকের এবং গানের খুব প্রশংসা করেছিলেন। আত্মবিশ্বাস কিছুটা বেড়েই গেলো।
পাঠক যখন পড়েন তখন তার ভাবনার গতি কেউ রোধ করতে পারেনা বা কল্পনার পথে ডানা মেলতেও বাধা থাকে না। এই পাঠক যখন দর্শক হবেন তখন আমি কয়েক ফিট বাই কয়েক ফিট মঞ্চে কীভাবে তৃপ্ত করবো যে পাঠক কল্পনায় শিলং পাহাড় আগেই ঘুরে এসেছে বা ভালোবাসার এবং কষ্টের বন্যায় যে আগেই ভেসেছে।
যাক, ভেবেছি যখন করতে তো হবেই। কলকাতার সৌমিত্র মিত্র তাঁদের দেশ বিদেশের নাট্যমেলাতে আমাদের ‘শেষের কবিতা’ নাটকের উদ্বোধনী প্রদর্শনী করবার আমন্ত্রণ জানালেন। ২০১১ এর ২৬ আগষ্ট কলকাতার মধুসূদন মঞ্চে মঞ্চায়ন হলো ‘শেষের কবিতা’।
২০১৪, এবার?এবার আমি কি করবো?
রবীন্দ্রনাথের বাইরে ভাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুই মনে ধরাতে পারছি না। দিন যায়, মাস যায়, নাহ! কিছুই ভাবতে পারছি না। কী করি! কী করি!
একদিন তিন বন্ধু মিলে শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি দেখতে গেলাম। নিছক দেখে বেড়ানোই উদ্দেশ্য। কিন্তু এখানেই ঘটে গেলো আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘটনা। কুঠিবাড়ি ঢুকেই আমার ভেতরে কেমন একটা ঘোর কাজ করছিলো।
সেই মুহূর্তের অনুভূতি আমি বলে, লিখে বোঝাতে পারবো না। যাই হোক, সেই মুহূর্তের অনুভূতির ওপর ভর করেই লিখে ফেললাম ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’। নির্দেশনাও দিলাম। ২০১৬’র ১১ ফেব্রুয়ারি মঞ্চে এলো। প্রশংসিত হলো, হচ্ছে। একটি দৈনিকে নাট্যজন মাসুম রেজা রিভিউতে লিখলেন ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’ বাংলা নাট্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
বাংলাদেশ ও ভারতে প্রশংসিত হচ্ছে, দিল্লির বাঙালি ও অবাঙালি দর্শক ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’ দেখে আবারও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আসছে ১৬ ডিসেম্বর প্রদর্শনী করবার জন্য। দর্শক ভালেবাসা বা প্রশংসা তো যেকোনও সৃজনশীল কাজকে বাঁচিয়ে রাখবার অক্সিজেন ও নতুন কাজ করবার প্রেরণা। কিন্তু মানস সরোবরে যে রবীন্দ্রনাথ জীবন্ত ভাসেন সেতো আমার প্রতিদিনের প্রতিক্ষণের অক্সিজেন।
নূনা আফরোজ, অভিনেত্রী ও নাট্যনির্দেশক, প্রাঙ্গনেমোর নাট্যদল