একটি শবযাত্রার চলমান দৃশ্য দিয়ে শুরু হয় তথ্যচিত্রটি। লোকে লোকারণ্য কলকাতার রাজপথ। ফুলে ফুলে আচ্ছাদিত শবযাত্রা চলছে শ্মশানের দিকে। পুড়ে যাচ্ছে নশ্বর দেহ। রবীন্দ্রনাথের শেষকৃত্য চলছে। চিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নশ্বর মানবদেহ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও অবিনশ্বর তার সৃষ্টি, চিরদিন তা বেঁচে থাকবে বিশ্বে। এই অসাধারণ সূচনার পর দেখা যায় টাইটেল।
তথ্যচিত্র শুরু হয় হাতে আঁকা কিছু ছবি দিয়ে। জোব চার্নকের প্রতিষ্ঠিত সে যুগের কলকাতার খণ্ড খণ্ড ছবি। উত্তর কলকাতার চিৎপুরে জোড়াসাঁকোর প্রাসাদ।
রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে বলা হয়, কনৌজ থেকে বাংলায় আসা ব্রাহ্মণ যারা ৮ম শতাব্দীতে বাংলার জনজীবনে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তাদেরই উত্তরসূরী পঞ্চানন ঠাকুর কোম্পানির আমলে কলকাতায় ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠা পান। পঞ্চানন ঠাকুরের পৌত্র নীলমণি ঠাকুর এবং নীলমণি ঠাকুরের পৌত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর যিনি রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদাদা।
দ্বারকানাথের পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার পিতামহীর মৃত্যুর পর অধ্যাত্মিক ভাবনায় নিমগ্ন হন। তিনি হিন্দু ধর্মসংস্কার করে ব্রাহ্ম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়ের চিন্তার অনুসরণে সর্ব ধর্ম সমন্বয় এবং একেশ্বরবাদ ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা ছিল দেবেন্দ্রনাথের দর্শনের মূলপ্রেরণা।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ৪৫বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ২৫ বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দে(১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে)।স্ত্রী সারদাদেবীর বয়স তখন ৩৩ বছর। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এই দম্পতির চতুর্দশ সন্তান। অন্যান্য সন্তান দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, স্বর্ণকুমারী সহ ঠাকুরবাড়ি তখন প্রতিভাবানদের আবাস।
এই পরিবেশে বেড়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিশোর রবীন্দ্রনাথকে দেখানো হয় বিশাল প্রাসাদে ঘুরে বেড়াতে। শিশু মনস্তত্বের চিত্রায়নে অসামান্য পারদর্শী সত্যজিৎ রায় পর্দায় জীবন্ত করে তোলেন কিশোর রবির অভিব্যক্তি। ছোটবেলায় তার স্কুলের শিক্ষাদীক্ষা, বাড়িতে শিক্ষা গ্রহণের দৃশ্য দেখানো হয়। তথ্য নেওয়া হয় রবীন্দ্রনাথের ‘আমার ছেলেবেলা’ ও ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে।
রবীন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও কাদম্বরীদেবীর সখ্যতার প্রসঙ্গ তুলে ধরা হলেও বিতর্কিত কোনো বিষয়ের অবতারণা করা হয়নি।
এর পরেই আসে রবীন্দ্রনাথের বিয়ের প্রসঙ্গ। ভবতারিণী নামে নয় বছরের একটি মেয়ের মৃণালিনী হয়ে যাবার কথা।
বাবার আদেশে জমিদারি দেখাশোনার ভার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আসেন শিলাইদহে। যুবক রবীন্দ্রনাথ, জমিদারির কৃষক প্রজাদের প্রতি তার সহমর্মিতা তাদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য তার অবদান এবং পদ্মানদীর অপরিসীম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুলে ধরেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়। এখানে আবহসংগীত হিসেবে ব্যবহার করা হয় ‘আমার সোনার বাংলা’র সুর।
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মের বর্ণনা আছে এর পরের অংশে। ১৯০১ সালে বোলপুরে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি উল্লেখিত হয় বিস্তারিত ভাবে। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনীদেবীর মৃত্যুর মাত্র নয়মাস পর তার মেজ মেয়ে রেণুকার মৃত্যু এবং চার বছর পর প্রতিভাবান ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথের মাত্র তের বছর বয়সে কলেরায় মৃত্যু ঘটে।
ব্যক্তিগত শোক সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ সে সময় তার সাহিত্য সৃষ্টি যেমন অব্যাহত রেখেছিলেন তেমনি সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে বাংলার হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির লক্ষ্যে ইংরেজের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান রবীন্দ্রনাথ। তিনি হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতির উদ্দেশ্যে রাখিবন্ধন করেন।
এদিকে ভারতে তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চলছে। দুর্লভ কিছু স্থির ও চলমানচিত্রের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের তথ্য পাওয়া যায় এ পর্যায়ে। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নাইটহুড ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথের জীবনের পরবর্তী দশ বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি ও শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির মেলবন্ধন ও সংহতির বাণী প্রচারের। বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন বিভিন্ন দেশে বক্তৃতার মাধ্যমে। দুর্লভ আলোকচিত্র ও চলমানচিত্র রয়েছে এ পর্যায়ে। রয়েছে বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে কবির বন্ধুত্ব ও চিন্তার আদান প্রদানের কথা।
সত্তর বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকার জন্য ইউরোপে ও আমেরিকায় খ্যাতি লাভ করেন। বিভিন্ন দেশে তার আঁকা ছবির প্রদর্শনী হয়।
১৯৪১ সালে ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের ৮০তম জন্মদিন পালিত হয় শান্তিনিকেতনে।
ইউরোপের আকাশে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালো মেঘ। রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেন সভ্যতার সংকট।
১৯৪১সালে অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ তার প্রিয় শান্তিনিকেতন থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে আসেন কলকাতার জোড়াসাঁকোর পুরনো বাড়িতে। এ বাড়িতে এক সময় যে শিশু রবির জন্ম হয়েছিল তার অস্তাচলের দিন যেন ঘনিয়ে এলো। ১৯৪১ সালের ২২ শ্রাবণ(বঙ্গাব্দ ১৩৪৮)তার মহাপ্রয়াণ।
সভ্যতার চূড়ান্ত সংকট ও ধ্বংসযজ্ঞের সংবাদে ব্যথিত হয়েও মানবতার জয়ে আস্থা হারাননি তিনি। মানবতার প্রতি রবীন্দ্রনাথের অন্তিম ও অবিচল বিশ্বাসের বাণী দিয়েই শেষ হয়েছে তথ্যচিত্রটি।
তথ্যচিত্রটি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। সেরা তথ্যচিত্র হিসেবে জয় করে প্রেসিডেন্ট’স গোল্ড মেডেল। সুইজারল্যান্ডের লোকার্নো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গোল্ডেন সেইল পুরস্কার পায়। উরুগুয়ের মন্টেভিডিও ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও বিশেষ পুরস্কার জয় করে। দেশে বিদেশে আরও অনেক পুরস্কার ও প্রশংসা পায় তথ্যচিত্রটি।
হাজার বছরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি রবীন্দ্রনাথের অসামান্য প্রতিভা ও সৃষ্টিশীল জীবনকে তুলে ধরার জন্য বাস্তবিকই প্রয়োজন ছিল সত্যজিৎ রায়ের মতো শক্তিশালী নির্মাতার। এই তথ্যচিত্র দেখার অভিজ্ঞতা তাই একটি মহৎ শিল্প দর্শনের।