‘সত্যজিৎ রায়ের প্রতিটি সিনেমা একটি করে স্কুল’

কিংবদন্তি নির্মাতা সত্যজিৎ রায় বিশ্বের যে কোনো বাঙালি নির্মাতার কাছে অন্যতম শিক্ষাগুরু। নির্মাণের কেরিয়ারে সত্যজিৎ রায়কে কীভাবে মূল্যায়ণ করেন সেই প্রশ্নই ঢালিউডের বেশ কয়েকজন নির্মাতাদের কাছে রেখেছিলো গ্লিটজ।

তানজিল আহমেদ জনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 May 2017, 01:48 PM
Updated : 2 May 2017, 02:29 PM

‘সিনেমা নির্মাণের সকল ক্ষেত্রেই সত্যজিৎ রায় মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন’ এমনটাই অভিমত দিলেন নির্মাতা মনতাজুর রহমান আকবর।

তিনি বলেন, “সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাগুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমাটি। কারণ সিনেমার গল্প ও বিষয়বস্তু যেমন ধরণের, সেই ধরণের একটি বিষয়বস্তুকে নিয়ে সিনেমা নির্মাণ, গল্প বলার ভঙ্গী ও সিনেমার প্রতিটি চরিত্রের চরিত্রায়ণ তা সাধারণত কোনো নির্মাতা পারেন না। নির্মাণের সকল ক্ষেত্রেই তিনি মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। এখানেই সত্যজিৎ রায় সফল।”

তিনি আরো বলেন,“সত্যজিৎ রায় শুধুমাত্র দক্ষিণ এশিয়াতেই নয় পুরো বিশ্বের মধ্যে একজন কিংবদন্তি নির্মাতা। তার চিন্তা, চেতনা সবকিছুই এত বাস্তবসম্মত যা সবসময়ই সমসাময়িক। তার নির্মিত প্রতিটি সিনেমা এমন মাপের যেগুলো কল্পনার বাইরে। তার মতো করে নির্মাণে মুন্সিয়ানা আর কখনো কেউ দেখাতে পারবেন না।”

‘সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা সিনেমাটি আজ অবধি মনে গেঁথে রয়েছে’

এমন কথাই শোনালেন নির্মাতা বদিউল আলম খোকন।

তিনি বলেন,“সত্যজিৎ রায় নির্মাণের ক্ষেত্রে কল্পনার সীমারেখাকেও অতিক্রম করে গিয়েছেন। তার নির্মিত সবগুলো সিনেমার মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে ‘পথের পাঁচালী’, ‘চারুলতা’ ও ‘অপুর সংসার’ সিনেমাগুলো। যার মধ্যে ‘চারুলতা’ সিনেমাটির কথা আমার আজও মনে পড়ে। এই সিনেমায় সত্যজিৎ রায় অদ্ভূত একটি প্রেমের গল্প তুলে ধরেছিলেন।”

তিনি আরো বলেন,“আমার জীবনের একটাই আশা এই তিনটি সিনেমার যে কোনো একটির মত একটি সিনেমা নির্মাণ করার। যদি তা সম্ভব হয় তাহলেই বুঝবো একজন নির্মাতা হিসেবে আমার কেরিয়ারে একটু হলেও কাজ শিখতে পেরেছি।”

‘সত্যজিৎ রায়কে যে কোনো নির্মাতাই তার ভাবনায়, কল্পনায় ও একাকিত্বের মধ্যে ধারণ করে’

বলে বিশ্বাস করেন নির্মাতা এস এ হক অলিক।

তিনি বলেন,“উপমহাদেশের বাংলা ভাষাভাষী চলচ্চিত্র নির্মাতা যারা রয়েছেন তারা সবাই সত্যজিৎ রায়কে কোনো না কোনো ভাবে উপলব্ধি করেন। কখনো না কখনো হয়ত কেউ না কেউ সত্যজিৎ রায়ের মত হওয়ার একটা গোপন পরিকল্পনা কিংবা ইচ্ছে নিজের মনের ভিতরে লালন করেন। বিশেষ করে তাদের ভাবনায়, কল্পনায়, কাজের পূর্ব মূহূর্তে কিংবা কখনো কখনো একাকিত্বের মধ্যেও সত্যজিৎ রায়কে ধারণ করেন। কখনো কখনো সত্যজিৎ রায় হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন। তারা সত্যজিৎ রায় হতে চায় কল্পনায়, সত্যজিৎ রায় হতে চায় ভাবনায়, হয়ত নির্মাণের ক্ষেত্রে নয়।”

তিনি আরো বলেন,“সত্যজিৎ রায়ের নির্মিত সবগুলো সিনেমা আমি না দেখলেও তার নির্মিত যে কয়টি সিনেমা আমি দেখেছি তার প্রতিটিতে নির্মাতা হিসেবে নিজেকে (সত্যজিৎ রায়) আলাদাভাবে উপস্থাপনের বিষয়টি লক্ষ্যনীয়। তার নির্মিত সিনেমাগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমাকে কল্পনা করলেই বোঝা যায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করাটা অনেক বড় ব্যাপার। একজন পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাতাই একজন শিল্পী তৈরি করতে পারে যা তার কাজগুলো দেখলেই বোঝা যায়।”

‘সত্যজিৎ রায়ের প্রতিটি সিনেমা এমন একটি স্কুল, যে স্কুলের সিনেমাগুলো দেখে পড়াশুনা করা যায়’

এমনটাই বিশ্বাস করেন নির্মাতা দেবাশীষ বিশ্বাস।

তিনি বলেন,“সত্যজিৎ রায় শুধুমাত্র একজন নির্মাতাই কেবল ছিলেন না। তিনি ছিলেন একাধারে একজন সাহিত্যিক, উপন্যাসিক, গল্প লেখক, সংগীত পরিচালক, গীতিকার ও একজন চমৎকার আঁকিয়ে। আমি সত্যজিৎ রায়কে আসলে অন্য এক গ্রহের মানুষ বলে মনে করি। কারণ তার প্রতিটি ক্ষেত্রের মধ্যেই কোনো বিশেষ একটি ক্ষেত্রকে বেছে নিলেও তিনি সেই ক্ষেত্রেও বিশ্ব সেরা হতেন। আমি তার নির্মিত গল্পের গোয়েন্দা চরিত্রের মধ্যে ফেলুদাকে সব সময়েই শার্লক হোমস, কিরিটি রায় কিংবা কিশোর, মুসা রবীনের চেয়েও বেশি এগিয়ে রাখি। কারণ ফেলুদার মত চরিত্র আর কখনো আসেনি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রকার।”

তিনি আরো বলেন,“অনেকেই ‘পথের পাঁচালী’, ‘চারুলতা’ ও ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমাগুলোর কথা বলেন। কিন্তু আমার কাছে ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমাটি সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছিলো। কারণ এই সিনেমাটি এমনই একটি সিনেমা যেখানে আমরা তার প্রতিভার বিচ্ছুরণ অন্যভাবে পেয়েছিলাম। তার পুরো সিনেমাটি কবিতার ছন্দে তৈরি করা, যা অদ্ভূত বিষয়। যা আর কেউ করতে পারেনি এবং কারো করা উচিতও নয়। তিনি বিভিন্ন ধরণের সিনেমা নির্মাণ করেছেন। আসলে সত্যজিৎ রায়ের প্রতিটি সিনেমা একটি করে স্কুল। যে স্কুলে তার সিনেমাগুলো দেখে পড়াশুনা করা যায়।”