সত্যজিতের প্রশংসা, সত্যজিতের নিন্দা !

‘সত্যজিতের চলচ্চিত্র না দেখা আর পৃথিবীতে বাস করে চন্দ্র-সূর্য না দেখা একই কথা’- বলেছেন বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়া। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা কী বলছেন?

রুদ্র হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 May 2017, 01:08 PM
Updated : 2 May 2017, 03:18 PM

সত্যজিৎ রায় প্রসঙ্গে বিশ্বখ্যাত নির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়ার উক্তি -‘সত্যজিতের চলচ্চিত্র না দেখা আর পৃথিবীতে বাস করে চন্দ্র-সূর্য না দেখা একই কথা’। অন্যদিকে সত্যজিতের নিন্দুকেরা মনে করেন তাঁর ছবিগুলো অত্যন্ত ধীর গতির, যেন ‘রাজকীয় শামুকের’ চলার মত। এ ব্যাপারে সত্যজিৎ যখন নিরুত্তর তখন কুরোসাওয়াই পাশে দাঁড়াচ্ছেন তার, বলছেন-‘সত্যজিতের ছবিগুলো মোটেই ধীরগতির নয়। বরং এগুলোকে শান্তভাবে বহমান এক বিরাট নদীর সাথে তুলনা করা যায়।’ শুধু তাই নয়, কুলীনদের পাশে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষের দারিদ্র্য বেচে পুরস্কার অর্জনেরও নিন্দা জুটেছে তার কপালে। প্রশংসাও কম জোটেনি। বিশ্বখ্যাত এই বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাতা সম্পর্কে কী ভাবছেন আমাদের দেশের নির্মাতারা? তারই খানিকটা অনুসন্ধান...

সত্যজিৎ একজন মাস্টার ফিল্ম মেকার

গিয়াস উদ্দিন সেলিম, নির্মাতা, মনপুরা, স্বপ্নজাল (মুক্তিসম্ভাব্য)

চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সত্যজিৎ রায় আমার দারুণ পছন্দের একজন। ওনার ‘পথের পাঁচালী’ আমার চলচ্চিত্রের রুচি পরিবর্তন করে দিয়েছিলো। অনেকবার দেখা হয়েছে ছবিটি। ওনার আরেকটা ছবির কথা বলবো, সেটা হলো ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। এ ছবিটিও আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। এটি দেখার পর আমার ডায়ালগ লেখার ধরণ পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিলো। তবে, ডিরেক্টর হিসেবে বলবো, উনি ওনার প্রতিটি চরিত্রকে দারুণভাবে ডিল করতে পারতেন। একটা ছোটো চরিত্রকেও নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। একজন নন অ্যাক্টরকেও অ্যাক্টিং করানোর দারুণ প্রতিভা ছিলো তার। সবকিছু মিলে বলবো, সত্যজিৎ একজন মাস্টার ফিল্ম মেকার।

সত্যজিৎ রায়ের নামটা অনেক কম বলা হয়েছে

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, নির্মাতা, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, টেলিভিশন, ডুব (মুক্তিসম্ভাব্য) 

আমার অনেক প্রিয় ফিল্ম মেকার আছে, যারা আমাকে অনেক ইন্সপায়ার করেছেন, আমি যাদের নাম অনেক বলি, তাদের মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের নামটা অনেক কম বলা হয়েছে। কারণ হচ্ছে, আমি যখন ধীরে ধীরে সিনেমা বুঝতে শুরু করেছি, যাদের দ্বারা অনেক বেশি মুভ্ড হয়েছি, তারা হলেন- আব্বাস কিয়ারোস্তামি, ওঙ্কার ওয়াই, তারকাভস্কি, কিম কি দুকসহ অনেকেই। কিন্তু যখন আমি বয়সে বড় হয়েছি তখন সত্যজিৎ রায়ের ছবি কম দেখা হতো। পরে আমি খেয়াল করে দেখলাম, আমাকে প্রথম দিকে ইন্সপায়ার্ড করেছেন কোনো ফিল্ম মেকার, তাহলে ডেফিনিটলি আমাকে সত্যজিৎ রায়ের নামই বলতে হবে। কারণ বাংলাদেশে তখন হলে গিয়ে যে ধরণের ছবি দেখার চল ছিলো ‘শেষনাগ’ টাইপের, এর বাইরে তখন প্রথম অন্যধরণের ছবি দেখা হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের ছবির মাধ্যমে। এবং আমি খুবই সৌভাগ্যবান, আমি প্রথম দেখেছি তার ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিটা। এটা আমার প্রিয় ছবি। এর পরে ‘পথের পাঁচালী’ দু’তিনবার দেখার পরও ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ই আমার প্রিয় ছবি। এখনও আমি মনে করি, দক্ষিণ এশিয়ার অপর সিনেমার ক্ষেত্রে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ একটি মাস্টার ফিল্ম। মধ্যবিত্তের জীবন, মধ্যবিত্তের মনের চোরাগলি এটা এত চমৎকার উইট এবং টেম্পারমেন্টের ভেতর উনি ডিল করেছেন, মধ্যবিত্তের শঠতা, পাপ, পূন্য এই জিনিসগুলো তিনি এত নির্মোহভাবে ডিল করেছেন, এটা আমার ওয়ান অফ দ্য ফেভারিট ছবি হিসেবে রয়ে গেছে। কলকাতার মিডলক্লাসের উপর নির্মিত এখনও পর্যন্ত এটা সেরা ছবি।

নিজেকেই করেছেন নিজের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী

আবু শাহেদ ইমন, নির্মাতা, জালালের গল্প

সত্যজিৎ রায়ের ছবির নায়ক নায়িকারা চরিত্ররা কেউই সুপার-হিউম্যান ছিলেন না। প্রাত্যহিক জীবন থেকে নেওয়া চরিত্রদের গল্পই ছিল উনার প্রায় সকল ছবির প্রাণ। যেগুলোতে এই প্রাত্যহিকতার বাইরে ভূতের রাজার বর পেয়ে গুপী-বাঘারা খানিকটা সুপার হিউম্যান হয়ে উঠেছে সেখানেও চরিত্রের চাহিদাগুলো ছিল খুব সাধারণ হয়ে উঠবার চেষ্টা। জীবনের খুব কাছাকাছি থাকা সাধারণ মানুষের গল্প দিয়েই নির্মাণ করেছেন দুর্দান্ত সব কমেডি-ট্রাজেডি আর বিশাল সব গ্র্যান্ড-ন্যারেটিভ। সিনেমার কবি ছিলেন উনি। সাহিত্য থেকেই ধার করে হোক আর নিজের মৌলিক রচনা দিয়েই হোক চরিত্রগুলোকে আমাদের মনঃস্তত্ত্বে গেঁথে দিয়েছেন যুগের পর যুগ। অপু-দুর্গার 'পথের পাঁচালী'-তে দুর্গাকে হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই 'অপরাজিত' আর 'অপুর সংসার' দিয়ে এক মানব জীবনের বিচিত্র সব আখ্যানের চিত্র বানিয়েছেন তিনি। আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি কেননা আমি সত্যজিৎ পরবর্তী প্রজন্মের একজন।

বাংলাদেশে এখন যে ধরণের ছবির জয়জয়কার, সেখানে হিরোর যাত্রায় সবাই সুপার হিরো কিংবা হিরোইনের যাত্রায় সুপার হিরোইন হতে চায়। হিরো-হিরোইন মানেই দুর্দান্ত নাচবে, গোটা দশেক লোকের সাথে একাই মারামারি করে জিততে পারবে, অসম্ভব সুন্দর গান গাইতে পারবে কিংবা বাবা-মায়ের চোখের মনি হয়ে জীবনের সব স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে। ২ ঘণ্টা হলে যায় সবাই বিনোদিত হবার জন্য। এই বিনোদন একটা মোটা দাগের বিনোদন। যেখানে নায়কের পরাজয়ের ভয় নেই, জীবনবোধ বোঝার জন্য ধৈর্য্য নেই, কাহিনি যত উদ্ভটই হোক না কেন বিনোদিত করছি কিনা আর হচ্ছি কিনা এইটাই এখনকার সিনেমার মূল দর্শন।

কেননা পয়সা উসুল সংস্কৃতিতে দর্শক-নির্মাতা কারও জন্যই নায়কের পরাজয় ব্যবসাসফল না। সত্যজিতের চরিত্ররা অনেক হেরেছেন। চড়াই উতরাই পার হয়েছেন। মানবিকতার নিবিড় বাঁধনে বাঁধা গল্পের চরিত্রগুলো কখনো মহানগর-এর অভিযানে বের হয়ে গুপী গাইন আর বাঘাবাইন হয়ে গান গেয়ে পৌঁছে গেছেন কোনও এক হীরক রাজার দেশে। মানুষের এই বিশাল চিড়িয়াখানায় নিঃসঙ্গ এক নায়ক প্রেমে পড়েছে চারুলতার। জন অরণ্যের শাখা প্রশাখায় ছটফট করেছে কোনও এক কাপুরুষের মত। আবার আগন্তুক এক পথিকের মত চুপচাপ নিস্তরঙ্গটা তৈরি করেছেন কোনও এক অরণ্যের দিন রাত্রিতে। উনার চলচ্চিত্রগুলো দেখলে আমার মনে তাই একটাই গান বাজে, ‘দেখোরে নয়ন মেলে জগতের বাহার!’ এখানে চরিত্ররা কেউ সুপার হিরো না। অরাজনৈতিকও না। নিজের সংস্কৃতির বাইরে না। আমাদের আশে পাশের চরিত্রদের গল্প দিয়েই একজীবনে সিনেমার মহাপুরুষ হয়েছেন তিনি। সীমাবদ্ধ এই মানব জন্মে ঘরে বাইরে জীবনের সব অশনি সঙ্কেত কাটিয়ে একমাত্র নিজেকেই করেছেন নিজের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী।

নির্মাতা হিসেবে রয়কে বেশ শক্তিশালী মনে হয়না আমার

মাহমুদ দিদার, নির্মাতা, চেরি ফুলের নামে নাম, স্বৈরাচার, বিউটি সার্কাস (নির্মানাধীন)

সত্যজিৎ রায়, চলচ্চিত্রকারের যে নৈর্ব্যক্তিক ভাষা, তা ভেদ করে একটা আলাদা সিনেম্যাটিক পরিচয় দাঁড় করাতে পেরেছেন। এই অঞ্চলে সিনেমা বলা বা দেখার যে পরিচয় তা তিনি নির্ধারণ করে দিতে পেরেছিলেন। এটা ভারতবর্ষের গণ্ডি পার হয়ে বিপুল বৈভবে বিশ্ব মাতিয়েছে। যে ন্যারেটিভে সত্যজিৎ এতদঞ্চলের মানুষকে দেখিয়েছিলেন সেটা নয়া বাস্তবতার (নিউ রিয়াল) নিরিখে চলচ্চিত্রের জন্যে ফলদায়ক ছিলো। কিন্তু সিনেমার ভিতর দিয়ে দারিদ্র্য‌ বিকিয়ে দিয়ে পুরস্কার প্রাপ্তির যে গোড়াপত্তন তিনি করেছিলেন তা এখনও অত্র অঞ্চলের সিনেমায় আছর করে আছে। সমালোচকরা তাই বলেন ‘মিস্টার রে সোল্ড পভার্টি ভেরি ক্লেভার্লি’। ইউরোপিয়ান ফিচার ফিল্ম দ্বারা আক্রান্ত এবং পুতুপুতু মার্কা প্রেমের গল্পের নির্মাতা হিসেবে রয়কে বেশ শক্তিশালী মনে হয়না আমার। সেই সময়ে এসে ঋত্বিক কিন্তু আলাদা শক্তিমত্তা নিয়ে হাজির হন কেবলমাত্র সিনেমার রাজনীতি দিয়ে। বিভূতিভূষণ এর অপু ট্রিলজিকে পুঁজি করে রয় এক ধরণের প্রাচ্য দেশীয় দারিদ্রের ফর্ম  তৈরি করেছিলেন সেটা আমার কাছে কম প্রভাবক মনে হয়। মোসাহেব বা কুলীন লোকেদের সিনেমা বানাতে সত্যজিৎ অনেকাংশে এলিটমুখীন হয়ে উঠেছিলেন।

সব মিলিয়ে সত্যজিৎ রয়কে আমার দারুণ ভালো লাগেনা, এটা হয়ত আমার ব্যর্থতা।