‘মাদলে কোনো লিড সিঙ্গার নেই, নেই ফেইসভ্যালু’

পশ্চিমবঙ্গে লোকসংগীত নিয়ে কাজ করছে বেশক’টি দল। তাদের মধ্যে মাদলের গল্পটি একটু আলাদা। দল গড়ে উঠা, লোকগান সংগ্রহ আর সেগুলোর প্রচার-সংরক্ষণ- এ বিষয়গুলোতে দলটি নিজেদের আলাদা এক বৈশিষ্ট্য গড়ে তুলেছে।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 April 2017, 02:26 PM
Updated : 16 April 2017, 02:30 PM

সম্প্রতি বাংলাদেশে রাধারমণ সংগীত উৎসবে যোগ দিতে এসেছিল দলটি। এক ভোরে তারা মুখোমুখি হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের। দলের মেন্টর তপন রায় শোনালেন তাদের ‘মাদল’ হয়ে উঠার গল্প। গল্পটি লিখেছেন জয়ন্ত সাহা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: লোকসংগীত নিয়ে অনেকগুলো দল কাজ করছে পশ্চিমবঙ্গে। আপনি নিজেও অনেকদিন এই লোকগান নিয়ে গবেষণা করছেন। আলাদা করে দল গঠন করলেন কেন?

তপন রায়: ২০০০ সালের গোড়ার দিকের কথা। লোকসংগীত নিয়ে তখন আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছি। বাজারে দেখলাম এই লোকসংগীত নিয়ে অনেকে কাজ করছে। ভূমি, দোহার তাদের মধ্যে অন্যতম। তাদের কাজের ইতিবাচক-নেতিবাচক দুটো দিক দেখে মনে হয়েছিলো, এমন একটা দল করা উচিত, যেখানে আমার ভাবনা-চিন্তাটা কাজ করবে। এর মাধ্যমে আমরা মানুষকে কিছু দিতে পারবো।

আর একটা ভাবনা ছিল, এককভাবে ক্যারিয়ার গড়ার ইচ্ছা আমার মোটেও ছিল না। এটাও ভাবনায় ছিল, আমি ইচ্ছা করলেও দলে ঢুকে গাইতে পারব না। এভাবেই মাদলের কনসেপ্টটা করা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: শুধু নারীদের নিয়ে দল গড়ে তুলেছেন কেন?

তপন রায়:  নারীদের নিয়ে একটা গানের দল করার পরিকল্পনা মাথায় ছিলো, তবে সেটি ভিন্ন আঙ্গিকে। মূল বিষয়, মাদল এমন একটা কনসেপ্ট যা বাজারের পাঁচটা দল থেকে আলাদা।

এখানে মুখের কোনো গুরুত্ব নেই। আজকে যারা গাইছে, কালকে তারা পাল্টে যেতে পারে। অর্থাৎ এখানে কোন ফেইসভ্যালু নেই। তাছাড়া মাদলই একমাত্র দল, যেখানে কোনো লিড সিঙ্গার নেই। আর এটা শুরু থেকেই। এখানে সবার ভ্যালু সমান। এজন্য এ কনসেপ্টে দল টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশি। তা না হলে দু’দিন পর আপনি যাকে প্রমিনেন্ট বানাবেন, সেই আপনাকে ছেড়ে যাবে। নইলে দলের শাসনের ভার চলে যাবে তার হাতে। সে ইচ্ছামতো দল চালাবে। বাকিরা অসহায় হয়ে পড়বে। মাদলে সে সুযোগটা নেই।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: গানের দল তো মেন্টররা তো লিড করেন, লিড সিঙ্গারও তারা। আপনি তাহলে এই ধারণার বিরোধী?

তপন রায়:
অবশ্যই। মেন্টর বা কোচ পারফর্ম করতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি, কোচ আর খেলোয়াড় একসঙ্গে ময়দানে খেলা উচিত নয়। এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত কনসেপ্ট। আমার মনে হয় জাজমেন্টের জায়গাটা নষ্ট হয়। কারণ প্লেয়াররা খেললে নিজেদের উজাড় করে খেলে। কিন্তু কোচ স্বয়ং যখন মাঠে থাকেন, তখন প্লেয়াররা তাদের উজাড় করে শেষটুকু দিতে পারেনা। কোথাও একটা সংকোচ, ভয়-ভীতি কাজ করে।

আমার মতে, ক্রিয়েশন যে করবে তার সবসময় পেছনে থাকা উচিত। তাহলে জাজমেন্টের সুযোগটা থাকে। ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেবার সুযোগ থাকে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: মাদলের শুরুতে যে দল ছিল, তার থেকে তো অনেকে বেরিয়ে গেছেন….

তপন রায়:  দলে খুব হাই কোয়ালিটির লোক নিলে দল টেকে না। কিছুদিন পর সে বেরিয়ে যায়। এটাই নিয়ম। হয় সে অন্যদের ডমিনেট করবে, নতুবা অন্যদের সারাক্ষণ বুঝিয়ে দেবে ‘তোরা আমার কাছে কিছুনা। আমি গাইছি বলেই তোরা উতরে যাচ্ছিস’।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: লোকসংগীতের আদি সুর সংগ্রহ করা ভীষণ কঠিন ব্যাপার। এক সাধক একভাবে গান তো অন্যজন অন্যভাবে.. মূল সুর সংগ্রহ করতে পারছেন কি?

তপন রায়: ভিন্ন জনের উপস্থাপনা ভিন্ন রকম হতেই পারে। এটাই স্বাভাবিক। তবে গানের মূল পরিবর্তন হয়ে গেলে গন্ডগোল। যেমন একটা গান ৪০ জন গাইতে পারে। তবে সেটা কখনও গানের কাঠোমো অর্থাৎ স্বরলিপিকে পরিবর্তন না করে। আর মাদল এই চর্চাটাই করে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম : এবারের উৎসব স্মরণিকায় পড়ছিলাম আপনার লেখা। আপনি বলছেন, গানের প্রেজেন্টশনের কথা। ব্যাপারটি একটু খোলসা করবেন ….

তপন রায়: গানটা সুরে-তালে কীভাবে বললে শ্রোতার অনুভূতিতে মোচড় দেবে, সেটা বুঝতে হবে। জানতে হবে। আর এজন্য গান শিখতে হবে। প্রেজেন্টেশনটা শিখতে হবে। সত্যিকারের প্রেজেন্টেশন, যেটা শ্রোতার হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। তুমুল প্রশান্তিতে তারা বলবে, আহা। অধিকাংশ ট্রেইনার ভয়েস মডুলেশন শেখান না। ব্যাপারটায় জোর দেওয়া দরকার।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম:  আপনার মতে, বিশেষ কী গুণ আছে লোকসংগীতে?

তপন রায়:  মনোটোনাস একটা ব্যাপার সব সময় থাকে লোকসংগীতে। সুরের মধ্যে জাদু-মাদকতা লুকিয়ে থাকে। যা আমাদের মোহিত করে, পাগল করে। সহজ-সরল-আটপৌরে কথা-সুরে লেখা-গাওয়া বলেই গানটির নামকরণ হয়েছে সহজিয়া। সহজ জিনিস সহজভাবে বলাটা খুবই কঠিন, যেটা ‘সহজিয়া’ গানে তুলে ধরা যায়।

আমার মতে লোকসংগীত হল গানের শেকড়, তা আমাদের সংস্কৃতিরও শেকড়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম : লোকসংগীত নিয়ে নানা ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে…

তপন রায়: শুধু জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য লোকসংগীত নয়। যেটা এখনকার শিল্পীদের মাঝে বেশি দেখা যায়। লোকসংগীতের সহজাত ছন্দটা বোঝেন না বলেই তারা গানটি মূর্খের মতো মানুষের সামনে উপস্থাপন করছেন। খুবই দুঃখজনক। লোকসংগীত যে বাজার গরমের জন্য নয়, সেটা যেদিন শিল্পীরা অনুধাবন করবেন, সেদিন হয়তো এই অবস্থা বদলাবে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: তবে উত্তরণের উপায় কি?

তপন রায়: আমার মতে সমস্ত বাঙালি জাতির পাঠ্য তালিকায় লোকসংগীতকে ঠাঁই দেওয়া উচিত। বাধ্যতামূলক করা উচিত। তাহলে নিজের সংস্কৃতি সম্পর্কে সবার ধ্যান-ধারণা জন্মাবে। আর সেটা অবশ্যই শিল্পী হবার জন্য নয়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: ‘গানচিল’ আপনাদের সর্বশেষ অ্যালবাম। আগামীতে কী করবেন?

তপন রায়:  আপাতত ওইভাবে ঠিক পরিকল্পনা করিনি। দেখা যাক কী হয়। তবে হ্যাঁ, সিলেটের শ্রী হট্টের মরমীগান নিয়ে একটা অ্যালবাম সংকলনের ইচ্ছা আছে। নিঃসন্দেহে সিলেট লোকসংগীতের আঁতুড় ঘর। কারণ এখানেই শ্রীহট্ট, শাহ আবদুল করিমরা জন্মেছেন। এত রিচ জায়গা অন্যত্র নেই। তাই সিলেটকে মাথায় রেখেই লোকসংগীত গাইতে হবে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: বাংলাদেশে এসেছেন আগেও। এবারও এলেন। এদেশের মানুষের আতিথেয়তা কেমন লেগেছে?

তপন রায়: বাংলাদেশ আমার নিজের বাড়ির মতোই। এখানে আসতে বরাবরই ভালো লাগে। আর এদেশের মানুষ ভীষণ অতিথিপরায়ন। খুব ভালো লাগে এদের আন্তরিকতা, আপ্লুত হয়ে যাই। আমি শুধু অপার মুগ্ধতায় একটি কথাই বলব, বাংলাদেশে এলে মনে হয়, বাড়িতেই আছি।

শ্রোতা হিসেবে বাংলাদেশিরা অসম্ভব ভালো। এদেশের মানুষ গানটিকে অনুভব করে গায়কের গায়কী শোনেন, এটাই বড় কথা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: মাদলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

তপন রায়: চমক নয়, গানই আমাদের লক্ষ্য। সেটা একজন শুনলেও আমরা গাইবো। আর সেটা মঞ্চে না নেচেই।

মাদলে বর্তমানে গাইছেন রীতা সাহা, ঝিমলি ভট্টাচার্য্, পল্লবী মজুমদার, মালা চক্রবর্তী, রণিতা ব্যানার্জি ও মেহুলি সরকার। যন্ত্রশিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন নিলোৎপল, সমরেশ, কিংশুক, চিন্ময়, বঙ্কিম ও শিলু। এদের নিয়েই আমাদের বর্তমান লাইন আপ।