রক্তাক্ত বাংলা: যুদ্ধদিনের ছবি

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক হাতে গোনা যে কয়টি ছবিতে ওপার বাংলা ও এপার বাংলার শিল্পীদের দেখা গেছে তার একটি হলো ‘রক্তাক্ত বাংলা’।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Dec 2016, 07:05 PM
Updated : 15 Dec 2016, 07:19 PM

ছবি শুরু হয় বাংলার গ্রামের শান্তিময় জীবনের দৃশ্য দিয়ে।যুদ্ধশেষে দেশে ফিরছে মুক্তিযোদ্ধারা। এরপর ফ্ল্যাশব্যাকে মূল কাহিনী শুরু হয়।

শহরের একটি মধ্যবিত্ত পরিবার। তরুণ ভাস্কর শাহেদ এবং তার ছোট বোন হাসির সুখের সংসার। সন্ধ্যা নামে এক তরুণী একদিন তার স্টুডিওতে আসে। এটা ওটা দেখতে দেখতে সে একটি মূর্তি অসাবধানতায় ভেঙে ফেলে। শাহেদের তিরষ্কারে ব্যথিত হয় সন্ধ্যা। শাহেদ অবশ্য পরে নিজের রাগ প্রকাশের জন্য অনুতপ্ত হয়।

পঁচিশে মার্চের কালরাত্রি। শহরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী। নির্মম হত্যাযজ্ঞ চলে। মসজিদ, মন্দির, গির্জাও রেহাই পায় না তাদের আক্রমণ থেকে। রেহাই পায় না মায়ের কোলে থাকা শিশুও। লাশের পর লাশ পড়ে থাকে। ২৭ মার্চ ঘরে ফিরে ভাস্কর শাহেদ দেখে তার সাধের শিল্পকর্মগুলো সব চূর্ণবিচূর্ণ। তার আদরের ছোটবোন হাসিকে হত্যা করেছে পাকিস্তানী সৈন্যরা। সারাদেশের উপর বর্বর নির্যাতনের চিত্র দেখে আর স্থির থাকতে পারে না সে। সে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ট্রেনিং নেয়্। সেক্টর ইনচার্জ হিসেবে একটি দলের নেতৃত্ব পায় ক্যাপ্টেন শাহেদ।

এ পর্যায়ে গেরিলাযুদ্ধের কিছু দৃশ্য দেখানো হয়। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শাহেদ। জয়নাল নামে আরেক মুক্তিযোদ্ধাকেও দেখা যায়। গ্রামের নারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি মিলিটারি। তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে যায় জয়নালের বাহিনী। যুদ্ধের পর যুদ্ধ চলে। একদল মুক্তিযোদ্ধাকে দেখানো হয়। যাদের মধ্যে রয়েছে রুমি নামে এক তরুণ। রুমির বাহিনী ও জয়নালের বাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের যুদ্ধে পরাজিত করে।

মুক্তিবাহিনীর মধ্যে নারীদেরও দেখা যায় অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে এবং গেরিলাদের সাহায্য করতে। ক্যাপ্টেন শাহেদ নির্দেশ পাঠায় জয়নালের কাছে। পাশের গ্রামে পাকিস্তানিদের ক্যাম্প আছে। সেখানে নারীদের উপর নির্যাতন চলছে। এই ক্যাম্প আক্রমণ করতে হবে।

জয়নাল ও রুমির বাহিনী আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। দুই নারী মুক্তিযোদ্ধা নর্তকী সেজে ক্যাম্পে যায়। তারা নাচ গান করে ঘাতক সৈন্যদের ব্যস্ত রাখে। সেই অবসরে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে হামলা করে এবং তাদের পরাজিত করে।

সিনেমাটিতে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির‌্যাতিত এক নারীর ভূমিকায় অভিনয় করেন কবরী

এরপর দেখা যায় পাকিস্তানি সৈন্যদের গাড়ির বহর যাচ্ছে গ্রামের পথ দিয়ে। শাহেদ ও জয়নালের নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলে হানাদার বাহিনীর। জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে হানাদারদের পরাজিত করে শাহেদ ও জয়নাল। রুমির নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী সৈন্যবাহী ট্রেনে হামলা চালিয়ে রেললাইন ও ট্রেন উড়িয়ে দেয়।

একের পর এক যুদ্ধ চলতে থাকে। যুদ্ধের ব্যাপকতা বোঝা যায় লংশটে পুরো আকাশ বোমারু বিমানে ছেয়ে যাওয়া এবং বিস্তৃত প্রান্তর জুড়ে ট্যাংক বহর ও সৈন্যদের মার্চ করার মধ্যে।  ঢাকার দৃশ্যও দেখানো হয়। ব্যাকগ্রাউন্ডে জয় বাংলা বাংলার জয় গানের সুর। এ দৃশ্যগুলো তথ্যচিত্র থেকে নেয়া। এখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীকেও দেখা যায়। পাকিস্তারি সেনাদের অনেককে আত্মসমর্পণ করতেও দেখা যায় বিভিন্ন দৃশ্যে।

বিজয়ীর বেশে দেশে ফেরে মুক্তিযোদ্ধারা। জয়ীর বেশে দেখা যায় শাহেদকে। গ্রামের পথে সন্তান হারানো পিতামাতা এবং পাগলিনীর বেশে নির্যাতনের শিকার নারীদের দেখে শাহেদ বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে যে যার ঘরে ফিরে আসছে মুক্তিযোদ্ধারা। ক্লান্ত শাহেদ গ্রামের এক গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ নারীকণ্ঠের আর্তনাদে ঘুম ভাঙে তার। কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে এক নির্জন বাড়িতে পৌঁছায় সে। দেখা যায় সেটি মুক্তিযুদ্ধে শাহেদের সহযোদ্ধা মেজর মাসুদের বাড়ি। তিনি একজন ডাক্তার। ডা. মাসুদের বোন সন্ধ্যা। যে একসময় শাহেদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। শোনা যায় বড় ভাইয়ের কাছে সে ভাস্কর শাহেদের শিল্পকর্মের অনেক প্রশংসাও করেছিল। মাসুদের কাছেই শাহেদ জানতে পারে সন্ধ্যা এখন হঠাৎ হঠাৎ মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। পঁচিশে মার্চের কালরাত্রিতে ঢাকার অনেক নরনারীর সঙ্গে সন্ধ্যা ও মাসুদ আশ্রয় নিয়েছিল সবুজবাগ বৌদ্ধবিহারে। সেখানে প্রবেশ করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। তারা পুরুষদের হত্যা করে। মেয়েদের ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। বুদ্ধমূর্তির সামনেই সন্ধ্যাকে ধর্ষণ করে তারা। মাসুদকে  বেঁধে রেখে সন্ধ্যাকে ক্যাম্পে নিয়ে যায় পাকিস্তানিরা।

যুদ্ধশেষে ক্যাম্প থেকে মুক্তি পায় সন্ধ্যা। এরপর মুক্তিযোদ্ধা মাসুদ বোনকে নিয়ে এসেছে গ্রামের এই পোড়ো বাড়িতে। যাতে সমাজের কাছ থেকে নির্যাতিত বোনকে লুকিয়ে রাখা যায়।পাশাপাশি সন্ধ্যার চিকিৎসাও করছে সে। এই বাড়িতে কিছুদিনের জন্য আতিথ্য গ্রহণ করে শাহেদ। শাহেদের সঙ্গে সন্ধ্যার আলাপ জমে ওঠে। সন্ধ্যা এক সময় ভালো নাচতে ও গাইতে জানতো। শাহেদের ভক্ত ছিল সে। সেই সব পুরানো দিনের স্মৃতি ফিরে আসে। স্টুডিওতে একটি মূর্তি অসাবধানতায় ভেঙে ফেলার স্মৃতিতেও দুজনে হেসে ওঠে। সন্ধ্যাও একসময় ভাস্কর্য জানতো। সে ছোট ছোট মূর্তি বানাতে থাকে পুরানো দিনের মতো। সন্ধ্যাকে ভালোবেসে ফেলে শাহেদ। এই বাড়িতেই নিজের ছো্ট্ট একটি স্টুডিও গড়ে সে। সেখানে একটি নারী মূর্তি বানায় সে। তার মনে পড়ে যায় বোন হাসির কথা। সন্ধ্যা জিজ্ঞাসা করে কে এই নারী। শাহেদ বলে ওর নাম হাসি।

সন্ধ্যা মনে করে হাসি হয়তো শাহেদের প্রেমিকা। তার মনে হয় সে ধর্ষিত বলে শাহেদের ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়। মাসুদ শাহেদকে প্রশ্ন করে ‘কে হাসি?’ শাহেদ বলে হাসিকে সে ভালোবাসে, আজীবন ভালোবাসবে কারণ সে তার ছোট বোন যে আজ মৃত।’ এ কথা শুনে সন্ধ্যা ভাবে হাসি মৃত। আর সে ধর্ষণের শিকার হয়েও বেঁচে আছে। সে অপবিত্র। সন্ধ্যা তাই আত্মহত্যা করার জন্য পথে বেরিয়ে পড়ে। মাসুদ ও শাহেদ তাকে খুঁজতে বের হয়। অবশেষে সন্ধ্যাকে মৃত্যুর প্রান্ত থেকে রক্ষা করে শাহেদ। সে বলে একজন নির্যাতিত নারী কখনও অপবিত্র নয়। সে তাকে নিয়ে নতুন জীবন গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। রক্তাক্ত বাংলাকে নতুনভাবে গড়ে তোলার আশা ফুটে ওঠে তাদের চোখে।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে রক্তাক্ত বাংলা মুক্তি পায়। ছবিটিতে শাহেদের চরিত্রে পশ্চিমবঙ্গের নায়ক বিশ্বজিৎ এবং সন্ধ্যা চরিত্রে কবরী অভিনয় করেন। মাসুদ চরিত্রে গোলাম মুস্তাফা ও হাসি চরিত্রে রূপদান করেন সুলতানা। অন্যান্য চরিত্রে খলিল, মঞ্জু দত্ত, সরকার কবিরউদ্দিনসহ অনেকে অভিনয় করেন। ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন সলিল চৌধুরী। প্লেব্যাক শিল্পী ছিলেন লতা মঙ্গেশকার, মান্না দে ও সবিতা চৌধুরী। ছবির কাহিনী লেখেন রত্না চ্যাটার্জি, চিত্রনাট্য ও সংলাপ শান্তি চ্যাটার্জি। ছবিটি পরিচালনা করেন মমতাজ আলী। এ ছবির একটি গান ‘দাদাভাই মূর্তি বানাও’ বেশ জনপ্রিয়তা পায়্।

মুক্তিযুদ্ধের অন্য কয়েকটি ছবির মতো এ ছবিরও সংলাপ ও চিত্রনাট্য দুর্বল। তবে যুদ্ধদিনের ছবির আলাদা আবেদন অবশ্যই আছে। সেদিক থেকে দেখলে এ ছবিগুলো ইতিহাসের দলিল। ‘রক্তাক্ত বাংলা’ আমাদের মহান  মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনগুলোর স্মৃতিবাহী। ছবিটি ইউটিউবসহ বিভিন্ন সাইটে রয়েছে। দর্শকদের স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে ‘রক্তাক্ত বাংলা’।