স্বর্ণযুগের অগ্নিসাক্ষী সুভাষ দত্ত

বলিউডের ছবির রিমেইক নয়, ধুমধাড়াক্কা মারপিট ও উদ্ভট নাচ গান নয়,  বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নয় এবং শুধুমাত্র বোদ্ধা দর্শকের জন্যও নয়,  বাংলাদেশের মানুষের জীবনের গল্প সাদামাটা ভাষায় সাধারণ মানুষের জন্য তখন ফুটিয়ে তোলা হতো রূপালি পর্দায়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সেই স্বর্ণযুগের এক সফল কিংবদন্তি সুভাষ দত্ত।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Nov 2016, 02:58 AM
Updated : 16 Nov 2016, 02:58 AM

‘সুতরাং’, ‘বিনিময়’, ‘ডুমুরের ফুল’, ‘বসুন্ধরা’র মতো চিরায়ত ছবি যিনি নির্মাণ করেছেন সেই নির্মাতা সুভাষ দত্ত ষাটের দশকের প্রথমদিকে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন।

১৯৩০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তার জন্ম। বগুড়ার চকরতি গ্রামের অভিজাত দত্ত বাড়ির ছেলে শ্রী সুভাষ চন্দ্র দত্ত পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে ভারতের মুম্বাইতে চলে যান সিনেমার কাজ শেখার জন্য। সেখানে ৩০ টাকা মাসিক বেতনে কাজ শুরু করেন। সে সময় অভিজাত বাঙালি ঘরের কোনো তরুণের পক্ষে এটি ছিল যথেষ্ঠ দুঃসাহসের কাজ। কিন্তু চলচ্চিত্রের প্রতি অকৃত্রিম প্রেম থেকেই সুভাষ দত্ত এই ঝুঁকিটি নিয়েছিলেন। সেই প্রেম তিনি ধরে রেখেছিলেন আমৃত্যু।

তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘সুতরাং’ মুক্তি পায় ১৯৬৪ সালে। এর আগে ১৯৫৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমার পোস্টার ডিজাইন করেন তিনি। ভারত থেকে ফিরে ১৯৫৩ সালে যোগ দেন চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এভারগ্রিন-এ। ১৯৫৮ সালে প্রথম অভিনয় করেন এহতেশাম পরিচালিত ‘এদেশ তোমার আমার’ ছবিতে।

এরপর অভিনয় করেন মুস্তাফিজ পরিচালিত বাণিজ্যিকভাবে দারুণ সফল ‘হারানো দিন’ ছবিতে।

‘সুতরাং’ ছবিতে পরিচালক ও অভিনেতা সুভাষ দত্তর হাত ধরেই রূপালি জগতে পা রাখেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মহাতারকা কবরী। এখানে কবরীর বিপরীতে অভিনয় করেন তিনি।

কবরীর বিপরীতে আরেকবার তিনি অভিনয় করেন ‘বিনিময়’ চলচ্চিত্রে। ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ ছবিতে কবরী ছিলেন বাক প্রতিবন্ধী এক তরুণীর ভূমিকায়। সেই তরুণীর স্বামী এবং ছবির নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন উজ্জ্বল। সুভাষ দত্ত অভিনয় করেন এমন এক তরুণের চরিত্রে যে ভালোবাসে ওই বাকপ্রতিবন্ধী মেয়েটিকে। এবং তারই সহায়তায় মেয়েটি ফিরে পায় স্বামী ও সংসার। চলচ্চিত্রটি ব্যবসা সফল হয়। এই ছবির একটি গান ‘জানতাম যদি, শুভংকরের ফাঁকি, আমার ঘরে পড়তো না হায় শূন্য’ দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।

পর্দায় গানটির দৃশ্যে অভিনয় করেন সুভাষ দত্ত। বস্তুত, নায়কের চেয়ে তার অভিনীত চরিত্রটিই ছিল বেশি মনোগ্রাহী। এ ছবির পরিচালকও তিনিই ছিলেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর হাতে বন্দী হন সুভাষ দত্ত। উর্দু-বাংলা ছবিতে অভিনয়ের সুবাদে তিনি তখন পরিচিত মুখ। এই অভিনেতা খ্যাতির কারণেই বন্দীদশা থেকে মুক্তি পান তিনি।

জীবনের এই ঘটনাটি তিনি তুলে ধরেন ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ ছবির কাহিনীতে।

১৯৭২ সালে মুক্তি পায় সুভাষ দত্তর সেরা কাজ ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’। এ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন ববিতা, উজ্জ্বল, আানোয়ার হোসেনসহ অনেকে। সুভাষ দত্ত নিজেও ছবির একটি চরিত্রে অভিনয় করেন। এ ছবিতেই রয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিখ্যাত গান ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’। এ ছবিতে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের নির্মম নির্যাতনের শিকার নারীদের যন্ত্রণা এবং যুদ্ধের পর সমাজে তাদের পুনর্বাসনের প্রসঙ্গ সাহসের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। যুদ্ধশিশুর অধিকারের বিষয়টিও প্রথমবারের মতো তিনিই তুলে ধরেন।

এখানে অভিনেতা আনোয়ার হোসেন স্বনামে একজন অভিনেতার চরিত্রেই রূপদান করেন। সেই চরিত্রেই সুভাষ দত্ত নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বন্দীদশার বিষয়টি তুলে আনেন। ছবিটির বক্তব্য এবং পরিচালনা ছিল অসাধারণ।

১৯৭৭ সালে মুক্তি পায় সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘বসুন্ধরা’।  এ ছবিতে প্রধান দুটি চরিত্রে ছিলেন ববিতা ও ইলিয়াস কাঞ্চন। আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখা ‘২৩ নং তৈলচিত্র’ অবলম্বনে নির্মিত ‘বসুন্ধরা’ ছিল শিল্পোত্তীর্ণ একটি ছবি। এর গান অভিনয় ও পরিচালনাও ছিল অনবদ্য। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আসরে সেরা পরিচালনাসহ পাঁচটি পুরস্কার জয় করে ‘বসুন্ধরা’।

তার পরিচালিত ‘ডুমুরের ফুল’ ছবিটি নির্মিত হয় ড.আশরাফ সিদ্দিকীর লেখা গল্প ‘গলির ধারে ছেলেটি’ অবলম্বনে। ‘ডুমুরের ফুল’ ছবিতে মাস্টার শাকিল ও ববিতার অভিনয় দারুণ প্রশংসিত হয়।

সুভাষ দত্ত পরিচালিত অন্যান্য ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘আবির্ভাব’, ‘কাগজের’ ‘নৌকা’, ‘আয়না ও অবশিষ্ট’, ‘পালাবদল’,  ‘আলিঙ্গন’,  ‘আকাঙ্খা’,  ‘সকালসন্ধ্যা’,  ‘ফুলশয্যা’, ‘সবুজসাথী’, ‘নাজমা’, ‘স্বামীস্ত্রী’ ইত্যাদি। তার পরিচালিত শেষ ছবি ‘ও আমার ছেলে’ মুক্তি পায় ২০০৮ সালে।

তিনি সব ছবিতে মানুষের জীবনের সাধারণ আবেগ, ভালোবাসা, যন্ত্রণা, মূল্যবোধের গল্পই বলেছেন। তিনি বাণিজ্যিক ঘরানার ছবিই নির্মাণ করেছেন এবং সেখানে সাধারণ মানুষকে বিনোদন দিয়েছেন। কিন্তু সেই বিনোদনের ভিতরেই শিল্প ও মূল্যবোধ প্রতিফলিত হযেছে পূর্ণমাত্রায়।

সুভাষ দত্ত মঞ্চ নাটক ও চলচ্চিত্রের একজন সফল অভিনেতাও ছিলেন। তার অভিনীত ব্যবসা সফল ছবির মধ্যে রয়েছে ‘রাজধানীর বুকে’, ‘চান্দা’, ‘তালাশ’, ‘নদী ও নারী’, ‘হারানো সুর’, ‘পালাবদল’ ইত্যাদি। নিজের পরিচালিত প্রায় সব ছবিতেই তিনি পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি সাধারণত কমেডি ধাঁচের চরিত্রে বেশি জনপ্রিয়তা পান। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে সুভাষ দত্ত একুশে পদকে   ভূষিত হন।

২০১২ সালের ১৬ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন এই চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে সুভাষ দত্ত ছিলেন একাই একটি প্রতিষ্ঠান। তার সমগ্র জীবন তিনি উৎসর্গ করেছিলেন এদেশের চলচ্চিত্রের জন্য। অভিনয়, পরিচালনা, প্রযোজনা, চিত্রনাট্য ও শিল্পনির্দেশনায় তিনি একই সঙ্গে সাফল্যের পরিচয় রেখেছেন।

সুভাষ দত্ত চলে গেছেন মৃত্যুর যবনিকার আড়ালে। কিন্তু এদেশের চলচ্চিত্র জগতে তিনি অমর হয়ে আছেন তার কালজয়ী সৃষ্টির মাঝে।