ভেলকি দেখাল ‘আয়নাবাজি’

অমিতাভ রেজা চৌধুরি- এক নামেই চেনেন সবাই তাকে। বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে নাটক- যাতেই হাত দেন, সোনা ফলান। গুণী এ নির্মাতা এবারে হাত দিলেন ছবি তৈরির কাজে। আর তাতেই বদলে গেল ঢাকাই ছবির স্বাদ!

প্রমা সঞ্চিতাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Oct 2016, 11:17 AM
Updated : 4 Oct 2016, 12:37 PM

এ যেন এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। অভিষেক ছবিতেই এমন বড় সাফল্য আজ পর্যন্ত খুব বেশি পরিচালকের ভাগ্যে জোটেনি। জি, বলছিলাম অভিতাভ রেজা চৌধুরীর ‘আয়নাবাজি’র কথা।

এ মুহূর্তে ঢাকাই চলচ্চিত্র যে ‘আয়নাবাজি’র ভেলকিতে মাতোয়ারা সে কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। একের পর এক হাউজফুল শো, টিকেট না পেয়ে হল থেকে হলে ছুটে বেড়ানো- এমনটা কি ক’দিন আগেও কল্পনা করেছে কেউ? ভালো ছবি হলে যে দর্শক হলমুখি হবেই- তাই যেন নতুন করে আবারও প্রমাণ করে দেখালেন অভিতাভ রেজা চৌধুরি ও তার ‘আয়নাবাজি’র দল।

‘লাগ ভেলকি...লাগ ভেলকি...আয়নাবাজির ভেলকি লাগ!’- ট্রেলারে এই গান শুনেই ভেলকি লেগেছিলো দর্শকের মনে। তখন থেকেই মনে মনে সবাই ভাবছিলেন এবার কি তবে সত্যিই একটি ভালো ছবির দেখা মিলবে?

গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় সে ভরসা কিন্তু সহজেই মিলছিলো না। টান-টান উত্তেজনায় ভরা ট্রেইলার, ঝকঝকে প্রিন্ট আর গ্ল্যামারাস হিরো-হিরোইন দেখে চটক অনেকবারই লেগেছে চোখে; কিন্তু ছবি শেষে মনে হয়েছে টিকেটের পুরো টাকাটাই নষ্ট।

‘আয়নাবাজি’র ট্রেইলার দেখে খুশি হলেও মনের মাঝে কোথায় যেন লুকিয়ে ছিল সন্দেহের কালো মেঘ। শেষ পযন্ত সত্যিই ভালো কিছু পাওয়া যাবে তো? সন্দেহের সে মেঘ এক ঝটকাতেই উড়িয়ে দিয়েছে সিনেমাটি। ‘আয়নাবাজি’ দেখে আর যাই হোক, পয়সা উসুল হয়েছে ঠিকই- এ মন্তব্য করেছেন সিনেমা হলে উপস্থিত প্রায় প্রতিটি দর্শকই।

‘আয়নাবাজি’ ছবিটি নির্মিত হয়েছে ছবির প্রধান চরিত্র আয়নাকে ঘিরে। আয়না- যার পুরো নাম শরাফত করিম আয়না (চঞ্চল চৌধুরি), পেশায় একজন সাধারণ অভিনয় শিক্ষক। পাড়ার স্কুলে বাচ্চাদের সে নাটক শেখায়। কিন্তু মাঝে মাঝেই এক-দুই মাসের জন্য উধাও হয়ে যায় সে। কারণ হিসেবে সবাইকে জানায় জাহাজে রান্নার কাজ করে অর্থাৎ সে একজন ‘কুক’।

কিন্তু সাধারণ এক ‘কুক’-এর আড়ালে লুকিয়ে আছে আয়নার অন্য আরেকটি পরিচয় যেটি কেউ জানে না। ঘটনাচক্রে ক্রাইম রিপোর্টার সাবেরের (পার্থ বড়ুয়া) নজরে পড়ে যায় আয়না। খবরের অনুসন্ধানে আয়নার পিছু নেয় সাবের।

এদিকে পাড়ায় নতুন আসা ভাড়াটিয়া হৃদির (মাসুমা রহমান নাবিলা) সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে আয়নার। একসঙ্গে বাচ্চাদের নাটক শেখাতে গিয়ে একে অন্যের প্রেমে পড়ে যায় তারা। হৃদির প্রতি ভালোবাসার টানে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায় আয়না।

এরমধ্যেই ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে। একটি মিথ্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ হয় আয়নার। এখন কে বাঁচাবে আয়নাকে? আয়না কি মরে যাবে নাকি তার ভেলকিবাজির জাদুতে বের হয়ে আসবে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে? এমনই এক রহস্যময় ও উত্তেজনায় মোড়া গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘আয়নাবাজি’ ছবিটি। শেষ পযন্ত কি হল আয়নার পরিণতি- তা জানতে হলে দেখতে হবে পুরো ছবিটি।

‘আয়নাবাজি’র প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরি। মঞ্চ ও টিভি নাটক- দু’জায়গাতেই দুর্দান্ত জনপ্রিয় চঞ্চল চৌধুরীকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। আয়নার বিভিন্ন অবস্থার প্রতিটা দৃশ্যেই তার অভিনয় ছিল অসম্ভব নিঁখুত। দেখে একবারো মনে হয়নি তিনি অভিনয় করছেন।

‘আয়নাবাজি’তে চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয় মনে করিয়ে দেবে জনি ডেপের ‘চরিত্র-নির্ভর’ সিনেমাগুলোর কথা; যেখানে চরিত্রের গভীরে এতোটাই ডুবে যান তিনি, যে দেখে বোঝার উপায় থাকেনা ডেপ আসলে অভিনয় করছেন!

বাড়তি পাওনা হিসেবে ছিল চঞ্চলের সংলাপ বলার বিশেষ ভঙ্গি ও দর্শক হাসানোর ক্ষমতা। পর্দায় চঞ্চলকে দেখানো মাত্রই দর্শকের হাততালি ও উল্লাস-ধ্বনি যেন সে কথারই সাক্ষ্য দেয়।

চঞ্চল চৌধুরীর বিপরীতে নাবিলার অভিনয় ছিল বেশ সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত। রোমান্টিক সিনে দু’জনের রসায়ন, বিশেষ করে চুম্বন দৃশ্যে নাবিলার অভিনয় ছিল সাহসী। সাংবাদিক চরিত্রে পার্থ বড়ুয়ার অভিনয়ও ছিল বিশ্বাসযোগ্য। একরোখা, মদ্যপ ও বিষন্ন এক সাংবাদিকের চরিত্র সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।

দুশ্চরিত্র ব্যবসায়ীর চরিত্রে লুৎফর রহমান জর্জ এর চরিত্র নজর কড়েছে সবার। এছাড়া কমেডি চরিত্রে জামিলের অভিনয় ও স্টুডিও মালিকের চরিত্রে গাউসুল আজম শাওন ছিল বেশ মানানসই। অতিথি চরিত্রে পর্দায় আরেফিন শুভকে দেখে দর্শকের জোড় করতালি বুঝিয়ে দিয়েছে তিনি সকলের কতটা প্রিয়! মোট কথা কারও অভিনয়ই অতিরঞ্জিত মনে হয়নি বরং চরিত্রের প্রয়োজনে প্রত্যেকের অভিনয়ই ছিল যথাযথ।

এ ছবির অন্যতম সম্পদ হলে এর শিল্প নির্দেশনা ও দৃশ্যধারণের কাজ। চিত্রগ্রাহক রাশেদ জামানের দক্ষতা ও মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া গেছে বেশ কিছু নান্দনিক দৃশ্যে। আয়নার বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্যগুলোতে ছিল অদ্ভুত এক জাদু-বাস্তবতার আবেশ।

সূচনা সংগীতে অর্ণবের ‘প্রাণের শহর’ গানটির দৃশ্যধারণের কাজেও ছিল বেশ স্নিগ্ধতা ও মায়াময়তার ছোঁয়া। এছাড়া চঞ্চল-নাবিলার চুম্বন দৃশ্যটাকে আবেগময় ও রোমান্টিকভাবে পর্দায় উপস্থাপনের কৃতিত্ব অনেকাংশেই যাবে চিত্রগাহকের ঝুলিতে।

ছবিটির কারিগরি দিকটি ছিল বেশ নিখুঁত। শব্দ ও সম্পাদনার কাজে ছিল দক্ষতার ছাপ। ছবির সুন্দর প্রিন্ট, স্পষ্ট সংলাপ ও আহব-শব্দে ব্যবহার ছিল উন্নতমানের। বেশ কিছু দৃশ্যে ড্রোনের ব্যবহার ছিল চমকপ্রদ।

তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্যামেরা অ্যঙ্গেল ও পর্দার আনুপাতিক পরিমাপের কারণে সিনেম্যাটিক ফিলের জায়গায় দৃশ্যগুলোকে টিভি নাটকের মতো মনে হয়েছে। বড় পর্দায় অমিতাভ রেজার এটাই প্রথম কাজ- এটা বোঝা গেছে ভালোভাবেই। তবে অসাধারণ গল্প ও রহস্যের মোচরে ভরপুর চিত্রনাট্য ও সংলাপ সে ত্রুটিটুকু ঢেকে দিয়েছে।

সিনেমা শেষে ‘বিহাইন্ড দ্য সিন’ এ নানা মজার ঘটনা দেখিয়ে ছবিটির ইতি টানা হয়েছে। এটিও বাংলা সিনেমায় মোটামুটিভাবে নতুন। বিদেশি ছবির আদলে ক্রেডিট লাইনের মাঝে মাঝে একটি করে ঘটনার দৃশ্য দর্শকের মাঝে ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’- এমন একটি অনুভূতি এনে দেবে!

ছবির গানগুলো ছিল বেশ আকর্ষণীয় ও ঘটনার সঙ্গে সদৃশ্য। ছবির আবহসংগীতের কাজ করেছেন পশ্চিমবঙ্গে ইন্দ্রদীপ। শুরুতেই অর্ণবের ‘প্রাণের শহর’ ছড়িয়েছে মুগ্ধতা। জেলখানার দৃশ্যে চিরকুটের ‘দুনিয়া’ গানটি ছিল একবারেই আলাদা। এ গানের শিল্প নিদেশর্না, কোরিওগ্রাফি, নাচ -প্রতিটিতেই ছিল নতুনত্বের ছোঁয়া। সিচুয়েশনাল সং হিসেবে শতভাগ সফল বলা যাবে গানটিকে।

রোমান্টিক দৃশ্যে হাবিব-অন্বেষা জুটির ‘ধীরে ধীরে যাও সময়’ গানটিও ছড়িয়েছে ভালোলাগার আবেশ। সর্বোপরি ফুয়াদের ‘লাগ ভেলকি’ গানের ভেলকি দিয়ে শেষ হয় ছবির জমজমাট এ সংগীত-আয়োজন।

দর্শক মাতাতে হলে যে যৌনউত্তেজনায় ভরপুর ‘আইটেম গান’ রাখতে হয়- এ কথাকে পুরোপুরি মিথ্যা প্রমাণ করলো ‘আয়নাবাজি’র গান। পাশের দেশের অনুকরণে উত্তেজক নাচ-গান নির্ভর ছবির বিপরীতে দেশীয় শিল্পীদের দিয়ে, স্বদেশী আমেজেই যে ভালো কাজ সম্ভব সে কথাই প্রমাণ করে দিয়েছে আয়নাবাজি।

বাংলা ছবির আরেকটি বড় দুর্নাম ছিল এর কাহিনীর বৈচিত্রহীনতা। সব ছবিতেই গড়পড়তা প্রেমের কাহিনী বলে যাওয়া হয়। এ ছবির গল্প চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে সে অভিযোগকেও। গৎবাঁধা প্রেমের গল্প ছাড়াও যে দর্শক-প্রিয় ছবি উপহার দেওয়া সম্ভব তাই দেখিয়ে দিলেন নির্মাতা।

বিগত কয়েক বছর ধরে ঢাকাই ছবিতে ‘যৌথ প্রযোজনা’র আগ্রাসনে ‘আমাদের’ গল্প বলা সিনেমার বেশ অভাব দেখা যাচ্ছিলো। অবস্থাদৃষ্টে মনেই হচ্ছিল যে পাশের দেশকে অণুসরণ করা ছাড়া আমাদের চলচ্চিত্রের যেন গতান্তর নেই। কিন্তু ভালো গল্প ও ভালো নির্মাণ হলে সে ছবি যে দর্শক লুফে নেবে- এ কথা প্রমাণের জন্য এগিয়ে আসছিলেন না কোনো কাণ্ডারী।

অবশেষে বাংলা ছবির দর্পনে যেন এক টুকরা আলোর ঝলকানি হয়েই এল ‘আয়নাবাজি’। এখন বক্স অফিসে কতটা ভেলকি দেখাতে পারে অভিতাভের ‘আয়নাবাজি’ সেটিই দেখার বিষয়।