ভারতের এসকে মুভিজ ও বাংলাদেশের জাজ মাল্টিমিডিয়ার যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘রক্ত’। বড় বাজেটের এই ছবির ট্রেইলারে পরীমণির মারকুটে অবতারে আশান্বিত হয়েছিলেন অনেকেই; ভেবেছিলেন হয়তো এবারে নতুন কিছু পেতে যাচ্ছে বাংলা ছবি। গল্পের বিন্যাসে সে আভাস পাওয়া গেলেও নির্মাণ ত্রুটি ও অপরিপক্ক অভিনয় নষ্ট করেছে সে সম্ভাবনাকে। ফলাফল-- সেই নতুন বোতলে পুরনো মদের মতোই।
নারী প্রধান এ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন আলোচিত নায়িকা পরীমণি। নায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটেছে রোশান রিক্তের। গুরুত্বপূর্ণ কিছু চরিত্রে ছিলেন অমিত হাসান, নাদের চৌধুরী ও ভারতের আশীষ বিদার্থী ও বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতারাও। এরপরও নির্দেশনার অদক্ষতায় জমজমাট একটি অ্যাকশন-থ্রিলারের জায়গায় ‘রক্ত’ পরিণত হয়েছে দুর্বল এক মেলোড্রামায়।
এ ছবির মাধ্যমে প্রথমবারের মতে জাজের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন বাংলা ছবির জনপ্রিয় অভিনেত্রী পরীমণি। এটি তার প্রথম অ্যাকশন ছবিও বটে। অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে পরীমণির পোশাক-আশাক মনে করিয়ে দেবে ‘টুম্ব রাইডার’-এর লারা ক্রফটরূপী অ্যাঞ্জেলিনা জোলির কথা।
চোখের দেখায় দুই হাতে বন্দুক ছোঁড়া, উঁচু বুট ও আটোসাঁটো পোশাকে চমৎকার মানিয়ে গেছেন পরীমণি। কিন্তু সমস্যা বেঁধেছে অন্যখানে। অ্যাকশন হিরোইন হিসেবে প্রয়োজনীয় কাঠিন্য দেখা যায়নি পরীর চোখে-মুখে। অভিনয়েও ছিল না বলিষ্ঠতা। এছাড়া দৃশ্য অনুসারে অভিব্যক্তি প্রকাশে তেমন দক্ষতা দেখাতে পারেনি তিনি। ইংরেজি বাক্যালাপে পরীর অনভ্যস্ততাও অনেকাংশেই নষ্ট করেছে সানিয়া চরিত্রটির বিকাশের সম্ভাবনা।
ছবিতে কিছুটা ‘পুতুল নায়ক’ হিসেবেই রোশানকে উপস্থাপন করেছেন পরিচালক। অথচ রোশান চরিত্রটিকে আরো দৃঢ় ও শক্তিশালীভাবে দেখানো সম্ভব ছিলো। নাচ ও অভিনয়ে তেমন একটা পারদশির্তা দেখাতে না পারলেও পরীর প্রেমিক হিসেবে মোটামুটি মানিয়ে গেছেন তিনি।
অমিত হাসান ও আশীষ বিদ্যার্থী অনেকদিন ধরেই জাজ মাল্টিমিডিয়া ও এককে মুভিজ-এর বাঁধা খল চরিত্রের অভিনেতা। অন্যান্যবার গল্পের প্রযোজনে সঠিক সময়ে সঠিক চমক আনতে পারলেও ‘রক্ত’-এর বেলায় কেন যেন মিইয়ে গেলেন তারা। ভিলেনের ভূমিকায় নতুন কিছু করে দেখাতে এবার পুরোপুরিই ব্যর্থ এই দু’জন।
সানিয়ার পুরনো স্যুটকেসে টাকার বদলে দেখা গেছে ভারতীয় রুপি অথচ তার গাড়ির নম্বর প্লেটে লেখা ‘ঢাকা মেট্রো’। ওদিকে পুরো ছবিতেই দেশপ্রেম নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও স্পষ্ট করে কোথাও বলা হয়নি এটা কোন দেশ। অর্থাৎ ছবির ঘটনাটি ভারতের নাকি বাংলাদেশের সেটা পরিস্কার হয়নি ছবির শেষ পর্য্ন্ত।
ছবিতে বেশ কিছু নির্মাণগত ত্রুটি ছিলো যা একটি বাণ্যিজিক ছবির জন্য অনেক বড় বিষয়। পানির নিচের একটি দৃশ্যে ক্যামেরা ক্রু’র হাত দেখা গেছে বেশ ভালোভাবে। এছাড়াও একটি দৃশ্যে সানিয়াকে ‘সোনিয়া’ বলে সম্বোধন করেছেন অভিনেতা অমিত হাসান।
উচ্চারণগত কিছু ভুল বেশ কানে লেগেছে। ডেটোনেটরকে বলা হয়েছে ‘ডেটর-নেটর’; আবার গোটা সিনেমায় চলতি ভাষায় কথা বললেও একটি দুশ্যে নায়ক রোশান সংলাপ আওড়েছেন সাধু ভাষায়! এসব ছোট-খাটো ভুল একজন পরিচালকের অনভিজ্ঞতা ও অদক্ষতারই পরিচয় দেয় যা মূলধারার বাণ্যিজ্যিক ছবিতে কখনোই কাম্য নয়।
‘রক্ত’ সিনেমার সবচেয়ে সফল দিক হলো এর গল্প। তবে তা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। ১৯৯৬ সালের এক হলিউডি ছবির হুবুহু নকলের অভিযোগ দিয়েছেন অনেকেই। রেনি হারলিন এর ‘দ্য লং কিস গুডনাইট’ ছবিটির সাথে যথেষ্টই মিল খুঁজে পাওয়া যাবে এ ছবির গল্পের। কিন্তু ছবির শুরু বা শেষে কোথাও কোনো ক্রেডিট লাইনে তা উল্লেখ করা হয় নি। প্রশ্নটা তাই স্বাভাবিক, হিন্দি ও তামিল ছবির পর এবার কি তবে হলিউড ছবি থেকে কাহিনী চুরির কালচার শুরু হলো?
অনেক ভুল-ভ্রান্তি সত্ত্বেও পরীমণির গ্ল্যামারাস উপস্থিতি ও আইটেম গান ‘ডানা-কাটা পরি’র সুবাদে অনেকটাই উৎরে গেছে ‘রক্ত’। রোমান্টিক দৃশ্যে রোশান-পরীর সাবলীল অভিনয়ও বাংলা সিনেমায় বেশ বিরল! বিশেষ করে পরীমণির স্নান দৃশ্য ও খোলা পিঠ-এর আবেদনময় দৃশ্যধারণ ছিলো যথেষ্টই প্রশংশনীয়।
বড় বাজেটের ছবি হিসেবে সুন্দর লোকেশন, ভালো সিনেমাটোগ্রাফি, ঝকঝকে প্রিন্ট- সবই ছিলো ‘রক্ত’-এ। শুরু থেকেই এ ছবির বিশেষ আকর্ষণ ছিলো পরীমণির আবেদনময়ী পর্দা উপস্থিতি ও রোশানের হ্যান্ডসাম লুক যা কিনা ছবির নির্মাণ ত্রুটি ও দুর্বল অভিনয়ের ঘাটতি পুষিয়ে দিয়েছে অনেকাংশে।
তারপরেও শেষ রক্ষা হলো কি? সিনেমা চলার সময়ে হলে তেমন সাড়া মেলেনি দর্শকদের। সিনেমা শেষ না হওয়া পর্য্ন্ত হল ছেড়ে কেউ বেরিয়ে না গেলেও ছবি দেখে মন ভরেনি বলেই মন্তব্য করেছেন অনেকেই।