খেলা যখন বড়পর্দায়

প্রেম ভালোবাসা কিংবা অ্যাকশন সিনেমাগুলোর মতোই যুগযুগ ধরে রুপালি পর্দায় বার বার ফিরে এসেছে ‘ক্রীড়া’। কখনো হয়তো শুধুই সংশ্লিষ্ট খেলাটি, কখনোবা ঐতিহাসিক ক্রীড়াব্যক্তিত্বদের জীবনকে উপজীব্য করে নির্মিত এই সিনেমাগুলোর বেশিরভাগই গড়েছে নতুন ইতিহাস।

নাসির রায়হানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 August 2016, 08:59 AM
Updated : 12 August 2016, 09:24 AM

হলিউড হোক, আর বলিউড, এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই কেউই। আজন্ম দর্শকমনে ‘হিরো’ হয়ে থাকা এরকম ক্রীড়াবিদদের পর্দার সংস্করণটিকেও সমানতালে ভালোবেসেছেন দর্শকরা, যার কারণে এই ঘরানার সিনেমাগুলো ব্যবসায়িক বিবেচনায়ও সাধারণত যথেষ্ঠ সফল।

হলিউড এবং বলিউড  মিলিয়ে এইরকম কিছু অসাধারণ ‘স্পোর্টস সিনেমা’ নিয়ে থাকছে এই আয়োজনে।

মিলিয়ন ডলার বেবি

স্বনামধন্য ‘ওয়েস্টার্ন’ নির্মাতা ক্লিন্ট ইস্টউড এর বর্ণিল ক্যারিয়ারের সাক্ষী ‘মিলিয়ন ডলার বেবি’। ২০০৪ সালে নির্মিত সিনেমাটি মূলত ‘স্পোর্টস ড্রামা’ ঘরানার যেখানে অভিনয় করেন স্বয়ং ইস্টউড, হিলারি সোয়াঙ্ক এবং মর্গান ফ্রিম্যান-এর মতো তারকারা।

‘মিলিয়ন ডলার বেবি’ গল্প বলে প্রাপ্য মর্যাদা না পাওয়া অভিজ্ঞ এক বক্সিং ট্রেইনার এর। নিজের অতীতের ভুলগুলো যাকে তাড়িয়ে বেড়ায় প্রতিনিয়ত। এর থেকে বাঁচার উপায় খুঁজতে গিয়ে যিনি ঘটনাক্রমে পরিচিত হন আনাড়ি কিন্তু স্বাপ্নিক এক নারী বক্সার ম্যাগি ফিটজেরাল্ড এর সঙ্গে। শুরু হয় ম্যাগিকে নিয়ে তার স্বপ্নযাত্রার।

‘কাটম্যান’ খ্যাত বিখ্যাত ‘ফাইট ম্যানেজার’ জেরি বয়েড-এর ছোট গল্পকে সিনেমার গল্পের রূপ করেন পল হ্যাগিস।

মুক্তির পর সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসা আর দর্শকদের ভালোবাসায় ভেসে যায় সিনেমাটি, সঙ্গে বোনাস হিসেবে ‘মিলিয়ন ডলার বেবি’র খাতায় যুক্ত হয় চারটি অস্কার। হিলারি সোয়াঙ্ক গড়েন ইতিহাস, ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বারের মতো জিতে নেন সেরা অভিনেত্রীর অস্কার ট্রফি।

লাগান

বলা হয়ে থাকে, ভারতীয়রা বাঁচে ক্রিকেটে, আর স্বপ্ন দেখে সিনেমায়। আর তাই, আমির খান-এর মতো শক্তিশালী অভিনেতাকে সঙ্গে নিয়ে আশুতোষ গোয়াড়িকার যখন ক্রিকেটকে তুলে আনলেন বড়পর্দায়, তখন সেই সিনেমা ইতিহাস সৃষ্টি করবে, সেটাই ছিল স্বাভাবিক।

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজত্বের সময়কার কথা। ভারতের অনুর্বর এক গ্রামের কৃষকরা তোপের মুখে পড়ে ব্রিটিশ শাসকদের। কারণ আর কিছু নয়! ঠিকমতো ফসল না ফলায় ঐ সময় কর দিতে ব্যর্থ হয় অধিকাংশ গ্রামবাসী। কোনমতেই গ্রামের কৃষকদের কথা শুনতে রাজি নয় ব্রিটিশ বেনিয়ারা। তবে নতুন এক প্রস্তাব নিয়ে আসলেন তাদের একজন। সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশদের একটি ক্রিকেট দলকে খেলে পরাজিত করতে হবে কৃষকদের। তবেই মাফ করা হবে তাদের তিন বছরের বকেয়া কর। অদ্ভুত আর সম্পূর্ণ নতুন এই খেলার আগাগোড়া কিছু ঠিকঠাক না বুঝলেও ভাগ্যকে সঙ্গী করে নেমে যায় কৃষকদল। এই এক জয়ই যে লিখতে পারে তাদের নতুন ভাগ্য।

সমালোচকদের ব্যাপক প্রসংশা পায় ‘লাগান’। দেশে বিদেশে অনেল পুরস্কার ও ছিনিয়ে আনে সিনেমাটি। তবে ‘লাগান’ এর সবচেয়ে বড় অর্জন ‘সেরা বিদেশী ভাষার সিনেমা’ কোটায় একটি অস্কার মনোনয়ন, যা এর আগে মাত্র দুটি ভারতীয় সিনেমার ভাগ্যে জুটেছিল। ১৯৫৭ এর ‘মাদার ইন্ডিয়া’ আর ১৯৮৮ সালের ‘সালাম বোম্বে’। ব্যবসার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সফল সিনেমাটি। ২০০১ সালের অন্যতম সেরা বক্স অফিস হিট ও ছিলো ‘লাগান’।

রেইজিং বুল

১৯৮০ সালের আমেরিকান সাদাকালো জীবনী নির্ভর ‘স্পোর্টস ড্রামা’ ‘রেইজিং বুল’। পরিচালনা করেন প্রথিতযশা নির্মাতা মার্টিন স্করসেসি যিনি কিনা এর আগে একবার নিজে থেকেই স্বীকার করেন যে বক্সিং নিয়ে তার জ্ঞান প্রায় শুন্যের কোঠায়। যদিও পরবর্তীতে তার হাত দিয়েই নির্মান হয় সিনেমা ইতিহাসের অন্যতম সেরা বক্সিং কেন্দ্রিক সিনেমাটি। 

জেইক লামোটা’র আত্মজীবনী ‘রেইজিং বুলঃ মাই স্টোরি’ কে সিনেমায় রুপদান করেন পল শ্রেডার আর মার্ডিক মার্টিন, প্রযোজনা করেন রবার্ট চার্টোফ এবং ইরউইন উইঙ্কলার। সিনেমাটির কেন্দ্রিয় চরিত্র লামোটা’র ভুমিকায় অভিনয় করেন রবার্ট ডে নিরো। অনন্য সাধারণ এই বক্সারের অনিয়ন্ত্রিত রাগ আর হিংসা এক সময় ধ্বংস করে দেয় তার ক্যারিয়ারকে। পার্শ্বচরিত্রে সিনেমাটিতে আরো অভিনয় করেন নিকোলাস কোলান্যান্টো, থেরেসা সালদানা এবং ফ্র্যাঙ্ক ভিন্সেন্ট।

অতিরিক্ত সহিংসতা প্রদর্শনের অভিযোগে গুটিকয়েক সমালোচকের তোপের মুখে পড়লেও, অ্যাকাডেমিতে ঠিকই সাড়া ফেলে ‘রেইজিং বুল’, দখল করে নেয় আটটি অস্কার মনোনয়ন। সেরা অভিনেতা হিসেবে পরবর্তীতে অস্কার জয়ও করে নেন রবার্ট ডে নিরো। সেইসঙ্গে সেরা সম্পাদনার অস্কারটিও যায় ‘রেইজিং বুল’-এর দখলে।

রকি

১৯৭৬ সালের ‘স্পোর্টস ড্রামা’ ঘরানার এই সিনেমাটি পরিচালনা করেন জন জি অ্যাভিল্ডসেন। সিনেমার গল্প লেখা এবং কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘রকি বালবোয়া’র ভূমিকায় অভিনয় দুটোই করেন সিলভেস্টার স্ট্যালোন।

অশিক্ষিত হয়েও দয়ালু এক শ্রমিকশ্রেণীর বক্সার রকি বালবোয়া। কাজ করতেন ফিলাডেলফিয়ার বস্তিগুলো থেকে নিম্নজীবি মানুষগুলোর কর্জ আদায়ের। বক্সিংয়ে তার আগমন সাধারণ এক ‘ক্লাব ফাইটার’ হিসেবে; কিন্তু তার নৈপূণ্য ধীরে ধীরে তাকে নিয়ে যায় ‘ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশীপ পর্যন্ত।

দুনিয়াজোড়া সাড়া জাগানো এই সিনেমাটির আরো ছয়টি সিক্যুয়েল আসে বিভিন্ন সময়ে, যার মধ্যে চারটি আবার পরিচালনা করেন ‘রকি’র মাধ্যমে জীবন বদলে যাওয়া সিলভেস্টার স্ট্যালোন। কিন্তু রকি’র অবস্থান সবসময়ে আর সবার আগে।

অস্কারের ৪৯ তম আসরে নয়টি শাখায় মনোনয়ন পায় ‘রকি’, যার মধ্যে জয় করে নেয় তিনটি অস্কার।

ভাগ মিলখা ভাগ

‘দ্য ফ্লাইং শিখ’ নামে খ্যাত কিংবদন্তি ভারতীয় দৌড়বিদ মিলখা সিং-এর জীবনী অবলম্বনে নির্মিত সিনেমা ‘ভাগ মিলখা ভাগ’। অলিম্পিক বিজয়ী এই খেলোয়াড়ের জীবনের অসাধারণ গল্পকে রুপালি পর্দায় নিয়ে আসেন ফারহান আখতার। প্রযোজনার পাশাপাশি সিনেমাটির নাম ভূমিকায়ও অভিনয় করেন জাভেদ আখতার পুত্র। প্রাসুন যোশির চিত্রনাট্য, রাকেশ ওম প্রকাশ মেহরার পরিচালনা আর ‘রীলস্পোর্টস’ এর রব মিলারের ‘স্পোর্টস অ্যাকশন’ নির্দেশনায় সিনেমাটি হয়ে ওঠে ২০১৩ সালের সবচেয়ে নান্দনিক সিনেমাগুলোর একটি।

মজার বিষয় হলো, মাত্র ১ কোটি রুপির বিনিময়েই সিনেমাটির স্বত্বাধিকার বিক্রি করে দেন মিলখা সিং। প্রশংসায় ভাসিয়ে দেন ফারহান আখতারের অভিনয়কেও। তার মতে, বাস্তবের মিলখাকেও অনেকাংশে ছাড়িয়ে গিয়েছে পর্দার মিলখা ফারহান আখতার। বক্স অফিসে রেকর্ড গড়ে ১০০ কোটি রুপি আয় করে সিনেমাটি। জয় করে দেশি বিদেশি অসংখ্য পুরস্কার আর সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসা।

বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম

ভারতের রক্ষণশীল সমাজ- যেখানে ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশেই নারীর বাধা অনেক, সেখানে আটপৌরে পাঞ্জাবি পরিবারের একটি মেয়ে খেলবে ফুটবল? মায়ের কাছে ফুলকপি-আলুর তরকারি রান্না না শিখে, ডেভিড বেকহ্যামের খেলা দেখে শিখবে ফ্রি কিক নেওয়ার কৌশল? ২০০২ সালের এই সিনেমায় হাসি-কৌতুকের আড়ালে যুক্তরাজ্য প্রবাসী এক পাঞ্জাবি পরিবারের মেয়ে জেস- এর ফুটবলার হওয়ার ‘অবাস্তব’ স্বপ্ন সত্যি করার প্রয়াসকে এভাবেই তুলে ধরেছেন পরিচালক গুরিন্দার চাড্ডা।

জেস ভার্মার চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন পারমিন্দার নাগরা। সতীর্থ খেলোয়াড় এবং অন্যতম অনুপ্রেরণা হিসেবে তাকে দারুনভাবে সঙ্গ দিয়েছেন ব্রিটিশ অভিনেত্রী কেইরা নাইটলি। শুধু ক্রিড়ামূলক সিনেমা হিসেবেই নয়, নারীবাদি সিনেমা হিসেবেও এই কমেডি-ড্রামাকে মনে রাখবে সবাই। 

মেরি কম

পাঁচ বারের ‘ওয়ার্ল্ড অ্যামেচার বক্সিং চ্যাম্পিয়ন’ মেরি কম হলেন ইতিহাসের একমাত্র নারী বক্সার যে কিনা ছয়টি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশীপ-এর প্রতিটিতেই জিতে এসেছেন কোন না কোন পদক। এশিয়ান গেমসের কোন আসরে সর্বপ্রথম নারী হিসেবে ২০১৪ সালে জয় করেছেন স্বর্ণপদক। কিংবদন্তী সেই ভারতীয় বক্সার মেরি কম-এর জীবনযুদ্ধ নিয়েই নির্মিত ‘ম্যারি কম’।

উমাং কুমার-এর পরিচালিত সিনেমাটি মুক্তির পর ব্যাপক আলোড়ন তোলে বলিউডে। নাম চরিত্রে নিজের সর্বোচ্চটা ঢেলে দেন অভিনেত্রী প্রিয়াংকা চোপড়া, এবং নজর কাড়েন ভক্ত সমালোচক নির্বিশেষে সকলের।

হুসিয়ার্স

অ্যাঞ্জেলো পিজ্জো’র গল্প আর ডেভিড অ্যান্সপ এর পরিচালনায় ‘হুসিয়ার্স’ নির্মিত হয় ১৯৮৬ সালে।  আমেরিকার ছোট্ট শহর ইন্ডিয়ানার অখ্যাত ইন্ডিয়ানা হাই স্কুল টিমের জাতীয় পর্যায়ে বাস্কেটবল চ্যাম্পিয়ন হয়ে ওঠার গল্প বলে ‘হুসিয়ার্স’। যেখানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাজ করে যায় নানান নাটকীয়তা আর অদ্ভুত কোচ নরম্যান ডেল (জিন হ্যাকম্যান) এর অনুপ্রেরণা।

মূলত ১৯৫৪ সালের ‘স্টেট চ্যাম্পিয়ন’ মিলান হাই স্কুল এর বাস্তবিক গল্পকে পর্দার উপযোগী করে তোলে সিনেমাটি। বাস্কেটবল প্রেমী মাতাল শহুরে দর্শকের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য বার্বারা হার্শে এবং ডেনিস হপার মনোনয়ন পান অস্কারে। সিনেমার সঙ্গীতায়োজনের জন্য আরেকটি অস্কার মনোনয়ন মেলে জেরি গোল্ডস্মিথ। ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক গুরুত্ব এবং নান্দনিকতার জন্য ২০০১ সালে ‘হুসিয়ার্স’ স্থান করে নেয়  যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ফিল্ম রেজিস্ট্রি’তে।

পেলে: বার্থ অব অ্যা লেজেন্ড

ফুটবল কিংবদন্তী পেলের জীবনী নির্ভর সিনেমা ‘পেলেঃ বার্থ অব অ্যা লেজেন্ড’। সিনেমাটির গল্প রচনা ও পরিচালনা- দুটোই করেন জেফ ও মাইকেল জিম্ব্যালিস্ট ভাতৃদ্বয়।

ফুটবলার পেলের সঙ্গে তার বাবার মিশ্র সম্পর্কের উপাখ্যান সিনেমাটি। তরুণ পেলে’র ভুমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেন কেভিন ডি পাওলা। এছাড়াও পার্শ্বচরিত্রগুলোতে অভিনয় করেন ভিনসেন্ট ডি’ওনোফ্রিও, রড্রিগো সান্টোরো, ডিয়েগো বোনেটা এবং কম মিনে।

সুলতান

ক’দিন আগেই মুক্তি পাওয়া ‘সুলতান’ এরমধ্যেই সাড়া ফেলে দিয়েছে ভারতজুড়ে। বলিউডের ‘ভাই’ সালমান খান অভিনীত এই সিনেমাটির নির্মাতা আলি আব্বাস জাফর।

ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের বিখ্যাত এক যোদ্ধা সুলতান আলি খান এর জীবনী নির্ভর ‘সুলতান’, যেখানে দেখা যায় কিভাবে সুলতান এর ক্যারিয়ায়ের আকাশ্চূম্বী সফলতা ফাটল ধরাতে শুরু করে তার ব্যক্তিগত জীবনে। সালমান খানের সাথে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে ‘সুলতান’ এ অভিনয় করেন আনুশকা শর্মা।

জুলাইয়ের ৬ তারিখ মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি কেবল বক্সঅফিসেই সাড়া ফেলেনি, জয় করেছে সমালোচকদের মনও। সালমান খান-এর অভিনয়ও হয়েছে দারুন প্রসংশিত।