বন্ধুত্ব নিয়ে সেরা দশ সিনেমা

বিষয়বস্তু হিসেবে ‘বন্ধুত্ব’  সিনেমার অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। কিন্তু রুপালি পর্দায় উপস্থাপনের দিক দিয়ে বন্ধুত্বকে কিছু সিনেমা নিয়ে গিয়েছে ভিন্ন মাত্রায়, দেখিয়েছে বন্ধুত্বের সুন্দরতম দিকগুলো।

নাসির রায়হানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 August 2016, 10:16 AM
Updated : 8 August 2016, 07:37 PM

বলিউড থেকে হলিউড, এমনকি ঢাকাই চলচ্চিত্রেও বন্ধুত্ব নিয়ে তৈরী হয়েছে অসংখ্য সিনেমা। তার মধ্য থেকে গ্লিটজ-এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল সেরা দশ চলচ্চিত্রের গল্প।

১. হ্যারি পটার সিরিজ

হ্যারি, হারমাইয়োনি এবং রন- নতুন শতাব্দীর শুরু তে জাদুর দুনিয়ার এই তিন কিশোর-কিশোরীর বন্ধুত্বের গল্পে মন ভোলেনি- এমন দর্শক খুঁজে পাওয়া যাবে না। জে কে রউলিং-এর অনবদ্য সৃষ্টি প্রথমবারের মতো সেলুলয়েডে এসেছিল ২০০১ সালে ক্রিস কলাম্বাস-এর পরিচালনায়। তারই হাত ধরে এই তিন চরিত্রে অভিনয় করে রাতারাতি তারকায় পরিণত হয় ড্যানিয়েল র‌্যাডক্লিফ, এমা ওয়াটসন এবং রুপার্ট গ্রিন্টরা।

পরবর্তী এক দশকে মুক্তি পায় আরও আটটি সিনেমা, যার প্রতিটিই ছিল ব্লকবাস্টার হিট। জাদুর দুনিয়ার স্কুল হগওয়ার্টসকে ভয়ঙ্কর খলনায়ক ভলডেমর্ট-এর হাত থেকে বাঁচাতে তিন বন্ধু হ্যারি, হারমাইয়োনি এবং রন-এর প্রতিটি অভিযান দেখার জন্য রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে থাকতো ভক্তরা। আর তাই ২০১১ সালে ‘ডেথলি হ্যালোজ: পার্ট টু’-এর মাধ্যমে যখন শেষ হলো ফিল।ম সিরিজটির, অনেকদিন ধরে সেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি পটারভক্তরা।

২. দীপু নাম্বার টু

প্রখ্যাত লেখক মুহাম্মাদ জাফর ইকবাল এর কিশোর উপন্যাসের সার্থক রূপায়ন ‘দীপু নাম্বার টু’। ১৯৮৪ সালের এই উপন্যাসটিকে রুপালি পর্দায় তুলে আনেন নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম। উচ্চবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের সন্তান দীপু। মা সঙ্গে থাকে না তার। বাবার খেয়ালি মন আর চাকরির কল্যানে প্রায়শই তাকে জায়গা পরিবর্তন করতে হয়। সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে তার স্কুল, যদিও ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ না দীপুর।

এভাবেই নতুন স্কুলে দীপুর সাথে পরিচয় হয় তারিকের, মারামারি আর অকারণ ঝগড়া করা যার স্বভাবজাত। কিন্তু ঘটনাচক্রে দীপু আর তারিক একসময় হয়ে উঠে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যে বন্ধুত্বের কল্যানে এই জুটি পরাজিত করে দেশদ্রোহী এক ডাকাত দলকেও। দীপু চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়ের মাধ্যমে সেরা শিশু শিল্পী হিসেবে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ পান অভিনেতা অরুণ সাহা, বুলবুল আহমেদ পুরস্কৃত হন ‘সেরা পার্শ্ব চরিত্রের অভিনেতা’ হিসেবে।

৩. পার্কস অফ বিয়িং আ ওয়ালফ্লাওয়ার

স্টিভেন চবোস্কি’র গল্প এবং পরিচালনায় নির্মিত ‘পার্কস অব বিং অ্যা ওয়ালফ্লাওয়ার’ কামিং অফ এজ ঘরানার সিনেমাগুলোর একটি অনন্য উদাহরণ। কৈশোর জীবনের জটিলতাগুলোর এত নিখুঁত চিত্রায়ন এর আগে কোন সিনেমায় দেখা যায়নি। 

বিষণ্নতায় ভোগা কিশোর চার্লি হাইস্কুল শুরু করে অন্তর্মুখী এক চরিত্র হিসেবে, যার কোন বন্ধু নেই। ঘটনাক্রমে তার সঙ্গে পরিচয় হয় স্যাম এবং প্যাট্রিক নামের দুই ভাইবোনের; চার্লির চেয়ে বয়সে বড় হলেও বন্ধুত্বের বাঁধনে এই তিনজনের বাঁধা পড়তে সময় লাগেনা একটুও। স্যাম আর প্যাট্রিকের সঙ্গই যেন ধীরে ধীরে বদলে দেয় মুখচোরা চার্লিকে। নিজের অনুভূতি প্রকাশের সাহস ফিরে পায় সে; পরিণত হয় আত্মবিশ্বাসী এক স্কুলছাত্রে।

টিন-এজ ছেলেমেয়েদের উচ্ছল জীবন সিনেমার উপজীব্য বিষয় হলেও, সমকামীতা, পিডোফিলিয়া ও ম্যানিক ডিপ্রেসিভ ডিসর্ডার- এর মতো স্পর্শকাতর বিষয়ও সমান গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে সিনেমাটিতে। সেইসঙ্গে লোগান লারম্যান, এমা ওয়াটসন আর এর্জা মিলার-এর দুর্দান্ত অভিনয় ঝড় তোলে দর্শকমনে।

সিনেমাটির মূল উপাদান আসলে বন্ধুত্বের শক্তি। ‘পার্কস অফ বিয়িং আ ওয়ালফ্লাওয়ার’ মনে করিয়ে দেয় জীবনে বন্ধুত্বের গুরুত্ব আসলে কতোখানি।

৪. দিল চাহতা হ্যায়

ফারহান আখতার এর নির্মাতা হিসেবে বলিউডে আবির্ভাব ঘটে কামিং অফ এজ ঘরানার এই সিনেমার মধ্য দিয়ে। ‘দিল চাহতা হ্যায়’ রীতিমত ঝড় তুলেছিল বক্স অফিসে। আমির খান, সাইফ আলি খান, আকশায় খান্না, প্রিতি জিনটা আর ডিম্পল কাপাডিয়ার অনন্য রসায়ন আর শঙ্কর-এহসান-লয়ের শ্রুতিমধুর সংগীতে তরুণদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয় সিনেমাটি।

মুম্বাইয়ের অধিবাসী তিন শহুরে উচ্চবিত্ত বন্ধুত্বের অনন্য উপাখ্যান সিনেমাটি। ধনী বাবার একমাত্র সন্তান আকাশ ভালোবাসায় বিশ্বাসী না, ওদিকে তার বন্ধু সামির দুদিন পরপরই নতুন নতুন প্রেমের ফাঁদে পা ফেলে। কলেজের এই দুই সহপাঠীর ছেলেমানুষী বেশ কৌতুক নিয়েই উপভোগ করতো সিদ্ধার্থ, যতদিন না সে নিজে প্রেমে পড়ে যায় মাঝবয়সী এক ডিভোর্সি নারীর।

হিন্দি সিনেজগতে ‘দিল চাহতা হ্যায়’ দিয়ে যেন নতুন ধরণের এক চলচ্চিত্রিক ভাষার প্রবর্তন করেছিলেন জাভেদ আখতারের সুযোগ্য পুত্র ফারহান। এরই ধারবাহিকতায় পরবর্তীতে তৈরি হয় ‘রক অন’, ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’, ‘দিল ধাড়াকনে দো’, ‘জানে তু ইয়া জানে না’, ‘ওয়েক আপ সিড’- এর মতো সফল সিনেমার, যেগুলোর প্রতিটিতেই নতুন প্রজন্মের ভারতীয়দের কাছে বন্ধুত্বের মানে কী- তা দেখানো হয়েছে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়েই। 

৫. থ্রি ইডিয়টস

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ পড়ুয়া তিন বন্ধুর গল্প ‘থ্রি ইডিয়টস’। বন্ধুত্বকে নতুন ভাবে সংজ্ঞায়িত করে সমাজের তিনটি ভিন্ন শ্রেণী থেকে আসা এই তিন যুবক। প্রথম অংশে তাদের মজার সব কর্মকান্ড যেমনটি দর্শকদের হাসায়, দ্বিতীয় পর্বের ঘটনাপ্রবাহ তেমনি দর্শকদের ফেলে দেয় ভাবনায়। প্রশ্ন জাগায় উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে।

প্রযোজক ভিধু ভিনোদ চোপড়া আর পরিচালক রাজকুমার হিরানীর অসাধারণ এক উপহার ‘থ্রি ইডিয়টস’। চেতান ভাগাত-এর ‘ফাইভ পয়েন্ট সামওয়ান’ গল্প থেকে অনুপ্রাণিত সিনেমাটিকে আরো বিশেষ করে তোলে আমির খান ও বোমান ইরানির অভিনয়। বন্ধুত্ব কিভাবে জীবন সম্পর্কে ধারণা বদলে দিতে পারে- তার যথার্থ উদাহরণ ‘থ্রি ইডিয়টস’।

৬. ইটি

‘এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল’ শুধু যে ১৯৮২ এর সেরা সিনেমাই ছিলো তা নয়, ইতিহাসের অন্যতম সেরা কল্পবিজ্ঞান চলচ্চিত্রের একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয় সিনেমাটিকে। ক্যালিফোর্নিয়া জঙ্গলে এক রাতে হঠাতই উদয় হয় এক ভিনদেশী নভোযান এর। যতোক্ষনে এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়ালরা জঙ্গল ঘুরতে ব্যস্ত, ততক্ষনে তাদের পেছনে আলো হাতে উদয় হয় একদল মানুষ। বুঝতে পেরেই অতি দ্রুত ঐস্থান ত্যাগ করে নভোযানটি, কিন্তু পেছনে ফেলে যায় ছোট্র এক ইটিবাসীকে।

তারপর ঘটনাচক্রে ইটি জড়িয়ে পড়ে ছোট্র এলিয়টের সাথে। শুরু হয় তাদের বন্ধুত্বের অধ্যায়।

অসাধারণ এই সিনেমাটি আজও স্মৃতিকাতর করে তোলে হাজারো ভক্তকে, যাদের শৈশব ছিলো ‘ইটি’ময়, যারা বন্ধুত্বের সংজ্ঞা শিখেছে ইটি আর এলিয়টের কাছ থেকেই। স্টিভেন স্পিলবার্গ এর আজীবন ‘ক্ল্যাসিক’ সিনেমাটি।

৭. রকফোর্ড

নাগেশ কুকুনুর-এর ‘রকফোর্ড’ গল্প বলে তেরো বছর বয়সী এক কিশোর, রাজেশ-এর। তার চোখ দিয়েই টিন এজ কিশোরদের দুনিয়া দর্শকদের সামনে তুলে ধরে ‘রকফোর্ড’।

রাজেশ নাইডু (রোহান দে) ভর্তি হয় রকফোর্ড নামের এক বোর্ডিং স্কুলে, যার সঙ্গে সঙ্গে  পাল্টে যায় তার দুনিয়াও। পরিচয় হয় উচ্ছল স্বভাবের এক নতুন বন্ধু সেলভার (কৈলাশ আত্মানাথান) সঙ্গে। কেবল ছেলেদের সঙ্গে বেড়ে উঠতে উঠতে রাজেশ প্রবেশ করে বয়ঃসন্ধীকালে; ঠিক যে সময়টাতে তার প্রেমে পড়ে যায় পাশের স্কুলের মেয়ে মালতি। এই সময়টার জড়তা কাটিয়ে উঠে রাজেশকে কৈশর উপভোগ করতে শেখায় তাদের শিক্ষক ম্যাথিউস।

এইসব নিয়েই অসাধারণ এক গল্প ফেঁদে বসেছেন কুকুনুর, পাশাপাশি করেছেন অভিনয়ও। সরল গল্পের এই সিনেমাটি দর্শকদের কোন শিক্ষা দেয়না, নেই কোন লুকানো বার্তাও। ‘রকফোর্ড’ একটি বাস্তবিক গল্প, যাকে বন্ধুত্বের ছোঁয়ায় বিশেষ করে তুলেছনে এর কলাকুশলী আর নির্মাতা। সিনেমার ‘ইয়ারো’ গানটি মন জুগিয়েছে অজস্র দর্শকের।

৮. ব্যাচেলর

একদল অবিবাহিত শহুরে বন্ধুদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার আবেগি টানাপোড়নের উপাখ্যান ‘ব্যাচেলর’। ভালোবাসায় বিশ্বাস নেই সাথীর(অপি করিম), কিন্তু ফাহিম (ফেরদৌস আহমেদ) আর রুমেল (আহমেদ রুবেল)-এর সঙ্গে রয়েছে তার বেশ সখ্যতা। এক পর্যায়ে সাথীকে নিয়ে মানবিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে দুই বন্ধু।

এদিকে চল্লিশোর্ধ হাসান (হাসান মাসুদ) প্রেমে পড়ে যায় অল্পবয়সী শায়লার( জয়া আহসান) কিন্তু কিছুতেই আর তার লুকানো অনুভূতিটা প্রকাশ করা হয়ে ওঠেনা। আবরার সাহেব (হুমায়ূন ফরীদি) ইতোমধ্যে পার করেছেন জীবনের ৫০ টি বছর কিন্তু এখন খুঁজে পাননি তার কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার মানুষটাকে। বয়স থামাতে পারেনি তার এই অনুসন্ধান যাত্রাকে। জটিল এই সম্পর্কগুলোর কোন কোনটি পায় সফল সমাপ্তি, কেউবা আবার ঘুরতেই থাকে সম্পর্কের বৃত্তে। কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক-এর গল্প আর  পরিচালক মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর নান্দনিক পরিচালনায় ‘ব্যাচেলর’ হয়ে উঠেছে মধ্যবিত্ত শহুরে বন্ধুত্বের প্রতিক।

৯. থেলমা অ্যান্ড লুইস

রিডলি স্কটের ১৯৯১ সালের আমেরিকান রোড ফিল্ম ‘থেলমা অ্যান্ড লুইস’। ক্যালি খৌরির গল্পকে রুপালি পর্দায় নিয়ে আসেন প্রখ্যাত এই পরিচালক। থেলমা চরিত্রে গ্রিনা ডেভিস আর লুইস হিসেবে সুসান স্যারান্ডন সাথে ক্যামেরার পেছনে রিডলি স্কট। সব মিলিয়ে সিনেমাটি ধীরে ধীরে হয়ে উঠে রুপালি পর্দায় বন্ধুত্বের প্রতিশব্দের মতো। পায় ব্যাপক বাণিজ্যিক সাফল্যও। এই সিনেমার একটি পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই হলিউডে প্রথম পা রাখেন বর্তমান ‘হার্টথ্রব’ অভিনেতা ব্র্যাড পিট।

মুক্তির পর নানান আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়া ‘থেলমা অ্যান্ড লুইস’ আজকের দিনে বিবেচিত হয় একটি ‘ক্ল্যাসিক’ হিসেবে। নারীবাদী চলচ্চিত্রের মাইলফলকও বলা হয়ে থাকে এই সিনেমাটিকে। নারীই হতে পারে নারীর সবচেয়ে ভাল বন্ধু এবং রক্ষক- এই অপ্তবাক্যটি সিনেমায় সবচেয়ে ভালভাবে ফুটিয়ে তুলেছে ‘থেলমা অ্যান্ড লুইস’।

১০. টয় স্টোরি

অ্যানিমেশন জগতের সবচেয়ে বিখ্যাত বন্ধু জুটি সম্ভবত, উডি এবং বাজ। যদিও প্রথম দর্শনে এক কাউবয় আর একজন নভোচারীকে খুব একটা যুতসই জুটি বলে মনে হয়না। কিন্তু ‘টয় স্টোরি’র উডি এবং বাজ সেটাকে ভুল প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছে তাদের মহাকাব্যিক বন্ধুত্ব।

পিক্সারের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেটেড সিনেমা ‘টয় স্টোরি’। প্লাস্টিকের তৈরি এই চরিত্রগুলো দুনিয়াজোড়া মানুষের হৃদয়ে স্থান করিয়ে দিয়েছে সিনেমার পেছনের চৌকশ কারিগর আর কন্ঠশিল্পীরা। অনেক কম সময়েই ‘ক্ল্যাসিক’ তকমা পাওয়া এই সিনেমাটির দর্শকদের চাহিদার কারণে এর পরেও এসেছে আরো তিনটি কিস্তি।