চলে গেলেন ইরানি চলচ্চিত্রের নবতরঙ্গের দিশারী

ইরানের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আব্বাস কিয়ারোস্তমি আর নেই। প্যারিসের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার তার মৃত্যু হয়।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 July 2016, 07:24 AM
Updated : 5 July 2016, 07:47 AM

বিবিসি বলছে, প্যারিসে বসবাসরত এই চলচ্চিত্রকার বেশ কিছুদিন ধরেই ক্যান্সারে ভুগছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।

‘টেস্ট অব চেরি’ সিনেমার জন্য ১৯৯৭ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার পাম দ্য'র পান কিয়ারোস্তমি। তিনিই কানের সর্বোচ্চ পুরস্কার পাওয়া একমাত্র ইরানি।

তার ‘টেন’ চলচ্চিত্রও একই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। 

১৯৪০ সালে তেহরানে জন্ম নেয়া এ চলচ্চিত্রকার গেল শতকের ৬০-র দশকে ইরানিয়ান নিউ ওয়েভ (নবতরঙ্গ) চলচ্চিত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। চলচ্চিত্রে পার্সি কবিতার কথোপকথন ব্যবহারের জন্য বিখ্যাত এ পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, চিত্রগ্রাহক ও আলোকচিত্রশিল্পীকে ওই আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত হিসেবেও গণ্য করা হয়।

ইরানের চলচ্চিত্রের শেকড় এবং আবেগকে বিশ্বের কাছে হাজির করারও অন্যতম কৃতিত্ব কিয়ারোস্তমির।

গেল শতকের ৬০-র দশকের ইরানের নিউ ওয়েভে চলচ্চিত্র নির্মাতারা সাধারণ মানুষকে উপজীব্য করে চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকে ঝুঁকেছিলেন, যেখানে দৈনন্দিন বাস্তবতা, ইরানের জীবনধারা আর ঐতিহ্যই মূল হিসেবে চিত্রিত হতো। ওই ধারাতেই জীবনভর চলচ্চিত্র নির্মাণ করে গেছেন কিয়ারোস্তমি।

“তার দৃশ্যায়নে ফুটে উঠতো ইরানের শেকড়ের বাস্তবতা, গ্রামের কথা; আবার তিনি একইসাথে ওই জীবনধারাকেই সমগ্রের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পারতেন; এটাই তার শিল্পের স্বকীয়তা ছিল”, বলেন নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ইরানিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক হামিদ দাভাসি।

তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ফাইন আর্টসের ছাত্র কিয়ারোস্তমি প্রথম দিকে ইরানি টেলিভিশনের জন্য বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন নির্মাণ করতেন।

১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর সমসাময়িক অন্যান্য চলচ্চিত্রকাররা দেশান্তরিত হলেও কিয়ারোস্তমি ইরানে থেকেই চলচ্চিত্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন।

আব্বাস কিয়ারোস্তমি পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘দ্য রিপোর্ট’ (১৯৭৭)-এর পোস্টার। ছবি: ইন্টারনেট

আব্বাস কিয়ারোস্তমি পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘ক্লোজ-আপ’ (১৯৯০)-এর পোস্টার। ছবি: ইন্টারনেট

ইসলামিক বিপ্লবের দুই বছর আগে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্মিত তার ‘দ্য রিপোর্ট’ চলচ্চিত্রটি বিপ্লবের পর নিষিদ্ধ হয়ে গেলেও দমে যাননি তিনি।

তৎকালীন বিপ্লবী সরকার চলচ্চিত্রকে ইসলামের জন্য ক্ষতিকর মনে করলেও পরে ‘ইসলামি মূল্যবোধ’ ক্ষতিগ্রস্ত না করে বানানো ছবিকে অনুমোদন দেয়ার ঘোষণা দেন। 

এরপর ১৯৮৭ সালে ত্রুফোর ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ’ অবলম্বনে কিয়ারোস্তমি নির্মাণ করেন ‘হয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হোম’।

ইরানের আরেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মহসিন মাখমালবাফের চলচ্চিত্র নির্মাণের বাস্তব কাহিনি নিয়ে কিয়ারোস্তমি ১৯৯০ সালে নির্মাণ করেন ‘ক্লোজ আপ’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র; মুক্তি পাওয়ার পর এটি আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

এরপর একে একে তিনি নির্মাণ করেন ‘লাইফ অ্যান্ড নাথিং মোর’ (১৯৯২), ‘থ্রু দ্য অলিভ ট্রিজ’ (১৯৯৪), ‘টেস্ট অব চেরি’ (১৯৯৭), ‘দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আজ’ (১৯৯৯)।

উগান্ডায় এইডসের বিস্তার নিয়ে তিনি ২০০১ সালে নির্মাণ করেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘এবিসি আফ্রিকা’; এখানেই কিয়ারোস্তমি প্রথম ব্যবহার করেন ডিজিটাল ক্যামেরা। পরবর্তী সময়ে প্রযুক্তির এই আধুনিকতার প্রশংসাও করেন তিনি।

“আমার মনে হয় দর্শক এবং পরিচালক উভয়ের জন্যই ৩৫ মিলিমিটার ক্যামেরা গণ্ডি বেঁধে দেয়, অন্যদিকে ভিডিও ক্যামেরা সব অ্যাঙ্গেল (কোণ) থেকে সত্য তুলে আনে; বানানো সত্য নয়। ওই ক্যামেরা ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরতে পারে, যা প্রতিবেদনের মতোই সব সত্য তুলে ধরতে পারে।”    

এরপরের বছর ভাড়ার ট্যাক্সিতে দুটো ছোট ক্যামেরা জুড়ে দিয়ে বানান ‘টেন’। নারী চালকের ওই ট্যাক্সিতে উঠে আসা যাত্রীদের মুখে জানা যায় ইরানের বর্তমান অবস্থা, নারী স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক নানান ঘটনা-বিশ্লেষণ।

ট্যাক্সিতে থাকা ভিডিও ক্যামেরা সহজেই যাত্রীদের ‘ক্লোজ আপ’ এবং ‘টু-শট’ চিত্র ধারণ করতে পারায় পরবর্তীতে অনেকবারই কিয়ারোস্তমির সিনেমায় এ ধরণের শট দেখা গেছে।

আব্বাস কিয়ারোস্তমি পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘টেস্ট অব চেরি’ (১৯৯৭)-এর পোস্টার। ছবি: ইন্টারনেট

আব্বাস কিয়ারোস্তমি পরিচালিত চলচ্চিত্র শেষ চলচ্চিত্র ‘লাইক সামওয়ান ইন লাভ’ (২০১২)-এর পোস্টার। ছবি: ইন্টারনেট

কিয়ারোস্তমির চলচ্চিত্রে শিশুদের চপলতা আর দরিদ্র ইরানিদের সাধারণ জীবন বেশি প্রাধান্য পেলেও তা কখনো ব্যাপক মাত্রার ‘রাজনৈতিক’ হয়ে উঠেনি বলে সমালোচকদের ভাষ্য; যদিও জাফর পানাহির জন্য তার লেখা বেশকিছু চিত্রনাট্যের রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল ‘বেশ তীক্ষ্ণ’। এর একটি ‘ক্রিমসন গোল্ড’। ২০০৩ সালে মুক্তি পাওয়া এ ছবিতে এক পিজা-ডেলিভারি যুবকের চোখ দিয়ে পানাহি ইরানের শ্রেণিবিভক্ত সমাজকে তুলে ধরেন। বাইরে ব্যাপক প্রশংসিত হলেও ইরানে বেশ সমালোচিত এ ছবিটি নিষিদ্ধ হয়।

২০০৫ সালে কিয়ারোস্তমি ব্রিটিশ পরিচালক কেন লোচ ও ইতালির ইরমাননো অলমো’র সঙ্গে ‘টিকেট’ নামে তিনপর্বের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।

২০০৮ সালে কিয়ারোস্তমি নির্মাণ করেন ‘শিরিন’, ২০১০ এ ‘সার্টিফায়েড কপি’। ২০১২ সালে তার সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘লাইক সামওয়ান ইন লাভ’ মুক্তি পায়।

৪০টিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রযোজনায় জড়িত কিয়ারোস্তমি বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন। ২০০৮ সালে ফ্রান্সে তার তোলা আলোকচিত্রের একটি প্রদর্শনী হয়।

বিশ্ব চলচ্চিত্রেও কিয়ারোস্তমিকে প্রভাবশালী হিসেবেই গণ্য করা হয়। কিংবদন্তি ফরাসি-সুইস চলচ্চিত্র নির্মাতা জঁ লুক গদারও আব্বাস কিওরোস্তমির অনুরক্ত ছিলেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।

গদার একসময় বলেছেন, “চলচ্চিত্রের শুরু ডি.ডব্লিউ গ্রিফিথের হাত ধরে, শেষে থাকবেন আব্বাস কিয়ারোস্তমি।”  

কিয়ারোস্তমির মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন হলিউডের চিত্রপরিচালক ও অভিনেতারা। 

হলিউডের পরিচালক মার্টিন স্করসেস এক বিবৃতিতে বলেন, “তিনি ছিলেন বিশেষ মানুষ; শান্ত, সৌম্য, বিনয়ী, স্পষ্টভাষী ও শক্তিশালী পর‌্যবেক্ষক।”

“তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের লোক, আমাদের সময়ের অন্যতম সেরা শিল্পী। তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন তাদের, যারা সিনেমায় শিল্পের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারতো।”, বলেন স্করসেস।

নিউ ইয়র্কের সিনেমা ম্যাগাজিন ‘দ্য ফিল্ম স্টেজ’ কিয়ারোস্তমির জন্য শোক জানিয়ে ট্যুইট করেছে, বলেছে, “বিশ্ব খুব সম্ভবত তার সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতাকে হারালো।”

কিয়ারোস্তমি পারভিন আমির-ঘোলিকে বিয়ে করলেও পরে তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এই দম্পতির আহমাদ এবং বাহমান নামে দুই ছেলে আছে বলে জানিয়েছে গার্ডিয়ান।