‘বিপদের দিনে আমরা শুধুই বাঙালি’

গুলশানে হলি আর্টিজেন রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার ঘটনায় এখনও হতভম্ভ গোটা দেশ। দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম যখন ব্যস্ত নৃশংস এই হামলার ঘটনাপ্রবাহ পর‌্যালোচনা করতে, তখন স বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের তারকারা হামলার ঘটনায় প্রকাশ করেছেন তাদের শোক, শঙ্কা এবং প্রার্থনা।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 July 2016, 12:17 PM
Updated : 31 July 2016, 07:16 PM

শনিবার সকালে 'অপারেশন থান্ডারবোল্ট' কমান্ডো অভিযানে ছয় বন্দুকধারী মারা পড়লেও এর আগে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করে তাদের জিম্মায় থাকা ২০ বিদেশিকে।

দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর ১৩ জন জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন অনেকেই। শুক্রবার পুরোটা রাত জুড়েই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল #ঢাকাঅ্যাটাক, যেখানে সবাই একের পর এক তথ্য শেয়ার করেছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুলশান ক্যাফেতে হামলা নিয়ে সবচেয়ে সরব ছিলেন অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তফা। হলি আর্টিজান ক্যাফেতে হামলা হবার পর পরই নিজের হতাশা প্রকাশ করে তিনি ফেইসবুকে লেখেন, "ইফতার পর আল্লাহ'র নাম মুখে নিয়েই হাতে অস্ত্র নেওয়া, নিরস্ত্র মানুষকে জিম্মি করে, মানুষ খুন করে কোন পূণ্য হচ্ছে? ধর্মের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। এটা জঙ্গীবাদ। জিম্মি থাকা সকলের জন্য প্রার্থনা করছি। তারা যেন তাদের প্রিয়জনের কাছে ফিরে যেতে পারেন।"

রাতে ক্যাফের বাইরে পুলিশি অভিযানের দৃশ্য সরাসরি বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচার করা হলে তার সমালোচনা করে সুবর্ণা লিখেন, "সিএএনএন-এর উচিৎ এই হামলার সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করা। এধরণের সন্ত্রাসী হামলায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নাগরিককে হত্যার টার্গেট বানানোয় হয়। এরকম মনোভাব তারা কেন দেখাচ্ছেন যে বাংলাদেশে হামলা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা।"

এছাড়াও ভিন্ন একটি স্ট্যাটাসে তিনি দাবী করেছেন, গণমাধ্যম এবং সংবাদকর্মীরা এই ঘটনায় 'নির্বোধে’র মত আচরণ করেছেন। 

আন্তর্জাতিক অঙ্গনের তারকাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ভারতীয় অভিনেতা রাহুল বোস হতাহত এবং হামলায় নিহতদের প্রতি জানিয়েছেন সমবেদনা এবং শোকবার্তা। চলতি বছরে রুবাইয়েত হোসেন পরিচালিত 'আন্ডার কনস্ট্রাকশন' সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি, যার বিশেষ কিছু দৃশ্যের শুটিং করা হয় গুলশানে।

শনিবার রাহুল টুইটে লেখেন, " ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’-এর শুটিঙের কারণে ২০১৪ সালে বেশ কিছুদিন ঢাকায় ছিলাম, গুলশানে থেকেছি। কত দ্রুতই না পৃথিবী বদলে যায়! হামলায় হতাহতদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।"

হামলার ঘটনায় হতাহতদের উদ্দেশ্যে টুইটারে শোক প্রকাশ করেছেন ভারতীয় আরেক অভিনেত্রী সোহা আলি খানও। তিনি লিখেন, “আমার ভাবনা এবং প্রার্থনার সবটুকু এখন #ঢাকার মানুষদের ঘিরে। সন্ত্রাসীরা ধর্মকে মিথ্যার আকারে তুলে ধরে এবং এর মাধ্যমে ভয়, ক্ষোভ এবং দ্বন্দ্ব বাড়াতে চায়। তাদেরকে জিততে দেবেন না।”

এছাড়াও হামলায় শোক প্রকাশ করে ফেইসবুকে বার্তা লিখেছেন 'ডিরকস্টারস' তারকা শুভ, অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম এবং অভিনেতা আদনান ফারুক হিল্লোল।

এদিকে ঘন্টাখানেক আগে নিজ ফেইসবুক প্রোফাইল থেকে শেয়ার করা একটি স্ট্যাটাসে তার পরিচিতদের হামলায় নিহত হওয়ার খবর দেন সংগীত শিল্পী এবং সাংবাদিক এলিটা করিম। এলিটার উল্লেখিত দুই ব্যাক্তি ইশরাত আখন্দ এবং ফারাজ হোসেন- দুজনই এই হামলায় নিহত হয়েছেন বলে তাদের পরিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিশ্চিত করেছে।

এলিটা এব্যাপারে লিখেন, "হামলায় যে ২০ জন নিহত হয়েছেন তাদের সবাইকে বিদেশি বলে দাবী করা হয়েছে। তবে, আমার পরিচিত কিছু বাংলাদেশী এখনও তাদের পরিবারবর্গের খবর জানার অপেক্ষায় রয়েছেন যারা গত রাতে ক্যাফেতে গিয়েছিলেন। ইশরাত আখন্দ, যিনি অসাধারণ একজন নারী যার সঙ্গে আমার কয়েকবার সাক্ষাত হয়েছে, তিনি গত রাতের হামলায় নিহত হয়েছেন। সিমিন আপার ছেলে ফারাজও সেখানে ছিল এবং তাকেই হত্যা করা হয়েছে। একজন নারী এখনও তাঁর ভাইয়ের মেয়েকে খূঁজে বেড়াচ্ছেন।"

গুলশান ক্যাফের হামলায় এলিটার পরিচিত মানুষ রয়েছে, সে আশংকা তিনি হামলা হবার শুরুতেই তার স্ট্যাটাসে প্রকাশ করেছিলেন।

শুক্রবার রাতে তিনি লিখেছিলেন, "কিভাবে আমি জানবো কে নিরাপদ আছে আর কে নেই? আমার বন্ধুরা রয়েছে গুলশানে আর আমি পড়ে আছি কারওয়ান বাজারে। শোনা যাচ্ছে আক্রমণকারীরা 'আল্লাহু আকবার' ধ্বনি দিচ্ছে এবং গুলি চালাচ্ছে। এটা কি সত্যি? #ঢাকাআন্ডারঅ্যাটাক।”

গুলশান হামলার ঘটনায় নিজের জীবন নিয়ে আশংকা প্রকাশ করে ফেইসবুকে পোস্ট করেছেন অভিনেত্রী নওশীন নাহরিন মৌ। তিনি লেখেন, "কোন রেস্তোরাঁয় আমি নিরাপদ নই, নই রাস্তাতেও... আমার কর্মস্থল এমনকি আমার নিজের ঘরেও আমি নিরাপদ নই... তাহলে??? এক ঘন্টার জন্য হলেও শান্তিতে আমি কোথায় ঘুমোবো?? আমাদের কি আসলেই অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ জাতির প্রয়োজন নাকি শুধু শান্তিতে বিরাজ করা এক জাতির??"

গত রাতেই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে দেশি-বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করার ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস দায় স্বীকার করে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে। আইএসের মুখপত্র আমাক নিউজ এজেন্সিতে শুক্রবার রাতে দায় স্বীকারের বার্তা আসে বলে রয়টার্স জানিয়েছে।

আইসিস-এর সম্পৃক্ততা এই ঘটনায় পুরোপুরি রয়েছে বলে টুইটারে টুইট করেছেন নাটক নির্মাতা আশফাক নিপুন। তিনি লেখেন, "আইসিস একটি সঙ্কট। এটা মেনে নিন এবং সেভাবেই ব্যাবস্থা নিন, মাননীয় সরকার।"

নির্মাতা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী নিজের স্ট্যাটাসে বলেন, “বাংলাদেশের জন্য গভীর বিষাদের দিন এটি। আশা করি আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত বিষয়টির সমাধান করবেন এবং জিম্মিদের মুক্ত করে আনবেন। আসুন রাজণতির খেলা বাদ দিয়ে সবাই একসঙ্গে উঠে দাঁড়াই। সমস্যার গভীরে যেয়ে এই অপশক্তির মূলোৎপাটন করতে হবে। এরমধ্যেই অনেক দেরী হয়ে গেছে।”

বিস্তারিত এক স্ট্যাটাসে গুলশান হামলা নিয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করেন নির্মাতা রেদওয়ান রনি। দেশের রাজনীতিবিদদের তিনি আহ্বান জানান স্পর্শকাতর এই ঘটনা নিয়ে বেফাঁস কোন মন্তব্য না করে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার। হামলায় নিহত হওয়া দুই পুলিশ কর্মকর্তার প্রতিও নিজের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন তিনি।।

শনিবার ‘সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই’ মন্তব্য করে তাদের প্রতিরোধে জনগণকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই বক্তব্যের সূত্র ধরেই সুবর্না মুস্তাফা দুপুরে তার দেওয়া আরও একটি স্ট্যাটাসে লিখেন, "গতরাতের হামলায় আমরা আল্লাহ এবং ধর্মকে টেনে না আনি। এটা ছিল এক সন্ত্রাসী হামলা... এখানেই ঘটনার সমাপ্তি। মনে হচ্ছে আমাদের স্মৃতি গোল্ড ফিশের মত। মনে আছে ইসলামের নামে হেফাজত ঢাকায় কি তাণ্ডব চালিয়েছিল? তখন সে ঘটনায় ইসলামের কোন সম্পৃক্ততা ছিলনা, গতরাতের ঘটনাতেও নেই। অর্থ, ধর্মান্ধ এবং জঘন্য রাজনীতির খেলাই এই হামলার কারণ, ধর্ম নয়।"

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যক্তিগত অর্জন কিংবা  তারকা জগত ও মিডিয়া সংক্রান্ত সকল প্রচারণায় অন্তত 'একদিন' এর জন্য হলেও সকলকে বিরত থাকতে বলেছেন সুবর্ণা এবং তাঁর স্বামী বদরুল আনাম সৌদ।

তবে, হতাশার কাল মেঘের মধ্যেও আশার আলো দেখছেন তরুণ সংগীতশিল্পী কারিশমা সানু সভ্যতা। সকল ধর্মের উর্ধ্বে উঠে জাতীয় পরিচয়েই বাঙালি আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে বলেই নিজের স্ট্যাটাসে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।

লিখেছেন, “আমরা বাঙালিরা জাতি হিসেবে এতোই আবেগপ্রবণ যে, নিজেস্ব ভাষা নিয়ে সংগ্রাম করতে করতে দেশ স্বাধীন করে ফেলেছি। ধর্মের বিভাজন তখনও ভেতরে ছিল না, এখনও নাই। আমার বিশ্বাস, একজন হিন্দু মানুষ ঈদের দিন কারও বাসায় বেড়াতে গেলে এমন কোন বাসা নাই, যে তাকে না খাইয়ে বিদায় করবে। ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’ গানটা শুনে এমন কোন বাঙালি নাই, যার গা শিউরে উঠবে না।”

তিনি আরও লিখেন, “ যে যাই বলুক, আমরা মুসলমান দেশ, হেনতেন। মন থেকে আমরা সবাই শুধুই বাঙালি। ইতিহাস বলে সুখে দুঃখে আমরা এক ছিলাম, আছি এবং থাকব। তা নাহলে ছোট্ট এই দেশটার নাম বিশাল পৃথিবীর বুকে হারিয়ে যেত অনেক আগেই। না যাওয়ার কারণ একটাই, আমরা মন থেকে ধর্মলোভী না, আমরা ধর্মপ্রেমী মানুষ। এবং বিপদের দিনে আমরা সবাই শুধুই বাঙালি।”