‘ব্যান্ড সংগীতের সুসময়টা ফিরছে’ 

রায়েফ আল হাসান, রাফা নামেই এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ব্যন্ডজগতে যার গড়ে উঠেছে নিজস্ব পরিচয়। অর্থহীন, ক্রিপটিক ফেইটের মত প্রথম সারির ব্যান্ড থেকে শুরু করে বাজিয়েছেন ক্রাল, দ্য জয়েন্ট ফ্যামিলি এবং সেভেয়ার ডেমেনশিয়ার মত বড় আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ডে।

শরীফুল হক আনন্দবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 June 2016, 12:46 PM
Updated : 10 June 2016, 12:48 PM

দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের রক এরিনার প্রতিষ্ঠিত তারকা হলেও, নিজের ব্যান্ড গড়ে অ্যালবাম প্রকাশ করলেন এই প্রথম। রাফার ব্যান্ড ‘অ্যাভয়েডরাফা’, অ্যালবাম ‘ভার’, অর্থহীন-এর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা- সর্বোপরি সংগীত অনুরাগী ব্যক্তি রাফাই এবার উঠে এলেন গ্লিটজ-এর সঙ্গে এক আন্তরিক আড্ডায়।

গ্লিটজ: সাইকোকাইনেসিস-ক্রাল থেকে শুরু, ১৪ বছর পর এখন অ্যাভয়েড রাফা- দীর্ঘ সময়ের এই পথচলা কেমন ছিল আপনার জন্য?

রাফা: যখন শুরু করেছিলাম, আন্ডারগ্রাউন্ড মিউজিক তখন একেবারেই নতুন; বাজারি সঙ্গীতের দাপটটাই বেশি। অর্থহীন তখন আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড, সেপালচুরার গান কাভার করে। 'ছাড়পত্র' অ্যালবাম আসার আগে তখন বাজানোটাই মুখ্য ছিল, নতুন কোন গান বানানো নয়। ২০০৬ পর্যন্ত একরকমের মনের সুখেই চললো, তবে এরপর থেকে পেশা হিসেবেই সংগীতকে বেছে নিলাম। 

তখন আমি গানই করি শুধু, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা মিক্সিং এর ব্যাপারে সবেমাত্র জানা শুরু করেছি। ধীরে ধীরে পেশাদারী হয়েই কাজগুলো করলাম।

মাঝে ২০০৬ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ব্যান্ড মিউজিকে একটা খরার সময় গেছে। পাইরেসি, স্বত্ত্ব নিয়ে সমস্যা- হতাশার সময়ে তখন একপ্রকার আড়ালেই ছিলাম। ধৈর্য্য ধরেছি। এখন আবার সবকিছুই আগের মত। ভালো সময়টা আবার ফিরে আসছে। 

গ্লিটজ: পরিবর্তনটা তাহলে কিভাবে দেখেছেন আপনি?

রাফা: পরিবর্তনের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে- সঙ্গীত অঙ্গনে এই কথা বড় ধরণের এক প্রপাগান্ডা। আমি ব্যক্তিগতভাবে এটা বিশ্বাস করিনা। যা করতে হবে, পরিবর্তন আপনাকেই আনতে হবে।

কমার্শিয়াল কিংবা টেলিফিল্ম-জিঙ্গেলের বাইরে আমি নিজের মত কাজ করেই গেছি যা এখন প্রকাশ করছি। তবে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে। নিজের বেশ খানিকটা হারিয়েছি, আবার অ্যাভয়েডরাফার অ্যালবাম দিয়ে অনেকখানি ফিরেও পেয়েছি। 

ভক্তরা যারা এই শূণ্য সময়টাতে হতাশ হয়ে পড়েছিল ঠিকভাবে আগের ব্যান্ডগুলোর কোনকিছু বের না হওয়ায়, তারাও এখন তাদের পুরোনো আগ্রহ ফিরে পাচ্ছে। দেশের ব্যান্ডের ভক্ত-অনুসারীরাও আমাদের অনেক বেশি ধৈর্য্য নিয়ে বসে থাকতে পারেন আমাদের জন্য। দীর্ঘ সময় আর্টসেল, অর্থহীন কিংবা ওয়ারফেইজ, এমনকি আমি নিজেও কোনকিছু প্রকাশ করিনি, তবে তারা অপেক্ষা করে গেছেন।

গ্লিটজ: ধৈর্য্যটাই কি 'ভার' প্রকাশের পেছনে এত লম্বা সময় লাগার কারণ?

রাফা: অ্যালবাম লঞ্চিং এ বলা হয়েছিল সাত বছর, যদিও সময় লেগেছে আরও বেশি। ক্রাল আমার প্রথম ব্যান্ড হলেও আমার দুই ভাই সাদী মুকতাফি এবং আদনান দুজনই ডাক্তার। আদনান আবার আরবোভাইরাসেও বেইজ বাজাচ্ছেন। তাদের ব্যস্ততায় তেমন কিছু করা হয়নি।

তবে, ২০০৬ থেকে এখন পর্যন্ত প্রচুর গান রেকর্ড করেছি। আমি এমনই এক মিউজিশিয়ান, যে প্রতিদিনই একটা করে গান বানাই। পরীক্ষামূলক ছিলো অনেক কিছুই। সেগুলো জমতে জমতেই গানগুলো একসঙ্গে করে 'ভার' প্রকাশ করা।

গ্লিটজ: এর মাঝে অর্থহীন-এর সঙ্গে অনেক কাজ করেছেন আপনি…

রাফা: অর্থহীন-এ এসেছিলাম সুমন ভাইয়ের হাত ধরে, সাদী ভাইয়ের অনুমতিতে। সুমন ভাই সবসময়েই আমার কাছের একজন বন্ধু ছিলেন। কখনও ভালো কিছু কম্পোজ করলে তখন সেটা অর্থহীনের হয়েই প্রকাশ করতে চেয়েছি, কারণ অর্থহীন নিজেরই ব্যান্ড ছিল।

গ্লিটজ: অর্থহীন-এর সঙ্গে ১২ বছর! কেমন ছিলো সময়টা?

রায়েফ আল হাসান রাফার ফেইসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত

রাফা:
 অসাধারণ। অনেক ছোট থাকতে অর্থহীন-এ যোগ দিয়েছিলাম, সুমন ভাই একদম আগলে রেখেছিলেন।

ড্রামস গিটার বাজিয়ে গান করতে পারলেও সেসময় সবকিছু গোছানো ছিলোনা।

প্রথম শো ছিল ২০০৪ সালে, ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে। সেই শোতে ব্যাক ভোকাল দেই কিছু গানে। শো শেষে মিটিং-এ সুমন ভাই বললেন, ‘তুমি যে গেয়েছো পুরোটাই বেসুরো ছিল! তবে দুঃশ্চিন্তা করার কিছু নেই, লাইভে গান করা শিখে যাবে।’

ছোটবেলায় এই কথাগুলো শুনে কিছুটা সংকীর্ণবোধ করেছি। তবে সুমন ভাই, পিকলু ভাই এর কাছে অনেক কিছু শিখেছি। আমি খুবই ভাগ্যবান যে আমি অর্থহীন-এর সঙ্গে বাজিয়েছি। লাইফস্টাইল, আদর্শ থেকে শুরু করে সবকিছুই অর্থহীন-এর সঙ্গে মিলতো। 

গ্লিটজ: অর্থহীন ছাড়লেন কেন?

রাফা: সময়ে মিলছিলো না। যোগাযোগেও একটা বড় ফাঁকা পড়ে গিয়েছিল। তবে কোন ধরণের বিরোধ আমাদের মাঝে কখনও ছিলো না। সবকিছুই সুমন ভাইয়ের সিদ্ধান্ত ছিল।

তিনিই বললেন আমাকে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে এগিয়ে যেতে, যেহেতু অনেকদূর এগিয়েছি। ব্যাপারটা দুঃখজনক, তবে আমি অর্থহীন আসলেই মিস করি। এমনকি সুমন ভাই আমার অ্যালবাম প্রকাশের পর গানগুলো পছন্দও করেছেন, নিজে থেকে প্রশংসা করেছেন। সম্ভবত, অর্থহীন আর অ্যাভয়েডরাফা একই মঞ্চে শো করবে।

তবে অভিজ্ঞতাও অনেক বড় একটা ব্যাপার। অর্থহীন অনেক বড় মাপের একটি ব্যান্ড, যেখানে অ্যাভয়েডরাফার পথচলা ধরলে হাতে গোনা কয়েকদিন। অর্থহীন-এর অ্যালবাম বেরোচ্ছে সামনে, আর আমরা যদি আরও তিনটি অ্যালবাম বের করি, তবেই আমরা অর্থহীনের সঙ্গে একমঞ্চে বাজানোর মত সাহসটা পাবো।

গ্লিটজ: অ্যালবাম নিয়ে সাড়া কেমন পেলেন?

রাফা: অসাধারণ। আমরা যেভাবে সাফল্য পেয়েছি সেটা ২০০৯ সালে 'টুল' ব্যান্ড তাদের 'টেন থাওজেন্ড ডেইজ' দিয়ে পেয়েছিল।

গ্লিটজ: অনলাইনেই যখন বিনামূল্যে গান শোনা যায়, তখন সিডিতে অ্যালবাম প্রকাশ করাটাকে ঝুঁকি মনে হয়নি?

রায়েফ আল হাসান রাফার ফেইসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত

রাফা:
 ‘ভার’ প্রথমে অনলাইনে প্রকাশ হয়েছে, তারপর সিডি আকারে বের করা। যা করেছি অ্যালবাম নিয়ে, তার চেয়ে ভক্তদের সাড়া তুলনামূলক বেশিই পেয়েছি।

সিডিটা সবাই চাচ্ছে।

সিডির দাম, গানের দাম কমে গেছে বলে অ্যালবামটা করার ব্যাপারে আমাকে অনেক নিরুৎসাহিত করেছেন। তবে আমার মনে হয়েছে, যদি গান ছাড়াও ছবি, আর্ট আর একটা ভালো কাভার দিয়ে বড়সড় 'অ্যালবাম' আকারে বের করা যায়, তবে মানুষ গান শোনার পাশাপাশি সিডিটাও সংগ্রহে রাখতে চাইবে।

আরবোভাইরাস আর ইনডালোও কিন্তু এর আগে অ্যালবাম রিলিজ করেছে এভাবেই, যেটা আরও সাহস জুগিয়েছে আমাকে।

গ্লিটজ: 'ভার' এর দ্বিতীয় ডিস্কে পপ রক জনরা কেন বেছে নিলেন? যেখানে সবসময়ই হার্ড রক কিংবা মেটাল গান করে এসেছেন আগে?

রাফা: আসলে দ্বিতীয় ডিস্ক করার পরিকল্পনাই আমাদের ছিল না। পুরো ব্যপারটাই নির্ভর করছিল সাড়া কেমন পাব, তার উপর। মূলতঃ দুটো কারণে: এক, এরকম পপ রক গান প্রচুর রয়েছে। আর দ্বিতীয়ত, বাবা-মা'কে যখন অ্যালবাম প্রথম শুনিয়েছি তখন তারা বলেছেন- 'এগুলো গানের জাত হলো?!'

এছাড়াও অনেকেই জিজ্ঞেস করেছে, আপনার করা গানগুলো কোথায় গেলো? কিংবা টেলিফিল্মে করা গানগুলো? তাই দ্বিতীয় ডিস্কটা অসম্পূর্ণভাবে প্রকাশ হওয়া গানগুলোরই একটা সমন্বয়। পপ রক আমি পছন্দও করি। মিউজিকালি আমার আইডল একজনই- কিংবদন্তী ডেভিড বাওয়ি। ইচ্ছা আছে অ্যাম্বিয়েন্ট পপ রকও করার। 

গ্লিটজ: এতগুলো ব্যান্ডের সঙ্গে বাজিয়েছেন, কি কারণে আসলে 'অ্যাভয়েডরাফা' ফর্ম করা?

রায়েফ আল হাসান রাফার ফেইসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত

রাফা:
 'অ্যাভয়েডরাফা' করার আগে সলো এবং 'রাফা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস' ধাঁচের অনেক শো করতে হয়েছে বাণিজ্যিক কারণে। এই ধারণাটাই আমার পছন্দের না। ২০১৪ সালের রকনেশনে প্রথম 'অ্যাভয়েডরাফা' নাম নিয়ে স্টেইজে ওঠা। বামবার সঙ্গে লাইভস্কয়ারের সমঝোতা না হবার কারণে সেবার অর্থহীন বাজাতে পারেনি শোতে। অর্থহীন ভক্তদের শান্ত করার জন্য অর্থহীনের গানের সঙ্গে নিজেদের গানও করি। এই পারফরম্যান্সে ভক্তদের রেসপন্স দেখে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম!

দর্শকরা যেভাবে আমাদেরকে সমর্থন জুগিয়েছিলেন, সেখান থেকেই 'অ্যাভয়েডরাফা'র শুরু। তবে নাম নিয়ে সমস্যা থাকার কারণে এখনও অনেকেই এটাকে একটা ব্যান্ড হিসেবে দেখে না, আমার নিজের একটা প্রজেক্ট হিসেবে দেখে। আশা করি এই ধারণার পরিবর্তন হবে।

গ্লিটজ:  'অ্যাভয়েডরাফা' নিয়ে এখন পরিকল্পনা?

রাফা: গানগুলো সব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লাইভে করার পরিকল্পনা। মিউজিক ভিডিও আসতে পারে কয়েকটা গানের। গানগুলো আরও সবার মাঝে ছড়িয়ে গেলে বছর শেষে সম্পূর্ণ অ্যালবাম নিয়ে একটা লাইভ কনসার্ট করার ইচ্ছা আছে।

ইউটিউবে পুরো কনসার্ট লাইভে দেখানোরও পরিকল্পনা রয়েছে। এই কাজটা হলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোও সহযোগিতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে। সেটা সবার জন্যই লাভজনক হবে।

গ্লিটজ: আপনি সবকিছুই বাজাতে পারেন! এর রহস্য কি?

রাফা: কোনো রহস্য নেই। সত্যি কথা বলতে, ক্লাস সেভেন পর্যন্ত আমার মিউজিক নিয়ে আগ্রহই ছিলনা। ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকতাম।

২০০১ এ সাদী ভাইয়ের একটা ব্যান্ড ছিল, তখন থেকেই কিভাবে যেন স্ট্রিং কিংবা অ্যাকোস্টিক ইনস্ট্রুমেন্ট বাজাতে পারতাম। ভাইয়া আমাকে জোর করেই গিটারে কিছু কর্ডস শিখিয়েছিল। পিয়ানো বাজানোটাও গিটার থেকে কর্ড খাপে খাপে বসিয়ে শেখা। উকুলেলে আমি টিউনও করতে পারিনা, শুধু বাজাতে পারি। তবে খুব ভাগ্যবান আমি এক্ষেত্রে! 

গ্লিটজ: ড্রামিং-এর নেশা এলো কিভাবে?

রাফা: ড্রামস আমার কাছে এমন এক ইনস্ট্রুমেন্ট, যেটা একদম সত্যি কথা- কোন কিছু না শিখেই আমি বাজাতে পারি। আমাকে যদি সবকিছুর মাঝে কোন একটা কিছু বেছে নেবার সুযোগ দেওয়া হয়, আমি নিঃসন্দেহে ড্রামস বেছে নিবো। এবং আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি- ড্রামসে আমি কখনই ভুল করবো না। 

গ্লিটজ: আর্টিস্ট থেকে টেকনিশিয়ান হিসেবে কিভাবে গড়ে উঠলেন আপনি?  

রাফা: ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ ছিল। একসময় সুমন ভাইয়ের বাসা ছিলো এখানেই, তার স্টুডিও ছিল দুর্দান্ত। নন্দিত ভাই ছিলেন, যিনি নেমেসিস এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি সেখানে স্টুডিওতে রেকর্ডিং এর কাজ করতেন, আর মিক্সিং করতেন মাইলস এর জুয়েল ভাই। তাদের কাজে সাহায্য করতে চেষ্টা করতাম তখন। নন্দিত ভাই টেকনিকাল অনেক কিছু শিখিয়েছেন। তারপর সুমন ভাই বাসা পরিবর্তন করে আমাদের বাসার আরও কাছে এলেন, স্টুডিও বানালেন। তিনি আমার হাতে কিছু সফটওয়্যার ধরিয়ে দিয়ে বাসায় পিসিতে কাজে বসে যেতে বললেন। তিনি অসাধারণভাবে প্রভাব রেখেছেন আমার এই পরিচয় বড় করে তোলার ব্যাপারে। 

গ্লিটজ: 'সেভেয়ার ডেমেনশিয়া' কিভাবে এগুচ্ছে?

রাফা: ব্যান্ডের অবস্থা এখন ভালো। নতুন ভোকাল এসেছে রিয়াসাত, জ্যাম করছি, শো ছিল বেশ কিছুদিন আগেই। মাঝখানে অনেকদিনই বিরতি গেছে বিভিন্ন কারণে। সামনে ব্যাঙ্গালোরে ব্যান্ডের একটা শো আছে, যেখানে হেডলাইনার হলো পোলিশ ডেথ মেটাল ব্যান্ড 'ভেইডার'। 

গ্লিটজ: দেশের বাইরে কনসার্টের অভিজ্ঞতা তো আগেও হয়েছে। কেমন ছিলো সেগুলো?

রায়েফ আল হাসান রাফার ফেইসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত

রাফা:
আসলে 'সেভেয়ার ডেমেনশিয়া'র আরও দারুণ কিছু শো করবার সুযোগ ছিল। সিডনিতে 'মরবিড এঞ্জেল'-এর শোতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছিল, কিন্তু তার মাঝেও কয়েকজন আমাদের ব্যান্ডকে চিনেছে।

ডেথ মেটাল পৃথিবীর খুব কম জায়গা জুড়ে থাকলেও এর অনুরাগীরা কমবেশি অনেক ব্যান্ডকেই চেনে। আসলে আমাদের দেশে মিউজিক এজেন্ট নেই, যেটা খুব দরকার। 'ভেইডার' এর সঙ্গে শো'তে আমি ড্রাম বাজিয়ে নিজেই তৃপ্ত হতে পারি। কিন্তু এই কৃতিত্বটা যদি 'ভেইডার' কিংবা শ্রোতাদের কাছে না পৌঁছায় যে আমরা বাংলাদেশের একটি ডেথ মেটাল ব্যান্ড, তাহলে আরেকটি শো তে বাজানোর আমন্ত্রণ পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

গ্লিটজ: 'সেভেয়ার ডেমেনশিয়া'র অ্যালবামের কোন খবর?

অ্যালবামের কাজ প্রায় শেষ। আগে তো অর্ধেক করা ছিলো, 'এপিটোম অফ পলাশি' যেটা ইপি হিসেবে প্রকাশ পায়। এখন পুরো একটা অ্যালবামই আসছে। আর অ্যালবাম ভারতে ব্যাঙ্গালোরের শোর সময়ই মুক্তি পাবে। 

গ্লিটজ: বর্তমান আন্ডারগ্রাউন্ডকে কিভাবে দেখছেন? 

অসাধারণ রকমের ভালো! মাঝে অনেকদিন আন্ডারগ্রাউন্ড সিনে ছিলাম না। সেসময় ফুয়াদ ভাই আমাকে মিউজিক প্রোডিউসার বানিয়েছেন অনেকটা জোর করেই। তার সঙ্গেই থাকতাম, জিঙ্গেল করতাম- সবই পেশাদারী কাজ।

তারপর ২০১২ তে এসে পাওয়ারসার্জে কিছুদিন বাজানোর পর মনে হলো- বয়স বেড়ে যাচ্ছে! সে সময়টাতে রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারে কোন শোই হতো না, কিন্তু এখন আবার নিয়মিত আন্ডারগ্রাউন্ড শো হচ্ছে। তরুণ আন্ডারগ্রাউন্ড মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে মেলামেশা হচ্ছে আবারও, দারুণ অবস্থা।

'থ্র্যাশ' নামে একটা ব্যান্ড আছে, তারা এককথায় দুর্দান্ত! আর্টসেল যেমন ২০০২ সালে একটা বিপ্লব এনেছিলো, তেমনি এক/দুই বছরের মধ্যে এই 'থ্র্যাশ' ব্যান্ডের দিকেই মানুষ ঝুঁকবে।

'এনমেশিনড' ব্যান্ডের ভোকাল আবিরের কথা বলতেই হয়। পাগলাটে! দুর্দান্ত ভোকাল। একসময় ভোকালের অভাব পড়েছিল এই ঘরানার মিউজিকে। এখন আবির আছে, থ্র্যাশের ভোকাল সামিরের গলার রেইঞ্জও অসাধারণ। 'হোমিসাইড'- এর কথাও বলতে হয়, তারা দারুণভাবে এগুচ্ছে। আর এদের জন্যই মানুষ আরও আন্ডারগ্রাউন্ড শোতে আসবে। আসলে বাণিজ্যিক কিছু এজেন্ডার কারণে আন্ডারগ্রাউন্ড সিনে একসময় খরা সময় গিয়েছে। তবে এই ব্যান্ডগুলো আবার সুসময় নিয়ে আসবে। 

গ্লিটজ: বড় ভাইয়ের বাইরে বাবা-মার অনুপ্রেরণা কেমন ছিল মিউজিক নিয়ে?

রায়েফ আল হাসান রাফার ফেইসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত

রাফা:
 আসলে তারা সম্পূর্ণই বিপক্ষে ছিলেন। ভাইয়া ভালো ছাত্র ছিলেন, তাই তাকে গিটার কিনে দিয়েছিলেন। তারা আমার ক্যারিয়ার নিয়ে কিছু বলেন না কারণ এই মিউজিক করেই আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। অর্থহীনে থাকা অবস্থায় প্রথম দুবছর বাসায় বাবা-মা জানতোই না। পরে ফুপুরা টের পেয়ে বলে দিয়েছিলেন। কিন্তু সুমন ভাইই কথা বলে রাজি করান।

অবশ্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মিউজিক করে পেট চালানো দূরহ কাজ। বাবাকে বলেছিলাম মিউজিক নিয়ে দেশের বাইরে পড়তে যাবো। কিন্তু আর্থিক কারণেই হয়ে ওঠেনি। এখন যা শিখেছি, ঘুরেফিরে পড়াশোনা করেই সব শিখতে পারতাম। মিউজিক নিয়ে আসলেই পড়াশোনা করা উচিত যাদের মিউজিক করার ইচ্ছে রয়েছে।

আমার বিপ্লবী অভিজ্ঞতা থেকে আমাকে অনেকেই আদর্শ হিসেবে নেয়- ‘পড়াশোনা করে কিছু হবে না। আমি মিউজিশিয়ান হবো!’ তবে মিউজিক নিয়ে পড়াশোনাটা খুবই দরকার। কেউ যদি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হতে চান, ডিপ্লোমাটা অবশ্যই করে নিতে পারেন। সময়টা অন্ততঃ বেঁচে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাইলেই কয়েকটা কম্পিউটার আর কনসোল বসিয়ে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি শুরু করতে পারে, যারা বসে আছে কিছু করার জন্য- এরকম ২০/২৫ জন এসে শিখতে কিংবা শেখাতে পারবে। এটা হওয়া উচিৎ। 

গ্লিটজ: ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় মূহুর্ত?

রাফা: আমার একটা গান আছে, যেটা পুরোটাই একটা অ্যালবাম- যেটা আমি পরবর্তীতে প্রকাশ করবো। গানটা ৮৭ মিনিটের! চার বছর আগে এটা বানানোর অভিজ্ঞতাটাই সবচেয়ে স্মরণীয়, ছমাস ধরে প্রতিদিন টানা কাজ করেছি গানটার জন্য। আমার মা সেসময় পারকিন্সন্স রোগে ভুগছিলেন। একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিলেন, যদিও এখন সুস্থ আছেন। সে অস্থির সময়ে আমার হাসি কিংবা কান্নার অনুভূতিগুলো এই গানটা দিয়েই প্রকাশ করা।  

গ্লিটজ: সামনের সময়টা কেমন যেতে পারে আপনার জন্য?

রাফা: মিউজিকালি যদি বলি, আমার অ্যালবাম করাই আছে। একটা এই গান নিয়ে, আর একটা অন্যান্য বেশকিছু পছন্দের গান নিয়ে করা অ্যালবামও আছে। 'স্পেইস রক' নামের আরেকটা অ্যালবাম আছে, এবং এ ধরণের গানগুলোই আমি বেশি পছন্দ করি। শুনতে দারুণ লাগে। আশা করছি, মানুষ এই গানগুলো থেকে ভিন্ন স্বাদের অনেক কিছু আমার কাছ থেকে পাবেন।

জীবন একটাই, যতখানি সম্ভব- বাজিয়ে যাবো। ক্রালের অ্যালবাম আসবে, ক্রিপটিক ফেইটের অ্যালবাম আসবে। এবং এই সময়ের মধ্যেই হয়তো অনেকটাই বুড়িয়ে যাবো। বাংলাদেশের গানগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। অন্ততঃ এই প্ল্যাটফর্মটা যেন তৈরি হয়, যেন বাইরের রেকর্ডিং কোম্পানিদের কাছে আমাদের গানগুলো পৌঁছায়। এটা বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিদের কাছে প্রশ্ন, এত ভালো মিউজিশিয়ান আর গান থাকলেও এখনও কেন বাইরে আমাদের মিউজিক যায়নি? সীমাবদ্ধতাগুলো আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে।