চিরসবুজ আলমগীর

আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে দর্শকদের প্রিয় মুখ এবং নির্মাতাদের কাছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য শিল্পী ছিলেন আলমগীর। কেবল অভিনয় নয়, দৈহিক সৌষ্ঠব, গ্ল্যামার এবং পোশাকরুচির কারণেও আজও দর্শকনন্দিত তিনি।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 April 2016, 05:52 AM
Updated : 3 April 2016, 05:52 AM

আলমগীরের জন্ম ঢাকায়। ১৯৫০ সালের ৩ এপ্রিল। তাদের আদিবাড়ি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তার পুরো নাম আলমগীর হোসেন। তার বাবা কলিম উদ্দিন আহম্মেদ ছিলেন পুরান ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তিনি সংস্কৃতিমনা ছিলেন। আবদুল জব্বার খান যখন ঢাকার প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোস’ নির্মাণ করেন সে সময় ছবিটি প্রযোজনার জন্য তাকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন কলিম উদ্দিন আহম্মেদ। সেই সূত্রে চলচ্চিত্র জগতের সাথে ছোটবেলা থেকেই আলমগীরের যোগাযোগ গড়ে ওঠে।

১৯৭৩ সালে আলমগীর কুমকুম পরিচালিত ‘আমার জন্মভূমি’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে রূপালি ভুবনে তার যাত্রা শুরু হয়। এরপর ‘দস্যুরাণী’,  ‘চাষীর মেয়ে’, ‘গুণ্ডা’, ‘মাটির মায়া’ ইত্যাদি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ১৯৭৮ সালে দিলিপ বিশ্বাস পরিচালিত ‘জিঞ্জির’ ছবিতে কাজ করার সুযোগ পান। এ ছবিতে রাজ্জাক ও সোহেল রানার সঙ্গে অন্যতম নায়ক হিসেবে তার অভিনয় দর্শকদের নজর কাড়ে। ১৯৮০ সালে আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘কসাই’ ছবিতে কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি পান আলমগীর। এ ছবিতে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে ছিলেন কবরী।

সুদর্শন ও সুঅভিনেতা আলমগীর দর্শকদের মন জয় করে নেন। সামাজিক ছবিতে তিনি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পান। শাবানার সঙ্গে তার জুটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৮৫ সালে কামাল আহমেদ পরিচালিত ‘মা ও ছেলে’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুবাদে প্রথমবারের মতো সেরা অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করেন আলমগীর। শাবানার বিপরীতে ‘ভাত দে’, ‘সত্যমিথ্যা’, ‘স্বামী স্ত্রী’, ‘সখিনার যুদ্ধ’, ‘রজনীগন্ধা’, ‘রাঙাভাবী’, ‘মরণের পরে’, ‘পিতা মাতা সন্তান’, ‘অচেনা’, ‘অন্ধবিশ্বাস’ ইত্যাদি ব্যবসাসফল ছবিতে অভিনয় করেন আলমগীর। শাবানার বিপরীতে তার জুটি এক সময় এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে পর্দার বাইরেও তাদের রোমান্স চলছে এমন গুঞ্জন প্রকাশিত হয় চিত্রালী, পূর্বাণী ইত্যাদি সিনে পত্রিকাগুলোতে। দর্শকরাও এ গুজব উপভোগ করতেন তাদের প্রিয় জুটি সম্পর্কে। যদিও আলমগীর ও শাবানা দুজনেই তখন ছিলেন বিবাহিত। ১৯৭৩ সালে চলচ্চিত্রে আসার আগে গীতিকার ও কবি খোশনূরকে বিয়ে করেন তিনি। এই দম্পতির সন্তান আঁখি আলমগীর বাংলাদেশের বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী।

রোজিনার বিপরীতেও আলমগীরের পর্দা রোমান্স ছিল দর্শকপ্রিয়। ১৯৮৯ সালে মালেক আফসারি পরিচালিত ‘ক্ষতিপূরণ’ ছবিতে রোজিনার বিপরীতে তার জুটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ছবিটি ব্যবসাসফলও হয়েছিল। এ ছবিতে অভিনয়ের জন্য আলমগীর সেরা অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।

১৯৯০ সালে রোজিনার বিপরীতে তার অভিনীত ‘দোলনা’ ছবিটিও দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। শিবলি সাদিক পরিচালিত ব্যবসাসফল এ ছবিটিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছিলেন রোজিনা।

১৯৯০ সালে আজহারুল ইসলাম খান পরিচালিত ‘মরণের পরে’ ছবিতে অভিনয়ের সুবাদে আলমগীর আবার জয় করেন সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার।

পরের বছর এজে মিন্টু পরিচালিত ‘পিতা মাতা সন্তান’ ছবির জন্য সেরা অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ১৯৯২ সালে মতিন রহমানের ‘অন্ধবিশ্বাস’ ছবিতে অভিনয়ের জন্যও পান সেরা অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ১৯৯৪ সালে কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘দেশপ্রেমিক’ ছবিতে অভিনয়ের জন্যও সেরা অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করেন। তিনি সেরা অভিনেতা হিসেবে সাতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। আর পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন দুবার। সে দু’টি ছবি হলো ‘জীবন মরণের সাথী’(২০১০) এবং ‘কে আপন কে পর’(২০১১)।

১৯৯৬ সালে তিনি অভিনয় করেন ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ ছবিতে। সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত আখতারুজ্জামান পরিচালিত এ ছবিতে তিনি ববিতার বিপরীতে অভিনয় করেন। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জীবনসংগামের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে ছবিটির কাহিনি। এ ছবিতে নেতিবাচক বং সম্পূর্ণ নন গ্ল্যামারাস চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেন আলমগীর। শিল্পধারার  ছবিটি সমালোচকদের ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়।

১৯৯৫ সালে ‘শিল্পী’ ছবিতে অভিনয় করার সময় তার ব্যক্তিগত জীবনের মোড় ঘুরে যায়। চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘শিল্পী’ ছবিটি ছিল এদেশের কিংবদন্তি শিল্পী রুনা লায়লার জীবনের ঘটনাভিত্তিক। এ ছবিতে রুনা লায়লা নিজেই তার চরিত্রে অভিনয় করেন। রুনা লায়লার বিপরীতে নায়ক ছিলেন আলমগীর। অভিনয়ের সময় পর্দার বাইরেও ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তারা দুজন। ১৯৯৯ সালে খোশনূরের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় আলমগীরের। রুনা লায়লা ও আলমগীর জুটি এরপর বিয়ে করেন।

আলমগীর নিজেও সুগায়ক। টিভিতে অনেক গান পরিবেশন করেছেন তিনি। ‘আগুনের আলো’ চলচ্চিত্রে তিনি প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে গান পরিবেশন করেন। ‘কার পাপে’, ‘ঝুমকা’, ‘নিষ্পাপ’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রে তিনি গানে কণ্ঠ দিযেছেন। পরিচালক হিসেবে আলমগীর সফল। তার পরিচলিত প্রথম ছবি হলো ‘নিষ্পাপ। এ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৮৬ সালে।

আলমগীর অনেক টিভিনাটকে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত টিভি সিরিয়াল ‘কাছের মানুষ’ বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। তিনি বিভিন্ন টিভিতে ঈদের অনুষ্ঠানসহ অনেক বিশেষ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানও সফলভাবে উপস্থাপনা করেছেন।

নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে এবং নতুন শতকে তিনি চরিত্রাভিনয়ে খ্যাতি পান। ‘কন্যাদান’, ‘টাকা’, ‘জীবনমরণের সাথী’, ‘কে আপন কে পর’ ইত্যাদি ছবিতে সফল চরিত্রাভিনেতা হিসেবে তাকে দেখা যায়। ২০১৩ সালে রাজ্জাক, সোহেল রানা ও শাকিব খানের সঙ্গে তিনি ‘জজ ব্যরিস্টার পুলিশ কমিশনার’ ছবিতে অভিনয় করেন। ‘দুই পৃথিবী’ ছবিতেও পার্শ্ব-চরিত্রে তার অভিনয় দর্শকপ্রিয়তা পায়।

কয়েক বছর অভিনয় থেকে দূরে থাকলেও চলতি বছর শোনা গেছে তিনি ‘বিজলী’ নামে একটি ছবিতে অভিনয় করছেন। ইফতেখার চৌধুরী পরিচালিত এ ছবিতে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে আছেন ববি। আলমগীর এ ছবিতে নায়িকার বাবার চরিত্রে অভিনয় করছেন।

আলমগীরকে বলা হয় বাংলাদেশের চিরসবুজ নায়ক। মানানসই ছিলেন সব ধরনের চরিত্রে। ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, ডাক্তার, গায়ক, গ্রামের যুবক, শহুরে প্রতিবাদী তরুণ, আইনজীবী, বিচারক, মাস্তান, পুলিশ, ধনী, গরীব বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে তিনি সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। তিনি এদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের অন্যতম শক্তিশালী অভিনেতা। দুশর বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করা এই শিল্পী বাংলাদেশের অভিনয়জগতকে আরো সমৃদ্ধ করবেন সেই কামনাই রইলো।