একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এক অন্য লড়াইয়ে জন্ম নেওয়া যে শিশুদের এতদিন ‘যুদ্ধশিশু’ নামে ডাকা হত, তাদেরকে ‘বিজয়শিশু’ নামে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান এসেছে।
Published : 22 Mar 2016, 10:26 PM
এই শিশুদের নিয়ে নির্মিত ‘জন্মসাথী’র নির্মাতা শবনম ফেরদৌসী মঙ্গলবার ঢাকায় তার প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে এই দাবি তুললে তাতে সায় দেন উপস্থিত অন্যরাও।
শবনম ফেরদৌসী বলেন, “আমি কোনো যুদ্ধশিশুকে খুঁজে পাইনি। আমি যুদ্ধশিশু বলতেও চাই না। আমি বলতে চাই, ভিক্টরি চাইল্ড। বিজয় শিশু।”
বাংলাদেশের স্বাধীনতার উষালগ্নে জন্ম নেওয়া শবনম ফেরদৌসী তার সঙ্গে পৃথিবীর আলোতে আসা অথচ ভিন্নভাবে পরিচিত শিশুদের সঙ্গে নিজের বন্ধন টের পান, যা তাকে এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি নির্মাণে তাড়িত করেছে।
জন্মের পর পরিবারে তাকে ‘ভিক্টরি চাইল্ড’ ডাকা হত জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার সঙ্গে যারা জন্ম নিয়েছে, তারা কেন ওয়ার চাইল্ড? তাদের জন্মের বিনিময়ে এই দেশ হয়েছে, আমার জন্মের বিনিময়ে নয়।
“আজকে যদি আমি আপনাদের ভাষায় যুদ্ধশিশু হতাম, সুধীরের (প্রামাণ্যচিত্রটির চরিত্র) চেয়েও করুণ জীবন হতে পারত। আমার জীবন হতে পারত ব্রথেলে। সুধীর যদি আমার মা-বাবার ঘরে জন্ম নিত, তাহলে সে সংসদ সদস্যও হতে পারত। সে ভাবতেও পারে না, সুধীরের কল্পনায়ও নেই-এটি হওয়া সম্ভব।. . .কেন?”
এই ‘বিজয় শিশু’দের জন্য ‘করুণা নয়’ মন্তব্য করে শবনম বলেন, “আসলে প্রশ্ন তোলা উচিৎ, কী করেছি তাদের জন্য? ৪৫ বছর ধরে আমরা স্বাধীনতার জন্য এত গর্ববোধ করি, আমরাই আবার গণহত্যাটা করেছি।
“যুদ্ধশিশুদের ভিক্টরি চাইল্ড, বিজয়শিশু পরিচয় চাই। কেন সে তার জীবন লুকিয়ে রাখবে?”
তিনি বলেন, “যে দেশের দেবী হচ্ছে মা, মাতৃত্ব হচ্ছে যেখানে সবচেয়ে বড় শক্তি- মা হওয়ার আগে আমাদের কোনো মূল্য নেই, মা হওয়ার পর আমরা একটা স্ট্যাটাস পাই; সেই দেশে মা হওয়ার কারণে একজন নারীকে সমালোচিত হতে হয়েছে।
“মা হিসাবে আমার প্রশ্ন, শুধু একটি বাবার পরিচয়ের কারণে আমার সন্তান সন্তান নয়? তাকে এই দেশে ৪৫ বছর ধরে ক্রমশ কবর দেওয়া হয়েছে। তুরীন আফরোজ (প্রসিকিউটর) বলেছে, আমার কাছেও যুদ্ধশিশু ধারণাটা একটা গণহত্যা।”
নির্মাতার বক্তব্যের পর একাত্তরের এই শিশুদের মর্যাদাপূর্ণ জীবনে ফেরানোয় রাষ্ট্রের কর্তব্য এবং এ নিয়ে কাজ শুরু করার প্রতিশ্রুতি দেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।
“একাত্তরে পুরুষ-নারী উভয়েই যুদ্ধ করেছে, দুজনেই দেশরক্ষার এবং প্রাণ রক্ষার যুদ্ধ করেছে। নারীকে একটা যুদ্ধ বেশি করতে হয়েছে, সম্ভ্রম রক্ষার যুদ্ধ। সুতরাং নারীর ছিল তিন যুদ্ধ, পুরুষের ছিল দুই যুদ্ধ। সেদিক থেকে যে স্বাধীনতা আমরা ভোগ করছি, সেখানে নারীর অবদান একধাপ বেশি।
“সেই নারীর সন্তান যারা, তাদেরকে আমরা বিজয়শিশু বলি . . . যুদ্ধশিশু বলি- তাদেরকে মর্যাদাপূর্ণ জীবন দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য,” বলেন তিনি।
সরকার এই কর্তব্য পালন করতে শুরু করেছে জানিয়ে এই পর্বের ঘটনাগুলোকে সামনে নিয়ে আসতে সবার সহযোগিতা চান মন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরও ছিলেন।‘কেন যুদ্ধশিশুদেরকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে’ -প্রামাণ্যচিত্রে কানাডা প্রবাসী মনোয়ারা ক্লার্কের এই প্রশ্নের কোনো জবাব নেই মন্তব্য করে তাদের পাশে দাঁড়ানোর গুরুত্ব তুলে ধরেন তিনি।
যে তিন ‘যুদ্ধশিশু’ নিয়ে এই প্রামাণ্যচিত্র, তাদের একজন সুধীর বর্মন এবং সুধীরের মেয়ে জনতা বর্মনও বসুন্ধরা স্টার সিনেপ্লেক্সের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী, অধিকারকর্মী খুশি কবির, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরীন আফরোজও ছিলেন অনুষ্ঠানে।
নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, মোরশেদুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্র নির্মাতাও এই আয়োজনের সাক্ষী হন।
৯০ মিনিট দীর্ঘ এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি একাত্তর টেলিভিশন ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছে। এর প্রদর্শনীর মিডিয়া পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
একাত্তর টেলিভিশনের সম্পাদক ও প্রধান নির্বাহী সামিয়া জামান এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সদস্য সচিব তারিক আলী অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী প্রদর্শনীর ঘোষণা দেন।
প্রামাণ্যচিত্রের কাহিনীতে দেখা যায়, স্বাধীনতার পরপরই বাহাত্তরের মধ্য জানুয়ারিতে রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালে জন্ম নেওয়া ১৩ শিশুর একজন শবনম ফেরদৌসী বাকিদের সন্ধানে বের হয়েছেন।
এই ১৩ জনের পাঁচজন ছিল ‘যুদ্ধশিশু’। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যে অগুনতি নারীকে নিজেদের সম্ভ্রম বিসর্জন দিতে হয়েছে, তাদের পাঁচজন ছিলেন এই শিশুদের মা।
একই হাসপাতালে জন্ম নেওয়ার বন্ধন থেকেই নির্মাতার দৃষ্টিতে তারা হয়ে উঠেছেন পরস্পরের ‘জন্মসাথী’।
অনুসন্ধানে এই জন্মসাথীদের না পেলেও বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে জন্ম নেওয়া অন্য তিন যুদ্ধশিশুর সন্ধান শবনম পেয়েছেন; তাদের নিয়েই এগিয়েছে প্রামাণ্যচিত্রটি।
এদের একজন মনোয়ারা ক্লার্ক, ১৯৭২ সালে যাকে কানাডার একটি পরিবার দত্তক নিয়ে যায়। সময়ের স্রোতে জীবন এগিয়ে চললেও ৪৩ বছর বয়সে গিয়ে জগৎ সংসারের জটিলতায় তার প্রয়োজন পড়ে জন্ম সনদের।
নিজের দেশ হলেও ‘অচিন’ মানুষ হিসাবেই ২০১৪ সালে বাংলাদেশে এসে নিজের জন্ম সনদ নিয়ে যান মনোয়ারা।
বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধে নিপীড়িত এক মায়ের গর্ভে জন্মানো এই শিশু বাহাত্তরে দূরে ঠেলে দেওয়ার কষ্টটি যে কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না, অকপটে সেটাও বলে যান।
মনোয়ারার মতো যাদেরকে দেশ দূরে ঠেলে দেয়নি-এমন দুজনের কাহিনীও এসেছে এই প্রামাণ্যচিত্রে। তাদের একজন উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের সুধীর। ‘জারজ’ পরিচয় নিয়ে তাকে বাঁচতে হয় স্বাধীন বাংলাদেশে।
তবে সবচেয়ে কঠিন জীবনটা শামসুন নাহারেরই। ভাঙাচোরা ঘরওয়ালা সুধীরের তুলনায় কষ্ট আর লড়াইটা তারই বেশি।
১৬ কোটি মানুষকে রাষ্ট্রীয় ঠিকানা দিতে যার জন্ম, সেই শামসুন নাহারেরই কোনো ঠিকানা নেই। পৃথিবীর কোনো ঘরই তার ঘর নয়।
এর মধ্যেই অটুট মনোবলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন শামসুন নাহার। মাথা গোঁজার ঠাই না থাকা এই নারী রাষ্ট্রের কাছে কিছু না চেয়ে বরং এর মাঝেই ভবিষ্যতের জীবন চলে যাবে বলে মনে করেন।
‘জন্মসাথী’ প্রামাণ্যচিত্রটিকে একাত্তরে নারীদের ওপর সংঘটিত নিপীড়ন-নির্যাতন ও যুদ্ধাপরাধের একটি দলিল অভিহিত করে তথ্যমন্ত্রী ইনু বলেন, যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দোসরদের জাতি কখনও ক্ষমা করবে না। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বীরা প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশির মুখোশপরা পাকিস্তানপন্থি।
“আমি ছবিটা দেখেছি, সারাক্ষণ কেঁদেছি। শুধু কেঁদেছি বললে ভুল হবে, ক্রোধেরও জন্ম হয়েছে। আমরা কি আবার একাত্তরে ফিরে যেতে পারি না? অস্ত্র হাতে তুলে নিতে পারি না?” প্রতিক্রিয়া আসে আসাদুজ্জামান নূরের।