অদ্বিতীয়া দিতির অকাল প্রয়াণ

'ভালোবাসা যত বড়, জীবন তত বড় নয়' - নিজের অভিনীত এই গানটিকে সত্যি করে চলে গেলেন দিতি। অসংখ্য ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ীর ভালোবাসা তাকে ধরে রাখতে পারলো না।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 March 2016, 11:55 AM
Updated : 20 March 2016, 01:09 PM

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে প্রথমবারের মতো ১৯৮৪ সালে নতুন মুখের সন্ধানে নামে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। চলচ্চিত্রে নতুন শিল্পীদের আগমন সহজ করার জন্য এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৪ সালে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে চলচ্চিত্র জগতে আসেন পারভিন সুলতানা দিতি। এর আগেই টিভিতে গান পরিবেশন করেছিলেন এবং কয়েকটি টিভি নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি। এর মধ্যে একটি টিভি নাটকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এক তরুণীর ভূমিকায় চমৎকার অভিনয় করে দর্শক ও নির্মাতাদের নজর কাড়েন তিনি। সে নাটকে তিনি স্বকণ্ঠে গানও পরিবেশন করেন।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তিনি। ১৯৬৫ সালের ৩১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় গান গেয়ে পুরস্কার পেয়েছেন।

উদয়ন চৌধুরি পরিচালিত ‘ডাক দিয়ে যাই’ সিনেমার মাধ্যমে প্রথম রূপালি ভুবনে পা রাখেন তিনি। তবে ছবিটি মুক্তি পায়নি। আজমল হুদা মিঠু পরিচালিত ‘আমিই ওস্তাদ’ দিতি অভিনীত প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। প্রথম ছবিতেই বাজিমাত। দর্শকের মন জয় করে নেন সুন্দরী ও সুঅভিনেত্রী দিতি। পর পর বেশ কয়েকটি ছবি মুক্তি পায় তার, পায় বাণিজ্যিক সাফল্য। কবরী, আফজাল হোসেন ও দিতি অভিনীত ‘দুই জীবন’ ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়। সমালোচকদের প্রশংসাও পায়। 

এরই মধ্যে পারিবারিকভাবে তার বিয়ের কথা স্থির হওয়ায় অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি। হাতে থাকা কয়েকটি ছবির কাজ দ্রুত শেষ করতে থাকেন। ১৯৮৫ সালে আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘হীরামতি’ ছবিতে কাজ করার সময় সহশিল্পী সোহেল চৌধুরীর প্রেমে পড়েন। তারা দুজন একই সঙ্গে নতুন মুখের প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন এবং ‘পর্বত’সহ কয়েকটি ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছিলেন| ওই বছরই তারা ঘর বাঁধেন।

‘হীরামতি’র সাফল্যের পর এ জুটির কয়েকটি ছবি মুক্তি পায়। সোহেল চৌধুরী-দিতি অভিনীত ‘চিরদিনের সাথী’ ছবিটিও মোটামুটি ব্যবসা সফল হয়| দিতি চলচ্চিত্রে সফল ক্যারিয়ার গড়ে তোলেন। ইলিয়াস কাঞ্চন ও মান্নার বিপরীতে তার অভিনয় দর্শকপ্রিয়তা পায়। ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে জুটি বেঁধে ‘দয়ামায়া’, ‘আত্মবিশ্বাস’, ‘ভাইবন্ধু’, ‘বাঁচার লড়াই’, ‘আম্মা’, ‘অচল পয়সা’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘প্রেমের প্রতিদান’, ‘চরম আঘাত’, ‘এই নিয়ে সংসার’, ‘ভাই কেন আসামী’, ‘আসামী গ্রেফতার’সহ প্রায় পঞ্চাশটি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। আশি ও নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ইলিয়াস কাঞ্চন-দিতি জুটি ছিল বাণিজ্যিকভাবে দারুণ সফল। জাফর ইকবালের বিপরীতেও দিতি সাফল্য পেয়েছিলেন।

১৯৮৭ সালে সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘স্বামী-স্ত্রী’ ছবিতে অভিনয়ের সুবাদে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করেন দিতি। এ ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন আলমগীর| আশির দশকের শেষ দিকে দিতি ছিলেন তরুণীদের ফ্যাশন আইকন। তার সাজ পোশাক দারুণ জনপ্রিয়তা পায় ভক্ত-দর্শকদের মধ্যে। তিনি বাণিজ্যিক ছবির নায়িকা ছিলেন এবং স্নিগ্ধ রূপের ও অভিনয়ের জন্য ছিলেন দর্শকদের  ভীষণ প্রিয়। বাণিজ্যিকভাবে সফল ‘উছিলা’ ছবিতে জাফর ইকবালের বিপরীতে অভিনয় করেন তিনি। তাদের পর্দা রোমান্স দর্শকপ্রিয়তা পায় দারুণভাবে।

‘আমি একদিন তোমায় না দেখিলে’, ‘তুমি আজ কথা দিয়েছ’, ‘তুমি আমার আমি তোমার চিরদিনের সাথী’, ‘যোগী ভিক্ষা লয় না’, ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, ‘আমার মনের আকাশে আজ’, ‘ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়’ ইত্যাদি চিরসবুজ গানের দৃশ্যে দিতি ছিলেন অনবদ্য।

১৯৮৭ সালে জন্ম হয় দিতি-সোহেল দম্পতির প্রথম সন্তান লামিয়া চৌধুরীর। ১৯৮৯ সালে এ দম্পতির ছেলে দীপ্ত চৌধুরীর জন্ম হয়। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে দিতি ও সোহেল চৌধুরীর বিচ্ছেদ ঘটে। সোহেল চৌধুরীর অপমৃত্যুর পর বিপত্নীক ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে বিয়ে হয় দিতির। স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে সন্তানদের নিয়ে একাকী জীবন যাপন করছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন। কিন্তু পর্দায় সফল জুটি হলেও বাস্তবে দিতি-কাঞ্চনের সংসার খুব স্বল্পদিন স্থায়ী হয়। মূলত সন্তানদের নিয়ে দ্বন্দ্বই এই বিচ্ছেদের মূল কারণ বলে জানা যায়।

দিতি অভিনীত অন্যান্য ছবির মধ্যে ‘দুই জীবন’, ‘উছিলা’, ‘লেডি ইন্সপেক্টর’, ‘খুনের বদলা’,  ‘আজকের হাঙ্গামা’, ‘শেষ উপহার’, ‘অপরাধী’, ‘কালিয়া’, ‘কাল সকালে’, ‘মেঘের কোলে রোদ’, ‘আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা’, ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনি’ ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি দুশ’রও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে তিনি চরিত্রাভিনয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

নতুন শতকের মাঝামাঝিতে আবার চলচ্চিত্রজগত ত্যাগ করেন তিনি। ফিরে আসেন কয়েক বছর আগে। অসুস্থতার আগেও বেশ কয়েকটি ছবিতে কাজ করছিলেন তিনি। তার শেষ মুক্তি পাওয়া সিনেমা 'সুইটহার্ট', যেখানে নায়ক বাপ্পীর মায়ের ভূমিকায় তাকে দেখা গেছে।

চলচ্চিত্রের পাশাপাশি টিভি নাটকেও জনপ্রিয় মুখ ছিলেন দিতি। বেশ কয়েকটি টিভি সিরিয়ালেও অভিনয় করেছেন। রান্না বিষয়ক অনুষ্ঠানও উপস্থাপনা করেছেন। বস্তুত তিনি যে কাজেই হাত দিয়েছেন সফল হয়েছেন। ক্যারিয়ার ছেড়ে বার বার চলে গেলেও দর্শক তাকে ভোলেনি। যখনই ফিরেছেন, অভিনয় করেছেন, তাকে দর্শক গ্রহণ করেছে সাদরে। নায়িকা ও চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে বরাবরই তিনি নির্মাতাদের পছন্দের তালিকায় স্থান পেয়েছেন।

জীবনের মাত্র পঞ্চাশ বছর পার করে দিতি চলে গেলেন মৃত্যুর দেশে। তবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অদ্বিতীয়া এই শিল্পী চিরদিন বেঁচে থাকবেন তার ভক্তদের স্মরণের মণিকোঠায়।