'সারেং বউ': নারীর অন্তহীন সংগ্রামের বয়ান

শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ - যাই হোক না কেন নারীকে লড়ে যেতে হয় সব খানে, সব সময়। তবু নারীই পারে সব সংস্কারকে পায়ে দলে জীবনের জয় ঘোষণা করতে।পুরুষশাসিত সমাজে নারীর এই বেঁচে থাকার এবং নতুন সমাজ গড়ার পথে এগিয়ে যাওয়ার গল্প বলে ‘সারেং বউ’।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 March 2016, 07:17 AM
Updated : 9 March 2016, 07:17 AM

শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৭৮ সালে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র ‘সারেং বউ’।

এদেশের বামপন্থী আন্দোলনের অন্যতম নেতা কমিউনিস্ট পাটর্ির বিশিষ্ট সদস্য ও সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার উপন্যাসটি লেখেন ১৯৬১ সালে। সে সময় তিনি পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন।

নোয়াখালির উপকূলীয় অঞ্চলের এক নারীর জীবনযুদ্ধের দলিল 'সারেং বউ'। উপকূলীয় এক গ্রামের সহজ সরল মেয়ে নবিতুন। এক বৃদ্ধ সারেংয়ের মেয়ে সে। তার বাবার বন্ধু মদন সারেংয়ের ছেলে কদম সারেং জাহাজের চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে গ্রামে ফেরে। কদম সারেংয়ের বাবা-মা মারা গেছে। সেই এখন সারেংবাড়ির বড় ছেলে। চাচা তার অভিভাবক।

তরুণ কদম সারেং নতুন করে মুগ্ধ হয় সদ্য তরুণী নবিতুনকে দেখে। ছোটবেলা থেকেই তারা পরস্পরের পরিচিত। নতুন করে তাদের প্রেমের সূচনা হয়। পরিবারের সকলের সম্মতিতে বিয়ে হয় তাদের।

নবিতুন চায় জাহাজের চাকরি ছেড়ে গ্রামেই কৃষিকাজ করুক কদম। কিন্তু নাবিকের রক্ত বইছে কদমের ধমণীতে। সমুদ্র তাকে ডাকে। সেই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারে না কদম।

নতুন বউ ফেলে জাহাজের চাকরিতে চলে যায় সে। যাবার আগে বাড়ির আঙিনায় সে একটি বড়ই গাছের চারা লাগিয়ে রেখে যায়। সেই গাছটি বড় হতে থাকে। সেই গাছের দিকে তাকিয়ে স্বামীর ফেরার পথ চেয়ে থাকে সারেং বাড়ির বউ নবিতুন। জন্ম হয় তাদের মেয়ের। বাবার স্নেহ ছাড়াই বড় হয়ে উঠতে থাকে মেয়েটি।

বিদেশ থেকে কয়েক মাস টাকা ও চিঠি পাঠায় কদম। গ্রামের মোড়ল লন্দুর চোখ পড়ে সুন্দরী নবিতুনের দিকে। নবিতুন তাকে পাত্তা দেয় না। বরং অপমান করে। কুপ্রস্তাব দিয়ে এক ‘গুজা বুড়ি’কে বারে বারে পাঠায় মোড়ল। তাকে তাড়িয়ে দেয় নবিতুন। পোস্টমাস্টারকে হাত করে কদমের পাঠানো টাকা ও চিঠি লুকিয়ে ফেলতে থাকে মোড়ল। চরম অভাবে পড়ে নবিতুন। মোড়ল মনে করে দরিদ্র নবিতুন এবার হয়তো তার কুপ্রস্তাবে রাজি হবে। কিন্তু ঢেঁকিতে ধান ভেনে বহু কষ্টে নিজের ও মেয়ের অন্ন জোগাড় করে সে। চাচাতো ননদ শরবতি সাহায্য করে নবিতুনকে। তারসঙ্গে সুখ দুঃখের কথা বলে সে।

গঞ্জে ধানের কল বসে। ঢেঁকি ছাঁটা চালের আর কদর নেই। যন্ত্রসভ্যতার আগ্রাসী রূপের কাছে আরো অসহায় হয়ে পড়ে শ্রমজীবী নবিতুন।সারেং বাড়ির বউ হয়ে অন্যের বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতে সম্মানে বাধে তার। তবু বেঁচে থাকার তাগিদে এবার চৌধুরি বাড়িতে গৃহস্থালির কাজ করতে থাকে নবিতুন। চৌধুরি বাড়ির ছোট বউ তাকে নানাভাবে সাহায্য করে। কিন্তু সেখানেও বিপদ। দুশ্চরিত্র ছোট চৌধুরি, তার দিকে লোভের হাত বাড়াতে থাকে। বহুকষ্টে নিজেকে রক্ষা করে চলে সে। শাপলা ও শাক পাতা খেয়ে দিন চলে মা-মেয়ের ।

এদিকে কদমের দিন কাটে সমুদ্রে ও বিদেশের বন্দরে বন্দরে। সেখানে যৌনকর্মীদের সঙ্গসুখের প্রলোভন। কিন্তু নবিতুনকে ছুঁয়ে করা প্রতিজ্ঞার কথা ভোলে না কদম। সে বিশ্বস্ত থাকে স্ত্রীর প্রতি।

জাহাজের অনেক নাবিক নানা রকম অপরাধের সঙ্গে জড়িত। বিশেষ করে চোরাচালানী করে অনেকেই ধনী হয়, অনেকে ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কদম সৎ মানুষ। সে এসব অপরাধের সঙ্গে জড়ায় না। তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী, বাবার বন্ধু মন্টু সারেং অবৈধ পাচারের সঙ্গে জড়িত। গোপনে সে কদমের পকেটে অবৈধ দ্রব্য রেখে দেয়। যাতে তার মাধ্যমে বন্দরের বাইরে জিনিষটি পাচার করতে পারে। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে নিরপরাধ কদম। বিদেশের জেলে বন্দি হয় সে।

নবিতুন এসবের কিছুই জানতে পারে না। কদমের উপর অভিমানে তার বুক ভরে থাকে। তবু সাহসী নবিতুন সব প্রতিকূলতাকে জয় করে একা থাকে।

কদম জেল থেকে ছাড়া পেয়ে টাকা পাঠায় গ্রামে। কিন্তু আগের মতোই টাকা লুকিয়ে ফেলে ডাকপিয়ন।

পাটক্ষেতে নবিতুনকে একা পেয়ে ধর্ষণ করতে চায় লন্দু মোড়ল। নবিতুন প্রাণপণে তাকে কামড় দিয়ে নিজেকে রক্ষা করে।

দীর্ঘদিন ধরে কদম বিদেশে। তাকে মৃত বলে ধরে নেওয়া হয়। সারেং বাড়ির বউ হয়ে নবিতুন চৌধুরি বাড়িতে বাঁদীর কাজ করে। এতে পরিবারের মানসম্মান নষ্ট হচ্ছে। তাই চাচা শ্বশুর ও লন্দু মোড়ল সালিশ বসায়। গ্রামের পারিবারিক বৈঠকে স্থির হয় কদমের চাচাতো ভাই কোরবানের সঙ্গে বিয়ে হবে নবিতুনের। এই প্রস্তাবে রাজি না হলেও তার উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। লন্দু মোড়ল কোরবানকে গোপনে বোঝায় বিয়ের পর সে শুধু একবার নবিতুনকে তালাক দেবে তাহলে তাকে হিল্লা বিয়ে করতে পারবে লন্দুমোড়ল এবং শোধ নেবে নবিতুনের প্রত্যাখ্যানের। বিনিময়ে কোরবানকে গঞ্জের হাটে দোকান করে দেবে সে।

নবিতুনের আপত্তি কেউ শোনে না। বিয়ের দিন স্থির হয়। সেই সময় গ্রামে ফেরে কদম। নবিতুন নতুন সুখের সম্ভাবনা দেখে। কিন্তু গ্রামের মোড়ল ও কুচক্রী মানুষ কদমের কানে কুমন্ত্রণা দেয়। তাকে বলে নবিতুনের গর্ভে যে সন্তান তা অন্য মানুষের, কদমের নয়। সন্দেহের বিষে জ্বলে ওঠে কদম। নবিতুনের কষ্ট যেন আরো বেড়ে যায়। যে স্বামীর জন্য তার এতদিনের সংযম ও প্রতীক্ষা সেই স্বামীই তাকে সন্দেহ করে। তাকে তালাক দিতে চায়। গর্ভস্থ শিশুটির মৃত্যু হয় কদমের লাথিতে।

এদিকে প্রকৃতিও যেন আঘাত হানতে উদ্যত হয় জনপদের ওপর। সাইক্লোন ধেয়ে আসে উপকূলে। ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষের গড়া সভ্যতার চিহ্ন। প্রবল ঝড়ে ও বানে ভেসে যায় কদম ও নবিতুন। মৃত্যু হয় মেয়ে আক্কির। লন্দু মোড়লের মৃত্যু হয় সাপের কামড়ে।

সারা রাতের সাইক্লোনের পর শান্ত হয় প্রকৃতির রুদ্র রোষ। নবিতুন নিজেকে আবিষ্কার করে এক চরের মধ্যে। কাঁদার ভিতর সে পড়ে আছে। বানের পানিতে ভেসে এসেছে সে এখানে।চারিদিকে মানুষ ও পশুর লাশ। একটু পরে সে শোনে কাঁদায় পড়ে পানি পানি করে আর্তনাদ করছে মৃতপ্রায় কদম। নবিতুন তাকে জলপান করালে সাগরের লোনা পানি থুথু করে ফেলে দেয় সে। খাবার পানির সন্ধানে এদিক ওদিক খোঁজে সে। কিন্তু কোথায় পাবে। শেষ পর্যন্ত স্তনদুগ্ধ দিয়ে কদমের তৃষ্ণা মেটায় সে, তার প্রাণ বাঁচায়। চেতনা ফিরে পেয়ে হাহাকার করে ওঠে কদম। বলে ‘আমারে পর কইরা দিলি বউ?” কারণ প্রচলিত রীতি অনুযায়ী তাদের মধ্যে আর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে না। এবার বলিষ্ঠ কণ্ঠে নবিতুন বলে জান বাঁচানো ফরজ। সে ভেঙে ফেলে প্রচলিত ঘুণে ধরা সংস্কারের বেড়াজাল। নতুন চরের বুকে নতুন সূর্য ওঠে। নতুন জীবনের, নতুন সমাজের ইশারা নিয়ে আসে সেই সূর্য। অতীতের সব জঞ্জাল ও কদর্য স্মৃতি মুছে ফেলে নবিতুন ও কদম এগিয়ে চলে নতুন সমাজ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় বুকে নিযে।

এই এপিকধর্মী কাহিনিচিত্রটি পরিচালনা করেন আবদুল্লাহ আল মামুন। সংগীত পরিচালক ছিলেন আলম খান। গীতিকার মুকুল চৌধুরী। কণ্ঠশিল্পী ছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন, রথীন্দ্রনাথ রায়, আবদুল জব্বার। এ ছবির ‘ওরে নীল দরিয়া’ বাংলা চলচ্চিত্রের চির সবুজ গানের তালিকায় রয়েছে।

সংগ্রামী নারী নবিতুনের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন কবরী। তার আনন্দ, বেদনা, হতাশা ও সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার প্রাণপণ চেষ্টাকে পর্দায় সার্থকভাবে ফুটিয়ে তোলেন তিনি। কদম সারেং চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন ফারুক। লন্দু মোড়লের চরিত্রে ছিলেন আরিফুল হক। অন্যান্য চুরিত্রে অভিনয় করেন গোলাম মোস্তফা, জহিরুল হক, নাজমুল হুদা বাচ্চু, বাবর, দারাশিকো, নার্গিস, মিনু রহমান প্রমুখ।

ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে যেমন দারুণ সফল হয় তেমনি সমালোচকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা পায়। এ ছবিতে অভিনয়ের সুবাদে সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান কবরী।

‘সারেং বউ’ উপন্যাস ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে উঠে আসে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে নারীর সংগ্রামের বহুমুখী চিত্র। আবার নারীর পাশে দাঁড়ানো অন্য নারীর সহমর্মিতার ছবিও দেখা যায়। চৌধুরি বাড়ির ছোট বউ ধনী ঘরের হলেও সে নির্যাতিত এবং নিরুপায়। তবু শরবতি ও ছোটবউ দাঁড়ায় নবিতুনের পাশে। অন্যদিকে পুরুষশাসিত সমাজ নারীকে নিষ্পেশন করে বিভিন্ন কৌশলে। তাকে উপার্জন ও চলাচলের স্বাধীনতা দেয় না, তাকে রাখতে চায় নিজের নিয়ন্ত্রণে। নারীর মতও কেউ গ্রাহ্য করে না। যখন তাকে সে মুঠোয় পুরতে পারে না তখন তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এমনকি প্রিয় পুরুষটিও তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তবু নারী পরাজিত হয় না। নারী পৃথিবীতে নিয়ে আসে নতুন জীবন, গড়ে তোলে নতুন সমাজ।