আয়নায় যে মুখ আর দেখবে না কেউ

টেলিফোনের দুপ্রান্তে দুজন। একজন দোকানের ফোন থেকে কথা বলছেন। অন্যজন ধনীর সন্তান। তিনি ফোনে গান শোনাচ্ছেন নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের প্রেমিকাকে।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Feb 2016, 08:44 AM
Updated : 16 Feb 2016, 08:44 AM

শবনম ও রাজ্জাক অভিনীত ‘নাচের পুতুল’ ছবির একটি দৃশ্য। এমন কতো দৃশ্যই তো রয়েছে বাংলা সিনেমায়। এই দৃশ্যটি কালজয়ী হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে একটি গান - ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’। অসামান্য এই সুরের স্রষ্টা রবিন ঘোষ।

‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো’, ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা’, ‘পিচ ঢালা ওই পথটারে ভালোবেসেছি’-এমন অসংখ্য চির সবুজ গানের সুরকার ছিলেন রবিন ঘোষ। হারানো দিনের বাংলা ছবির প্রেমের গানের কথা বলতে গেলে রবিন ঘোষকে এড়িয়ে যাবার কোনো পথ নেই। তার সুরে যেন খেলা করতো বসন্তের আকুলতা। আর বসন্তের প্রথম দিনটিতেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন এই গুণী সংগীতজ্ঞ।

রবিন ঘোষের জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। বাবার চাকরিসূত্রে তার জন্ম হয় বাগদাদে ১৯৩৯ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিবারের সঙ্গে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। বাবা এস.এম ঘোষ অন্য নারীকে বিয়ে করে তাদের ত্যাগ করে চলে যান।

রবিন ঘোষ ও তার বড়ভাই অশোক ঘোষ মায়ের সাথেই ছিলেন। অশোক ঘোষ ছিলেন ঢাকার বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি রবিন ঘোষের ছিল বিপুল আগ্রহ। তিনি গানের রেকর্ড সংগ্রহ করতেন। নিজে হারমোনিয়াম বাজিয়ে সেসব গান গাইতেন ও সুর তুলতেন। ঢাকার সেগুনবাগিচায় মিউজিক কলেজে তিনি শিক্ষাগ্রহণ এবং সংগীত বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেন।

পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে তিনি ঢাকার রেডিও স্টেশনে চাকরি নেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ঢাকা রেডিও স্টেশন নতুনভাবে গড়ে উঠছিল। লেখক শামসুদ্দিন আবুল কালামসহ অনেক গুণী ব্যক্তি চাকরি করতেন সেখানে। রেডিও স্টেশনেই বিখ্যাত চিত্র পরিচালক এহতেশামের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে রবিন ঘোষের।

১৯৬১ সালে এহতেশাম পরিচালিত ‘রাজধানীর বুকে’ ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেন রবিন ঘোষ। ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে সফলতা পায়। এই ছবিতে কে জি মোস্তফার লেখা ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো' গানটিতে কণ্ঠ দেন বিখ্যাত শিল্পী তালাত মাহমুদ। দারুণ জনপ্রিয়তা পায় গানটি। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি রবিন ঘোষকে। একের পর এক ছবিতে সংগীত পরিচালক হন তিনি। উর্দু-বাংলা গানে সুর দিতে থাকেন। ‘তালাশ’, ‘চকোরি’, ‘হারানো দিন, ‘পিচ ঢালা পথ’, ‘নতুন সুর’, ‘নাচের পুতুল’ ইত্যাদি দর্শকপ্রিয় ছবির গানে সুর দেন তিনি। তালাত মাহমুদ, ফেরদৌসী রহমান, মাহমুদুন নবী, আবদুল জব্বারসহ জনপ্রিয় শিল্পীরা তার সুরে গান গেয়েছেন। ‘তালাশ’ ছবির সুবাদে ১৯৬৩ সালে তিনি পাকিস্তানের সম্মানজনক নিগার পুরস্কার পান।

তিনি বাণিজ্যিকভাবে সফল  ‘চাহাত, আয়না’, ‘আম্বার’, ‘দুরিয়া’, ‘তুম মেরে হো’সহ বিভিন্ন জনপ্রিয় উর্দু ছবির সংগীত পরিচালনা করেন।

রহমান, রাজ্জাক এবং উর্দু ছবির জনপ্রিয় নায়ক নাদিম, মহম্মদ আলিসহ অনেকে তার সুরারোপিত গানের সংগে পর্দায় অভিনয় করেন।

ছবি: ডন

ষাটের দশকের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নায়িকা ছিলেন শবনম। পারিবারিকভাবে তার নাম ছিল ঝর্ণা বসাক। তিনি ছিলেন রবিন ঘোষের বন্ধুর বোন। সেই সূত্রে গড়ে ওঠে তাদের প্রেম। তারা দুই পরিবারের সম্মতিতে ১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিয়ের পিঁড়িতে বসেন।

উর্দু ছবির জনপ্রিয় নায়িকা হওয়ার সুবাদে পাকিস্তানে শবনমের ছিল জমজমাট ক্যারিয়ার। স্ত্রীর ক্যারিয়ারের কারণে রবিন ঘোষ এক সময় চলে যান পাকিস্তান। আশির দশকের পর এই দম্পতি ঢাকায় ফিরে আসেন।

চার-পাঁচ বছর আগে জাতীয় প্রেসক্লাবে কবি ও গীতিকার কেজি মোস্তফার গানের সিডি প্রকাশনা উৎসবে রবিন ঘোষের সঙ্গে আলাপের সুযোগ ঘটে আমার। রবিন ঘোষ বলেন, ঢাকায় ফিরে আসার পর তিনি আর দেশের সংগীত জগতে সেভাবে জায়গা করে নিতে পারেননি। কারণ তখন নকল গানের হিড়িক চলছে। নতুন যুগের চলচ্চিত্র পরিচালকরা বেশিরভাগই ছিলেন তার অপরিচিত। তিনিও যেচে কারো কাছে যাননি। বলতে গেলে এক ধরনের অভিমান থেকেই নিজেকে গুটিয়ে রাখেন তিনি|

ছবি: ডন

ষাট দশকের বিখ্যাত গীতিকার এবং রবিন ঘোষের অনেক গানের রচয়িতা সাংবাদিক কে জি মোস্তফা সেদিন স্মৃতিচারণ করেছিলেন ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’ গানটি নিয়ে। তিনি বলেন "রবিন ঘোষ তন্ময় হয়ে গানটির সুর করেন এবং আমাকে বলেন এই সুরে রোমান্টিক একটি গান লিখতে।" তিনি রবিন ঘোষের বিস্ময়কর সংগীত প্রতিভার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, "এই গুণী মানুষটির যথাযোগ্য কদর আমরা করতে পারিনি।"

রবিন ঘোষ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ছিলেন। জীবনের শেষদিকে নিভৃতেই কাটিয়েছেন তার গুলশানের বাড়িতে। স্ত্রী শবনম এবং একমাত্র ছেলে রনি ঘোষকে নিয়ে ছিল তার একান্ত সুখের সংসার।

১৩ ফেব্রুয়ারি, পহেলা ফাল্গুনে নীরব অভিমান বুকে নিয়েই চলে গেলেন তিনি। তবে মৃত্যু তার নামকে মুছে দিতে পারবে না কখনও। তার সুরারোপিত অসংখ্য গানের মধ্যে চিরদিন শ্রোতার হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশের কৃতি সন্তান সংগীতজ্ঞ রবিন ঘোষ।