'দেবদাস' - বাঙালির প্রেমের অমর আখ্যান

চন্দ্রমুখী না পারু? পারু কি শুধুই ছোটবেলার সাথী না চিরদিনের ভালোবাসা? এই দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি মেলেনি দেবদাসের। মৃত্যুর আগে পারুর দরজায় এসে পৌঁছাতে পারলেও সমাজের নিগড় ভাঙা যায়নি, শেষ স্পর্শটুকু পাওয়া হয়নি প্রেমিকার। এই ট্র্যাজেডি সম্ভবত দেবদাসকে অমর করেছে। আর তাই রুপালী পর্দায় বারে বারে ফিরে এসেছে দেবদাসের প্রেম।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Feb 2016, 05:54 AM
Updated : 14 Feb 2016, 06:13 AM

মাত্র ১৭ বছর বয়সে ‘দেবদাস’ উপন্যাসটি লিখেছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। শিল্পগুণে ও কাহিনি বিন্যাসে ‘দেবদাস’-এর চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ তার ‘শ্রীকান্ত’, ‘গৃহদাহ’, ‘শেষ প্রশ্ন’, ‘পল্লীসমাজ’ –এর মতো উপন্যাস। কিন্তু ‘দেবদাস’-এ ভালোবাসার যে করুণ, সরল, সর্বজয়ী ও আবেগী চিত্রায়ণ রয়েছে তার তুলনা অন্য কোনো লেখায় পাওয়া বিরল বলেই যুগে যুগে রূপালি পর্দায় দর্শক-হৃদয়কে জয় করেছে বাঙালির প্রেমের প্রতীক দেবদাস ও পার্বতী।

শরৎচন্দ্রের  ‘দেবদাস’ অবলম্বনে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয় কলকাতায় ১৯২৭ সালে। নির্বাক এই ছবিটি পরিচালনা করেন নরেশ মিত্র। এই ছবিতে দেবদাস, পার্বতী ও চন্দ্রমুখীর ভূমিকায় ছিলেন ফণী শর্মা, তারকবালা ও নিহার বালা।

এরপর সবাক চলচ্চিত্রের বা ‘টকি’র যুগ শুরু হয়। ১৯৩৫ সালে কলকাতাতে আবার নির্মিত হয় সবাক ‘দেবদাস’। এর পরিচালক ছিলেন সে যুগের বিখ্যাত অভিনেতা ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব প্রমথেশ বড়ুয়া। তিনি নিজেই দেবদাসের ভূমিকায় অভিনয় করেন। পার্বতী ও চন্দ্রমুখী ছিলেন যমুনা ও চন্দ্রাবতী দেবী। বড়ুয়া-যমুনার জুটি দর্শকদের মুগ্ধ করে। এই দেবদাস দুর্দান্ত বাণিজ্যিক সাফল্য পায়। বাংলাদেশের ফিল্ম আর্কাইভে এখনও এই দেবদাসের অংশ বিশেষ সংরক্ষিত রয়েছে। বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে দেবদাসের মৃত্যুর অভিনয়টি অনবদ্য করেন বড়ুয়া। এবং জমিদার বাড়ির বন্ধ সিংহ দরজায় পার্বতীর আছড়ে পড়ার দৃশ্যে যমুনাও ছিলেন অসামান্য। এই ছবির বাণিজ্যিক সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৩৬ সালে হিন্দিতে ‘দেবদাস’ নির্মাণ করেন বড়ুয়া। এতে দেবদাস , পারু ও চন্দ্রমুখী ছিলেন সে যুগের বিখ্যাত অভিনেতা কুন্দলাল সায়গল, যমুনা ও রাজকুমারী। এটিও বাণিজ্যিক সাফল্য পায়। প্রমথেশ বড়ুয়া ছিলেন আসামের গৌরীপুর জমিদার বাড়ির ছেলে। তিনি এবার অহমিয়া ভাষায় ‘দেবদাস' নির্মাণে উদ্যোগী হন। ১৯৩৭ সালে তার পরিচালনায় অহমিয়া ভাষায় নির্মিত ছবিতে তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেন ফণী শর্মা, জুবাইদা ও মোহিনি। এই ছবির বাণিজ্যিক সাফল্য ভারতের অন্যান্য ভাষাভাষী অঞ্চলে ‘দেবদাস’ নির্মাণে প্রেরণা জোগায়।১৯৫৩ সালে তেলেগু ও তামিল ভাষায় নির্মিত হয় ছবিটি। পরিচালক ছিলেন বেদান্তম রাঘোবৈঁয়া। তিন চরিত্রে ছিলেন আক্কিনেনি নাগেশ্বর রাও, সাবিত্রী ও ললিতা। ছবিটির নাম ছিল ‘দেবদাসু’। ১৯৫৫ সালে বলিউডের বাঙালি পরিচালক বিমল রায় আবার হিন্দিতে ‘দেবদাস’ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। দেবদাস চরিত্রে অভিনয় করেন দিলিপ কুমার। তিনি চেয়েছিলেন পারুর ভূমিকায় মীনা কুমারী এবং চন্দ্রমুখীর চরিত্রে নার্গিস অভিনয় করুন। মীনা কুমারী রাজি ছিলেন। কিন্তু তার স্বামী কামাল আমরোহি এমন কিছু শর্ত আরোপ করেন যা বিমল রায় মেনে নিতে পারেননি। নার্গিস চন্দ্রমুখীর ভূমিকা নিতে রাজি হননি। কারণ তার কাছে মনে হয়েছিল এটি দ্বিতীয় নায়িকার ভূমিকা। সুরাইয়াও সে কারণে চরিত্রটি প্রত্যাখ্যান করেন। তাই বিমল রায় উঠতি নায়িকা নৃত্যপটিয়সী বৈজয়ন্তি মালাকে প্রস্তাব নেন। সানন্দে সে প্রস্তাব গ্রহণ করে চন্দ্রমুখী হন তিনি। তখন বিমল রায়ের মনে হয় বাঙালি নারী পারুর ভূমিকায় একজন বাঙালিকেই নিতে হবে। সেসময় সুচিত্রা সেনের চেয়ে সুন্দরী নায়িকা আর কেউ নেই। তাকে পারুর ভূমিকায় নেন বিমল রায়।

ছবিটিতে বাংলার গ্রাম ও জনপদ, কলকাতা শহরকে দেখানো হয়। দিলিপ কুমারও বাঙালি তরুণের ভূমিকাতে দারুণ অভিনয় করেন। তার ‘বেইজ ভয়েসে’ উচ্চারিত সংলাপ ভীষণ জনপ্রিয়তা পায়। তিনি কিছু কিছু বাংলা শব্দও সংলাপে বলেন। সুচিত্রা সেন তার সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বে পারুরূপে জয় করেন হিন্দিভাষী দর্শকদের। ‘দেবদাস’  হিন্দিভাষায় নির্মিত সেরা কাহিনিচিত্র হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করে।  ফিল্ম ফেয়ার আসরে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান দিলিপ কুমার। চুণীলালের ভূমিকায় মোতিলাল পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান। পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান বৈজয়ন্তিমালা। কিন্তু তিনি পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তার মনে হয়েছিল চন্দ্রমুখী মোটেই পার্শ্ব-চরিত্র নয় বরং সুচিত্রা সেনের মতোই এ ছবির আরেক প্রধান নায়িকা ছিলেন তিনি।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তানে উর্দু ভাষায় নির্মিত হয় ‘দেবদাস’।পরিচালক ছিলেন খাজা সারফারাজ। তিনটি প্রধান ভূমিকায় ছিলেন হাবিব তালিশ, শামীম আরা ও নায়ার সুলতানা। সে সময় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। অথচ প্রেমের এমন মহিমা যে ভারতীয় কাহিনি গ্রহণ করতে পাকিস্তানের দর্শকের কোনো সমস্যা হয়নি।

 ১৯৭৪ সালে তেলেগু ভাষায় ‘দেবদাসু’ নির্মিত হয় বিজয়া নির্মলার পরিচালনায়। অভিনয় করেন ঘাট্টামানেনি কৃষ্ণা, বিজয়া নির্মলা (পারু) এবং জয়ন্তি। ১৯৭৯ সালে কলকাতায় দিলিপ রায়ের পরিচালনায় নির্মিত হয় দেবদাস। অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় এবং সুপ্রিয়া দেবী। এ ছবিতে চুণীলাল হয়েছিলেন উত্তম কুমার। এ ছবিতে চুণীলালের লিপসিংয়ে খুব লাগসইভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল ‘শাওন রাতে যদি’ গানটি।

১৯৮২ সালে বাংলাদেশে চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় নির্মিত হয় ‘দেবদাস’। এ ছবিতে নাম ভূমিকায় ছিলেন বুলবুল আহমেদ, পারু ছিলেন কবরী সারোয়ার এবং চন্দ্রমুখী ছিলেন আনোয়ারা। চুণীলালের ভূমিকায় ছিলেন রহমান। এ ছবিটিকে বলা যায় মূল উপন্যাসের সবচেয়ে বিশ্বস্ত চিত্রায়ণ। বাংলাদেশে দুর্দান্ত বাণিজ্যিক সাফল্য পায় ছবিটি। পরবর্তীতে অসংখ্যবার যাত্রায় দেবদাস হন বুলবুল আহমেদ।

১৯৮৯ সালে মালায়াম ভাষায় নির্মিত দেবদাস পরিচালনা করেন ক্রসবেল্ট মানি। অভিনয় করেন বেনু নাগাবল্লী , পার্বতী এবং রামাইয়া কৃষ্ণা। ২০০২ সালে বলিউডে বেশ শোরগোল তুলে নির্মিত হয় ‘দেবদাস'। পরিচালক সাঞ্জায় লিলা বানসালির দারুণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী উদ্যোগ ছিল এটি। মূল কাহিনির অনেক কিছু বদলে দেয়া হয় এ ছবিতে।কলকাতার পরিবর্তে কিশোর দেবদাসকে লন্ডনে পাঠানো হয় পড়তে। উপন্যাসের ‘বেচাকেনা ঘরের মেয়ে’ পার্বতী হয়ে যায় নর্তকীর কন্যা। এ ছবিতে দেবদাস ছিলেন শাহরুখ খান, পার্বতী ঐশ্বরিয়া রাই , চন্দ্রমুখী মাধুরী দিক্ষিত এবং চুণীলাল হন জ্যাকি শ্রফ। ব্যয়বহুল এই ছবিটি সেট নির্মাণ, পোশাক পরিকল্পনা এবং অন্যান্য কারণে মুক্তির আগেই দর্শক মহলে বিপুল আগ্রহ সৃষ্টি করে। সুপার-ডুপার হিট হয় ছবিটি। শাস্ত্রীয় সংগীতের দুর্দান্ত ব্যবহার ও মাধুরীর নৃত্যকুশলতা এ ছবির অন্যতম প্রধান সম্পদ। ছবিটি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আসরে পাঁচটি এবং ফিল্মফেয়ারে দশটি পুরস্কার জয় করে। এর মধ্যে সেরা ছবি, সেরা পরিচালনা, সেরা অভিনেতা ও সেরা অভিনেত্রী রয়েছে। পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার ঘরে তোলেন মাধুরী। ছবিটি কানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসা কুড়ায় এবং প্রথম ভারতীয় ছবি হিসেবে অস্কারে অংশ নেয়। ছবিটি ভারত ও ভারতের বাইরে ব্লক বাস্টার হিট হয়।

ওই একই বছর হিন্দি ছবিটির আগে মুক্তি পায় কলকাতায় নির্মিত বাংলা ছবি ‘দেবদাস’। শক্তি সামন্ত পরিচালিত ছবিটিতে অভিনয় করেন প্রসেনজিৎ, অর্পিতা পাল এবং ইন্দ্রাণী হালদার। এখানে চুণীলালের ভূমিকায় ছিলেন তাপস পাল।

২০০৯ সালে বলিউডে অনুরাগ কাশ্যপ পরিচালিত ‘দেভ ডি’ মুক্তি পায়। দেবদাসের কাহিনিকে বর্তমান কালের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করা হয়। এতে অভিনয় করেন অভয় দেওল, মাহি গিল ও কালকি কোয়েচলিন। ব্ল্যাক কমেডি ড্রামা ঘরানার এ ছবিটিও ব্যবসাসফল হয়।

২০১০ সালে পাকিস্তানে ‘দেবদাস’ নির্মিত হয়। ইকবাল কাশ্মিরি পরিচালিত ছবিটিতে অভিনয় করেন নাদিম শাহ, জারা শেখ এবং মীরা।

২০১৩ সালে বাংলাদেশে চাষী নজরুল ইসলাম নতুনভাবে ‘দেবদাস’ নির্মাণ করেন। দেবদাসের ভূমিকায় শাকিব খান, পার্বতীরূপে অপু বিশ্বাস এবং  মৌসুমী চন্দ্রমুখী হন।শহীদুজ্জামান সেলিম হন চুণীলাল। এ ছবিটি বক্স-অফিসে দারুণ সফল হয়। তিনজনের অভিনয়ই সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়।

শরৎচন্দ্রের পর যুগ পাল্টে গেছে। কিন্তু দেবদাসের ভালোবাসা, অভিমান ও আবেগের আবেদন চিরকালীন। তাই হয়তো আগামীতেও এ কাহিনির ভিত্তিতে ছবি নির্মিত হলে সেটিও সমাদৃত হবে দর্শক মহলে।