মিঠুন-শ্রীদেবীর প্রেম: বিচ্ছেদই ছিল যার ভাগ্য 

সন্ধ্যা নামে এক ব্রাহ্মণকুমারী প্রেমে পড়ে হরি নামের এক দলিত যুবকের। হরি ও সন্ধ্যার প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সমাজ ও বর্ণভেদ প্রথা। সন্ধ্যার বিয়ে হয়ে যায় নান্দু নামের এক পুরোহিতের সঙ্গে। সমাজের চোখে স্বামী হলেও নান্দু চায় সন্ধ্যা তার প্রকৃত প্রেমিক হরিকে গ্রহণ করুক। কারণ নান্দু বিশ্বাস করে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। সমাজের বিরোধিতার মুখে শেষ পর্যন্ত একসঙ্গে মৃত্যুবরণ করে হরি ও সন্ধ্যা আর মৃত্যুতে অমরত্ব পায় তাদের প্রেম।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Jan 2016, 08:42 AM
Updated : 8 Jan 2016, 09:36 AM

অসাধারণ এক কাহিনি। সংলাপ, নির্দেশনা, অভিনয়ও ছিল অসাধারণ। সমালোচকদের প্রশংসা তো বটেই, বিপুল বাণিজ্যিক সাফল্যও পেয়েছিল ছবিটি। রাকেশ রোশান পরিচালিত ১৯৮৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জাগ উঠা ইনসান’ নামের এই ছবির সেটেই সূচনা হয় আরেক প্রেম কাহিনির। ছবির কাহিনির তুলনায় সে প্রেম কাহিনিও কম অভিনব নয়।

‘জাগ উঠা ইনসান’ ছবিতে প্রধান তিনটি ভূমিকায় ছিলেন শ্রীদেবী(সন্ধ্যা), মিঠুন চক্রবর্তি(হরি) এবং রাকেশ রোশান(নান্দু)। আর এ ছবিতে অভিনয়ের সময় দক্ষিণী সুন্দরী শ্রীদেবীর প্রেমে পড়েন বাঙালি যুবক মিঠুন।

শ্রীদেবী-মিঠুন প্রেম কাহিনি বলিউডের অন্যতম সাড়া জাগানো রোমান্স উপাখ্যান। আশির দশকে ফিল্মি ম্যাগাজিনগুলো সরগরম ছিল এই গুঞ্জনে।

তামিল নাড়ুর আয়াংগার পরিবারের মেয়ে শ্রীদেবীর জন্ম ১৯৬৩ সালের ১৩ অগাস্ট। তামিল, মালায়াম ও তেলেগু ছবিতে অভিনয় শুরু করেন শিশু বয়সেই। তিনি হিন্দি ছবিতে পা রাখেন ১৯৭৫ সালের ‍সুপার হিট সিনেমা ‘জুলি’তে পার্শ্ব-চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। নায়িকা হিসেবে যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সদমা’ ছবির মাধ্যমে। সে বছরই ‘হিম্মতওয়ালা’, ‘জাস্টিস চৌধুরি’, ‘মাওয়ালি’, ‘কলাকার’- এর মতো সুপার-ডুপার হিট ছবির নায়িকা হওয়ার সুবাদে বলিউডের হার্টথ্রব হয়ে ওঠেন তিনি।

মিঠুন চক্রবর্তির জন্ম ১৯৫০ সালের ১৬ জুন কলকাতায়। বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া এক ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে তিনি। স্কটিশের মেধাবী ছাত্র গৌরাঙ্গ ওরফে মিঠুন নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে চলে যান মুম্বাইয়ে। ১৯৭৬ সালে শিল্পধারার ছবি  ‘মৃগয়া’র মাধ্যমে পা রাখেন চলচ্চিত্রভুবনে। এরপর বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। ১৯৮২ সালে মুক্তি পাওয়া ব্লকবাস্টার হিট ছবি ‘ডিসকো ডান্সার’ মিঠুনকে মহাতারকা বানিয়ে দেয়। আশির দশকে বলিউডের অন্যতম প্রধান নায়ক ছিলেন মিঠুন চক্রবর্তি। বিশেষত সামাজিক-অ্যাকশন ছবিতে তিনি ছিলেন দারুণ জনপ্রিয়। ‘জাগ উঠা ইনসান’ ছবির সেটেই মিঠুন-শ্রীদেবী প্রেমকাহিনি শুরু হয়|। কিন্তু মিঠুন তখন ছিলেন বিবাহিত। ১৯৭৯ সালে তিনি বিয়ে করেন অভিনেত্রী যোগিতাবালিকে, যিনি ছিলেন মিঠুনের চেয়ে বয়সে বড় ও সে সময়ে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। যোগিতাবালির প্রথম স্বামী ছিলেন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী কিশোর কুমার। কিশোর ও যোগিতার বিয়ে তিন বছর টিকেছিল।

মিঠুনের মুম্বাই জীবনের প্রথম দিকে যোগিতাবালি তাকে চলচ্চিত্রভুবনে পরিচিতি পেতে সহায়তা করেন। ফলে মিঠুনের অশেষ কৃতজ্ঞতা ছিল যোগিতাবালির প্রতি।

১৯৮৪ সালে শ্রীদেবীর সঙ্গে যখন মিঠুনের প্রেম জমে ওঠে তখন তার এই দাম্পত্য দুজনের মধ্যে পাহাড়সম বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ‘জাগ উঠা ইনসান’-এর পর শ্রীদেবী-মিঠুন জুটির ‘ওয়াতান কি রাখোয়ালে’ মুক্তি পায় ১৯৮৭ সালে। সেসময় দুজনের প্রেম চললেও দৃশ্যপটে বনি কাপুরের আবির্ভাব ততদিনে ঘটে গেছে। ১৯৮৪ সালেই ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ ছবিতে প্রযোজক বনি কাপুরের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে শ্রীদেবীর। অসামান্যা সুন্দরী ও দুর্দান্ত অভিনেত্রী শ্রীদেবীর প্রতি আকৃষ্ট হন বিবাহিত বনি কাপুর। কিন্তু মিঠুনের প্রেমে মগ্ন থাকায় বনি কাপুরের আহ্বানে তখন সাড়া দেননি শ্রীদেবী। যদিও বনি কাপুরের প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে অনিল কাপুরের বিপরীতে তার ছবি মুক্তি পেতে থাকে এবং অনিল-শ্রীদেবী জুটি দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।

বনি কাপুর নানাভাবে শ্রীদেবীর মন যোগাতে ব্যস্ত হন। কিন্তু শ্রীদেবী মিঠুনের সঙ্গেই সম্পর্ক ধরে রাখেন। সেসময় বনির প্রতি ঈর্ষা দেখা দেয় মিঠুনের মনে। তাকে শান্ত করতে বনিকে ‘ভাইযের মতো’ বলে প্রচার করেন শ্রী। তিনি বনির হাতে রাখিও পরিয়ে দেন। এই রাখি পরানোর ঘটনাটি বনির প্রথম স্ত্রী মোনা কাপুরও এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন। তারপরও শেষরক্ষা হয়নি।

শ্রীদেবী চেয়েছিলেন মিঠুন তার স্ত্রীকে ত্যাগ করে তাকে বিয়ে করুক|। কিন্তু এক পর্যায়ে তিনি বুঝতে পারেন শ্রীদেবীকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসলেও যোগিতাবালিকে আঘাত করা সম্ভব নয় মিঠুনের পক্ষে। কারণ যোগিতা তার সন্তানের মা এবং দুঃসময়ের সহযাত্রী।

এই অভিমান থেকেই জন্ম নেয় বিরোধ। আশির দশকের শেষে মিঠুন-শ্রীদেবীর প্রেমে ভাঙনের সুর বাজে। এই জুটি চারটি ছবিতে কাজ করেছিলেন। ‘জাগ উঠা ইনসান’, ‘ওয়াতান কি রাখোওয়ালে’, ‘ওয়াক্ত কি আওয়াজ’ এবং ‘গুরু’| ‘গুরু’ মুক্তি পায় ১৯৮৯ সালে। চারটি ছবিই বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছিল।

মিঠুনের সঙ্গে প্রেমের বিষয়ে মিডিয়ার সামনে বরাবরই নীরবতা অবলম্বন করেছেন শ্রীদেবী। তবে মিঠুন নব্বইয়ের দশকে একবার পশ্চিমবঙ্গের একটি ফিল্মি ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তাদের প্রেম সম্পর্কে আভাস দিয়েছিলেন। নাম প্রকাশ না করে মিঠুন বলেন তিনি এক সুন্দরী নারীকে অনেক ভালোবাসতেন। তারা দুজনে বিয়েও করেন। কিন্তু তাদের বিয়ের স্থায়ীত্ব ছিল মাত্র একদিন। বিয়ের একদিন পরে তিনি ডিভোর্সের চিঠি পান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্রচণ্ড মানসিক চাপ ও ভুল করছে এই আশংকা থেকে মেয়েটি তাকে ত্যাগ করেছিল। মিঠুন সেই প্রেমিকার প্রতি কোনো অভিযোগ করেননি কখনও। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাদের বিচ্ছেদ ছিল অনিবার্য। মিঠুনের এই সাক্ষাৎকার থেকে অনেকেই ধারণা করেন যে তার সেই প্রেমিকা শ্রীদেবী ছাড়া আর কেউ নন।

মিঠুন-শ্রীদেবীর সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পিছনে একদিকে যেমন রয়েছে শ্রীর প্রতি বনি কাপুরের আগ্রহ অন্যদিকে রয়েছে যোগিতাবালির হস্তক্ষেপ। সংসার বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন যোগিতাবালি। তিনি এমনকি আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন। এই চেষ্টার পরই শ্রীদেবীর সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে বাধ্য স্বামীর মতো ঘরে ফেরেন মিঠুন। আর বনি কাপুরকে নিয়ে নিজস্ব সংসার গড়ার স্বপ্নে মেতে ওঠেন শ্রীদেবী।

শ্রীদেবী-মিঠুন জুটির পর্দা রোমান্স সবচেয়ে জমজমাট ছিল ‘গুরু’ ছবিতে। আর এ ছবি মুক্তি পাওয়ার আগেই দুজনার পথ আলাদা হয়ে যায়। ‘গুরু’ ছবির একটি জনপ্রিয় গান ছিল ‘যাইও না যাইও না হামসে দূর কাভি যাইও না’। কিন্তু জীবনের কাহিনিতে পরস্পরের কাছ থেকে দূরেই চলে যান তারা।