সেই শ্যামলবরণ মেয়েটি

‘শ্যামলবরণ মেয়েটি, ডাগর কালো আঁখিটি, না,না, তার নাম বলবো না’-'কাঁচের দেয়াল' ছবির এই গানটি সুমিতা দেবীকে যথার্থভাবেই ধারণ করেছে।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Jan 2016, 06:44 AM
Updated : 6 Jan 2016, 06:44 AM

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সোনালি-যুগের অভিনেত্রী সুমিতা দেবী ছিলেন চিরন্তন বাঙালি নারীর প্রতীক। প্রেয়সী, জননী, বড়বোন, ভাতৃবধূ-সব রূপেই তিনি ছিলেন অনন্যা। পর্দায় তার অভিনীত চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি খুব সার্থকভাবে ধারণ করতে পারতেন বাঙালি নারীর অনুভবের ভুবন। ইতিবাচক-নেতিবাচক সব ধরনের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে ছিলেন পারদর্শী।

সুমিতা দেবীর জন্ম ১৯৩৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জ জেলার এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে। তার নাম ছিল হেনা ভট্টাচার্য। ১৯৪৪ সালে পরিবারের সঙ্গে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। পুরানো ঢাকার বাংলাবাজার স্কুলে ভর্তি হন তিনি। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন উত্তাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। সারাদেশে দুর্ভিক্ষ। ১৯৪৫-এ যুদ্ধ থামতে না থামতেই হলো দেশভাগ। ১৯৫০ সালে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে ঢাকা ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে তাকে চলে যেতে হয় কলকাতায়। উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নেন বর্ধমানে। কিন্তু পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমানো মানুষদের জীবন ছিল প্রচণ্ড সংগ্রামের। বর্ধমান থেকে ভট্টাচার্য পরিবার আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। সেখানে হেনার বিয়ে হয়ে যায় অমূল্য লাহিড়ি নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। কিন্তু তাদের মধ্যে বোঝাপড়া না হওয়ায় বিচ্ছেদ ঘটে।

১৯৫৭ সালে হেনা ফিরে আসেন ঢাকায়। সেখানে তার সুযোগ ঘটে চলচ্চিত্রে প্রবেশের। বাংলা চলচ্চিত্রে তখন ‘সু’কন্যাদের যুগ চলছে। রমা দেবীর সুচিত্রা, বেণু চৌধুরীর সুপ্রিয়া হয়ে ওঠার মতো হেনাও হয়ে গেলেন সুমিতা। নামটি দেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ফতেহ লোহানী। তার ছবিতেই প্রথম সুযোগ পেলেন সুমিতা দেবী।ফতেহ লোহানী পরিচালিত ‘আসিয়া’ এবং ‘আকাশ আর মাটি’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে শুরু হয় রূপালি ভুবনে তার যাত্রা।

‘আসিয়া’ ছবিতে নাম ভূমিকায় ছিলেন সুমিতা দেবী। তার বিপরীতে নায়ক ছিলেন শহীদ। বিয়োগান্তক কাহিনি। প্রেমিকের চাচার সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় গ্রাম বাংলার এক অসহায় তরুণীর। বিষয়টি মর্মান্তিক হয়ে ওঠে তাদের জীবনে। শেষ পর্যন্ত একসঙ্গে মৃত্যুকে বরণ করে তারা। এই করুণ প্রেমকাহিনি সুমিতা দেবীকে এনে দেয় অপার সাফল্য। ১৯৬০ সালের ২৪ নভেম্বর মুক্তি পায় ছবিটি। সেরা বাংলা চলচ্চিত্র হিসেবে জয় করে প্রেসিডেন্ট পদক। বাণিজ্যিক সাফল্যও পায় প্রচুর। ছবির নায়িকা সুমিতা দেবী রাতারাতি হয়ে যান তারকা। ‘আসিয়া’র মাধ্যমে চলচ্চিত্রে প্রথম সুযোগ ঘটলেও এটি তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি নয়। ‘আসিয়া’তে কাজ করতে করতেই অন্য তিনটি চলচ্চিত্রে সুযোগ পেয়ে যান। ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি মুক্তি পায় এহতেশাম পরিচালিত ‘এ দেশ তোমার আমার’ এবং ২৪ জুলাই মুক্তি পায় ফতেহ লোহানী পরিচালিত ‘আকাশ আর মাটি’। ১৯৫৯ সালেই মুক্তি পায় তার অভিনীত ‘মাটির পাহাড়’। তিনটি ছবিই বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছিল। প্রথমটিতে নায়ক ছিলেন আনিস, দ্বিতীয়টিতে আমিন ও প্রবীর কুমার।

এরপর তিনি জহির রায়হান পরিচালিত ‘কখনো আসেনি’ ছবিতে অভিনয় করেন। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬১ সালে। এ ছবিতে তার বিপরীতে নায়ক ছিলেন আনিস। এ ছবিতে কাজ করার সময় জহির রায়হান এবং সুমিতা পরষ্পরের প্রেমে পড়েন। ১৯৬১ সালে বিয়ে করেন তারা। ধর্মান্তরিত হয়ে নিলুফার বেগম নাম হয় তার। যদিও তার পর্দা-নাম সুমিতা দেবীই বহাল থাকে। এ দম্পতির দুই ছেলে অনল রায়হান এবং বিপুল রায়হান। দুজনেই চলচ্চিত্র জগতের মানুষ।

সুমিতা দেবী ষাটের দশকে এ‌কের পর এক ছবিতে নায়িকা হন। ‘সোনার কাজল’, ‘কাঁচের দেয়াল’, দুই দিগন্ত’, এই তো জীবন’, অশান্ত প্রেম’ ইত্যাদি ছবিতে প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। প্রতিটিই বাণিজ্যিক সাফল্য এবং সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়। ‘কাঁচের দেয়াল’ ছবিতে আনোয়ার হোসেনের বিপরীতে তার অভিনয় দারুণ প্রশংসিত হয়। এ ছবিতেই খান আতার কণ্ঠে শোনা যায় ‘শ্যামলা বরণ মেয়েটি’। ছবিতে সংলাপের মাধ্যমে যতটা নয়, তার চেয়েও ডাগর কালো আঁখির মাধ্যমেই আবেগ ও ভালোবাসা ফুটিয়ে তোলেন সুমিতা দেবী। ছবিটি পাকিস্তানের নিগার পুরস্কার পেয়েছিল।

সুমিতা দেবী উর্দু ছবি ‘সঙ্গম’ এবং ‘ধুপ ছাও’তে অভিনয় করেন।  প্রথমটিতে তার বিপরীতে নায়ক ছিলেন খলিল দ্বিতীয়টিতে পশ্চিম পাকিস্তানের অভিনেতা এজাজ। ‘সঙ্গম’ এর পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান।

ষাটের দশকের শেষ দিকে সুমিতা দেবী চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে কাজ করতে থাকেন এবং বিপুল সাফল্য পান| ‘বেহুলা’, ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘অভিশাপ’সহ বিভিন্ন ছবিতে অভিনয় করেন তিনি।

জহির রায়হান অভিনেত্রী সুচন্দাকে বিয়ে করলে সন্তানদের নিয়ে পৃথকভাবে বসবাস করতে থাকেন সুমিতা দেবী।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বহুকষ্টে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সন্তানদের নিয়ে কলকাতায় পৌঁছান তিনি। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন সক্রিয় শব্দসৈনিক হয়ে ওঠেন। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে তার অবদান ছিল ব্যাপক।

জহির রায়হান শহীদ হওয়ার পর ঢাকায় সন্তানদের নিয়ে সুমিতা দেবীকে যথেষ্ট সংগ্রাম করতে হয়েছিল।অবশ্য চলচ্চিত্রজগতে তিনি ছিলেন ব্যস্ত শিল্পী।

‘ওরা এগারো জন’, ‘সুজন সখী’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘আমার জন্মভূমি’, ‘চিত্রা নদীর পারে’সহ অসংখ্য ছবিতে তিনি অভিনয় করেন। কমেডি অভিনয়েও তিনি ছিলেন দারুণ সফল। ‘নাতবউ’ ছবিতে একটি মাত্র দৃশ্যে দুর্দান্ত অভিনয় করে বুঝিয়ে দেন তিনি জাত-শিল্পী।

সুমিতা দেবী পাঁচটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন। তার পরিচালিত ছবিগুলো হলো ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘মোমের আলো’, ‘মায়ার সংসার’, ‘আদর্শ ছাপাখানা’ এবং ‘নতুন প্রভাত’। তার অভিনীত সর্বশেষ ছবি ‘ফুলকুমার’। তিনি চলচ্চিত্রের পাশাপাশি অসংখ্য টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন। মঞ্চেও তিনি ছিলেন সফল।

২০০৪ সালের ৬ জানুয়ারি সুমিতা দেবী মৃত্যুবরণ করেন। অসামান্য প্রতিভার অধিকারী এই শিল্পী বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-দর্শকের স্মৃতিতে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।