সোহেল চৌধুরী: অকালে নিভে যাওয়া তারা

১৯৮৫ সাল। জাফলং ও শ্রীমঙ্গলের অসাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশ। ‘হীরামতি’ ছবির শুটিং চলছে। পাঞ্জাবের বিখ্যাত লোককাহিনি ‘হীররান্ঝা’। ‘হীররান্ঝা’র কাহিনি নিয়ে বাংলায় নির্মিত হচ্ছে চলচ্চিত্র ‘হীরামতি’। বিয়োগান্তক এক প্রেমকাহিনি। এই প্রেমকাহিনিতে অভিনয় করছেন সোহেল চৌধুরী ও দিতি। এক প্রেমকাহিনি যে আরেক প্রেমকাহিনির জন্ম দেবে তা কে জানতো!

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Dec 2015, 04:44 AM
Updated : 19 Dec 2015, 04:44 AM

সোহেল ও দিতি দুজনই তখন তরুণ ও অবিবাহিত। দিতির বিয়ে পারিবারিকভাবে ঠিক হয়ে ছিল। এই ছবির কাজ শেষ করে ঢাকায় ফিরেই বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথা। সেজন্য সফল নায়িকা হওয়া সত্ত্বেও আর কোনো নতুন ছবির কাজ হাতে নিচ্ছিলেন না তিনি। শুধু বিখ্যাত পরিচালক আমজাদ হোসেনের অনুরোধ ফেলতে পারেননি বলে ‘হীরামতি’ ছবির কাজ করতে রাজি হন। এই ছবিটিই উল্টে দিল পাশার ছক। সোহেল ও দিতি প্রেমে পড়লেন। দিতির বিয়ের তখন মাত্র দিন দশেক বাকি। এরই মধ্যে ঢাকায় ফিরে পালিয়ে সোহেল চৌধুরীর বনানীর বাড়িতে গেলেন তারা। কাজী ডেকে বিয়ে করলেন।

তবে এই প্রেমকাহিনির পরিণতিও ছিল বিয়োগান্তক।

সোহেল চৌধুরীর জন্ম ১৯৬৩ সালে। তার বাবার নাম তারেক আহমেদ চৌধুরী। মা নূরজাহান বেগম। সোহেল চৌধুরী অভিজাত ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন। তিনি গিটার বাজাতে ও গান গাইতে ভালোবাসতেন।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে প্রথমবারের মতো ১৯৮৪ সালে 'নতুন মুখের সন্ধানে নামে' একটি মেধা অনুসন্ধানমূলক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। চলচ্চিত্রে নতুন শিল্পীদের আগমন সহজ করার জন্য এই প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়। ১৯৮৪ সালে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে চলচ্চিত্রজগতে আসেন সোহেল চৌধুরী ও পারভীন সুলতানা দিতি। নারায়ণগঞ্জের সোনার গাঁওয়ের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে দিতি। এক সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ও বিজয়ী হওয়ার ফলে দুজনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

‘নতুন মুখের সন্ধানে’ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ায় সিনেমায় অভিনয়ের আগেই সোহেল চৌধুরী গণমাধ্যমে বেশ প্রচার পান। সুদর্শন চেহারার কল্যাণে রীতিমতো উঠতি তারকা বলে ধরা হয় তাকে।

এর মধ্যে প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক এফ কবীর চৌধুরী সোহেল চৌধুরীকে নায়ক এবং দিতিকে নায়িকা করে ‘পর্বত’ নামে একটি ছবি নির্মাণ করেন। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর মোটামুটি ব্যবসা করে এবং দুজনের অভিনয়ই প্রশংসিত হয়। সে সময় দুজনেই তারকা খ্যাতি পান। তাদের বন্ধুত্বের গুঞ্জনও শোনা যায়।

১৯৮৬ সালে আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘হীরামতি’ মাঝারি ব্যবসা করে। সিনেমায় সোহেল-দিতির পর্দা রোমান্স ও বাস্তব জীবনে তাদের বিয়ে দর্শককে এ জুটির প্রতি বেশ আগ্রহী করে। তাদের অভিনয়ও প্রশংসিত হয়। সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে ও জাফলংয়ে চিত্রায়িত ছবিটির প্রাকৃতিক দৃশ্যের চিত্রায়ন এবং রোমান্টিক দৃশ্যগুলো জনপ্রিয়তা পায়। এ ছবির ‘যোগী ভিক্ষা লয় না’সহ অন্যান্য গানও বেশ শ্রোতাপ্রিয় হয়।

‘হীরামতি’র পর এ জুটির পর পর কয়েকটি ছবি মুক্তি পায়। সোহেল-দিতি অভিনীত ‘চিরদিনের সাথী’ ছবিটিও মোটামুটি ব্যবসা সফল হয়| এ ছবির ‘তুমি আমার, আমি তোমার, চিরদিনের সাথী’ গানটি জনপ্রিয়তা পায়। 

সুদর্শন সোহেল চৌধুরী মূলত রোমান্টিক নায়ক হিসেবে খ্যাতি পান। তার চুলের স্টাইল সে সময়ের তরুণদের মধ্যে কিছুটা জনপ্রিয়তাও পায়। আশির দশকের শেষে তার পোশাকের স্টাইল ও গ্ল্যামার সে সময়ের দর্শককে আকৃষ্ট করতো।

১৯৮৭ সালে জন্ম হয় দিতি-সোহেল দম্পতির প্রথম সন্তান লামিয়া চৌধুরীর। ১৯৮৯ সালে এ দম্পতির ছেলে দীপ্ত চৌধুরীর জন্ম হয়। সুন্দরী, সুঅভিনেত্রী ও সংযত আচরণের অধিকারী দিতির ক্যারিয়ার তরতর করে এগিয়ে গেলেও সোহেল চৌধুরীর ক্যারিয়ার খুব একটা সফল হয়নি। তিনি সুদর্শন ছিলেন তবে তার অভিনয় ছিল মাঝারি মানের। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো সোহেল চৌধুরী ছিলেন খামখেয়ালী প্রকৃতির। কিছুটা রগচটা ও বদমেজাজিও ছিলেন। সঠিক সময়ে শুটিং ফ্লোরে প্রায়ই হাজির হতে পারতেন না, বিশেষ করে ভোরের শিফটে| পরিচালকদের সঙ্গেও তিনি খুব সংযত আচরণ করতেন না বলে সে সময়ের সিনে পত্রিকাগুলোর সূত্রে জানা যায়। এমনকি তার ‘হীরামতি’ ছবির পরিচালক ও সুহৃদ আমজাদ হোসেনের সঙ্গেও তার সম্পর্কে ভাটা পড়ে বলে সে সময়ের জনপ্রিয় কয়েকটি সিনে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়। আনন্দবিচিত্রাসহ কয়েকটি পত্রিকায় আমজাদ হোসেন ও সোহেল চৌধুরীর বাদানুবাদের বিস্তারিত খবর প্রকাশিত হয়। মূলত অসংযত আচরণের কারণেই তার ক্যারিয়ার সফল হয়নি।

নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে দিতি ও সোহেল চৌধুরীর বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর সোহেল চৌধুরী কয়েকটি ছবিতে পার্শ্ব-চরিত্রে অভিনয় করেন। কয়েকটি ছবিতে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় নায়ক। 

১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবের সামনে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন সোহেল চৌধুরী। বিতর্কিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে বাদানুবাদই এ হত্যার নেপথ্য কারণ বলে মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।

রূপালী জগতে সব তারকাই স্থায়ী হয় না। অনেক তারাই নিভে যায় স্বল্প দ্যূতি ছড়িয়ে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আকাশে সোহেল চৌধুরী ছিলেন তেমনি এক দ্রুত নিভে যাওয়া তারা।