'শ্রাবণ মেঘের দিন': দর্শককে হলে ফেরানোর সিনেমা

একটি চলচ্চিত্র সৃষ্টি করতে পারে নতুন একটি ধারা, জন্ম দিতে পারে একজন তারকার, বদলে দিতে পারে দর্শকের রুচি। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ তেমনই একটি চলচ্চিত্র। ১৩ নভেম্বর  নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিবসে দর্শকদের মনে করিয়ে দিচ্ছি তাঁর ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটির কথা, যেটি ধ্রুপদী হয়ে উঠেছে নানা কারণে।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Nov 2015, 05:23 AM
Updated : 13 Nov 2015, 05:23 AM

বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক যখন পরিচালনায় এলেন, তখন মোড় ফিরিয়ে দিলেন ঢাকাই সিনেমারও।

তার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ - বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন ভাবনা, নতুন মাত্রা যোগ করেছিল।

২০০০ সালে মুক্তি পায় ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। ছবিটি সাতটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।

এর কাহিনি ছিল সে সময়ের গতানুগতিক ধারার বাণিজ্যিক ছবির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।

ছবির কাহিনি গড়ে ওঠে মতি নামের গ্রামীণ একজন গায়ক এবং কুসুম নামে এক খেয়ালি তরুণীকে ঘিরে। কুসুমের বাবা একজন গায়ক। তার শিষ্য মতি মিয়ার (জাহিদ হাসান) গায়ক হিসেবে নামডাক রয়েছে। মতিকে মনে মনে ভালোবাসে কুসুম (মেহের আফরোজ শাওন)। কিন্তু মতি সে বিষয়ে উদাসীন। গানই তার ধ্যান-জ্ঞান। কুসুম নিজেও ভালো গায়। সে স্বপ্ন দেখে মতিকে নিয়ে গানের দল গড়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াবে।

গ্রামের জমিদার (গোলাম মোস্তফা) সবার কাছে ঘৃণিত। কারণ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন, তার বাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল। জমিদারের ছেলেও তাই বাবাকে ঘৃণা করে এবং কখনো গ্রামে আসে না।

দাদার সঙ্গে দেখা করতে গ্রামে আসে জমিদারের দুই নাতনি। বড় নাতনি শাহানা (মুক্তি) একজন চিকিৎসক। সে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে চলে যাবে। মতির সঙ্গে আলাপ হয় শাহানার। শাহানার আন্তরিক ব্যবহারে তার প্রেমে পড়ে যায় মতি।

এদিকে কুসুমের বাবা উজান দেশ থেকে সুরুজ (মাহফুজ আহমেদ) নামে এক তরুণকে নিয়ে আসে গ্রামে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য।

সুরুজও ভালো শিল্পী। কুসুমের খেয়ালি আচরণে সুরুজের তাকে ভালো লেগে যায়।

গ্রামের এক গৃহবধূর সন্তান প্রসবে সাহায্য করে শাহানা। রক্ষা পায় সেই গৃহবধূর জীবন। শাহানার অনুরোধে গ্রামের মানুষের কাছে নিজের অতীত ভুলের জন্য ক্ষমা চান জমিদার।  জমিদার তার নাতনিদের নিয়ে শহরে পাড়ি জমায় এবং নিজের বাসভবন দান করে দেন হাসপাতাল নির্মাণের জন্য।

জমিদারের বিদায়যাত্রা দেখতে নদীর ঘাটে ভিড় করে গ্রামের সবাই। সেই অবসরে বিয়ের কনে কুসুম বিষ খায়। কারণ মতিকে ছাড়া অন্য কোনো মানুষকে সে ভালোবাসতে পারবে না। কুসুমের মা (আনোয়ারা) ডেকে আনেন মতি ও সুরুজকে। দ্রুতগামী নৌকায় কুসুমকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হয় মতি, সুরুজ ও মা। কিন্তু মাঝ পথেই মারা যায় কুসুম।

এই ছবিতে ময়মনসিংহের লোককবি ও গায়ক উকিল মুন্সীর গান ব্যবহার করেন হুমায়ূন আহমেদ। ‘সোয়াচান পাখি’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ ইত্যাদি গান দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন বারী সিদ্দিকী। মূলত এই গানগুলোর মাধ্যমে বারী সিদ্দিকীও শিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তার সোপানে পা রাখেন। হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ গানটিতে কণ্ঠ দেন সুবীর নন্দী। এই গানটিও ভীষণ জনপ্রিয় হয়। এই গানটির দৃশ্যায়নও ছিল অসাধারণ। এই গানগুলো এখনও শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে আছে।

‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে প্রতিটি প্রধান চরিত্রে অভিনয়শিল্পীরা অসাধারণ অভিনয় করেন। কুসুম চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন শাওন। এই ছবির মাধ্যমেই অভিনেত্রী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন তিনি। মতি চরিত্রে জাহিদ হাসান এবং সুরুজ চরিত্রে মাহফুজ আহমেদের অভিনয়ও ছিল চমৎকার। চলচ্চিত্রটি একদিকে যেমন দারুণ ব্যবসাসফল হয় তেমনি চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের দৃষ্টিতে শিল্পসম্মত হিসেবে বিবেচিত হয়। নুহাশ চলচ্চিত্রের ব্যানারে নির্মিত হয়েছিল সিনেমাটি। চিত্রনাট্য রচনা ও পরিচালনায় হুমায়ূন আহমেদের সৃজনশীলতার ছাপ ছিল স্পষ্ট। সংলাপে হুমায়ূন আহমেদের রচনাশৈলীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য বজায় ছিল যা একই সঙ্গে কৃত্রিমতা বর্জিত, জীবনঘনিষ্ট ও ইঙ্গিতময়। ‘গাতক’ এর মতো বেশ কিছু আঞ্চলিক শব্দ জনপ্রিয়তা পায় এ ছবির মাধ্যমেই। নৌকা বাইচ, গাতকদের গানের আসর, গায়ে হলুদের গান ইত্যাদির মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতিকে তুলে ধরেন। উকিল মুন্সীর মতো একজন লোককবিকে জাতীয় পর্যাযে তুলে ধরার বিষয়টিও ছিল প্রশংসনীয়। পরিচালক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব হলো তিনি জানতেন কিভাবে একজন অভিনেতার মধ্য থেকে সেরা কাজ বের করে আনতে হয়। সাহিত্যের মতো চলচ্চিত্রের ভাষায়ও তিনি ছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী।‘ শ্রাবণ মেঘের দিন’-এ চলচ্চিত্রের এই ভাষা হয়ে ওঠে সার্থক।

বাংলাদেশে সুস্থ রুচির বিনোদনের ধারা প্রাণ ফিরে পায় এ সিনেমাটির মাধ্যমে। মধ্যবিত্ত দর্শককে হলে ফিরিয়ে আনে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’।