ঢাকায় শুরু লোকসঙ্গীত উৎসব

বাংলা লোকসংগীতের শিল্পীদের কালজয়ী গানের পরিবেশনায় ঢাকায় শুরু হয়েছে তিন দিনের আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসব। 

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Nov 2015, 06:59 PM
Updated : 12 Nov 2015, 07:02 PM

বাংলাদেশের লোকসংগীত শিল্পী ফরিদা পারভিন, কিরণ রায়, চন্দনা মজুমদারদের পাশাপাশি গান পরিবেশন করছেন ভারতের অর্ক মুখার্জি কালেকটিভ ও পাপন অ্যান্ড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বাংলাদেশের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী মিনু হকের  নাচের স্কুল পল্লবী ড্যান্স সেন্টারের দলীয় নৃত্য পরিবেশনায় আবহমান বাংলার লোকজ ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়। তারা একে একে পরিবেশন করেন ফোক- চাকমা- সাঁওতালি নৃত্য ও ঢোলক নাচের পরিবেশনা।

এরপরই শুরু হয় উৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা। জনপ্রিয় শিল্পী তপন চৌধুরীর সঞ্চালনায় প্রথমেই মঞ্চে আসেন লালনকন্যা হিসেবে পরিচিত শিল্পী ফরিদা পারভিন। উৎসবস্থলে তখন দর্শকের আনাগোণা বাড়ছে।  সুরের জাদুতে মাতোয়ারা হতে তখন আর্মি স্টেডিয়ামে ঢল নেমেছে নানাবয়সী শ্রোতা দর্শকের।

উত্তরা থেকে আসা তরুণী সুমি ইসলাম বলেন, “আমাদের দেশের লোকজ সংগীতের এত বড় আসর, আগে কখনও হয়নি। বাবা-দাদুদের কাছে শুনেছি, লোকসংগীতের এমন সব আসরের কথা। কিন্তু আমাদের তো সেই সৌভাগ্য হয় না, সরাসরি গান উপভোগের। এবার সেই সুযোগ মিলেছে, সুযোগ কি আর হাতছাড়া করা যায়?”

মধ্যবয়সী ইকবাল হাসান বলেন, “আমাদের দেশে এমন আসর তো কেবল উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর। সে গানও আবার আমরা অনেকে বুঝতে পারি না। কিন্তু লোকসংগীত তো প্রাণের গান, দেশের গান। দেশের গানের পাশাপাশি বিদেশি শিল্পীদের পারফরম্যান্স যে আসরে, সেই আসরে না এসে কি থাকা যায়?”

শ্রোতাদের সঙ্গে কথা বলতেই বলতেই মঞ্চ থেকে ভেসে আসে  ফরিদা পারভিনের দরাজ কণ্ঠ। লালনের কালজয়ী গান ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি’ দিয়ে শুরু করেন তিনি। ‘মিলন হবে কতদিনে’, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’- তার কণ্ঠ মেলান শ্রোতারা।

গান পরিবেশনার ফাঁকে দেবেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি ও মোহাম্মদ দেলওয়ার হোসেনের তবলা এবং দোতরার ধুন যোগ করে অন্যমাত্রা।

এরপর হয় আসরের উদ্বোধনীর আনুষ্ঠানিকতা। আয়োজক প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ও সান ইভেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী বলেন, “আমরা শিকড়ের গানকে একটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম দিতে চেয়েছি।

“এবারের আসরে দেশের লোকসংগীত শিল্পীদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের শিল্পীরাও পারফর্ম করবেন এই মঞ্চে। বাংলা গানের সম্ভাবনাময় সংস্কৃতিকে আমরা এভাবেই বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে চাই।”

তারপরই তিনি মঞ্চে ডাকেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও কিংবদন্তি লোকসংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দিনের কন্যা শিল্পী ফেরদৌসী রহমানকে।

আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে ফেরদৌসী রহমান বলেন, “বাংলার লোকসংগীতকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মেলে ধরায় আমি সত্যি আপ্লুত।”

পল্লীগীতির একাল-সেকালের তুলনা করে তিনি বলেন, “বাংলা গানের শ্রোতারা এখন শেকড়ের গান ভুলে অন্যান্য গানে মন মজিয়েছে। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এ গানের আবেদন পৌঁছে দিতে সত্যি কি তেমন কোনো উদ্যোগ আছে?”

ফোক গানকে তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় করতে টেলিভিশন মালিকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, “চ্যানেলের প্রাইম টাইমে ফোক গানের অনুষ্ঠান করা যেতে পারলে সত্যিই ভালো হতো।”

প্রধান অতিথির ব্ক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, “আমাদের লোকসংগীতের সঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক সমতা ও সূক্ষ্মতা আছে, লোকগানে পরিবেশিত হয় মানবিক-মৌলিক বৃত্তিগুলো। আমাদের বাংলা ভাষার গান এত সুর-ছন্দে পরিবেশিত হয়, তা শুনতে ভীষণ সুমধুর লাগে।”

স্ত্রীর বান্ধবী ফেরদৌসী রহমানকে ‘প্রিয় শ্যালিকা’ হিসেবে উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী জানান, তরুণ বয়সে মাত্র নয় বছর বয়সী ফেরদৌসী রহমান সিলেটে গান গাইতে গিয়েছিলেন বাবা আব্বাসউদ্দিনের সঙ্গে। সেদিন ফেরদৌসীর গানে কিভাবে মজেছিলেন তিনি, সেই গল্প যখন বলছেন, দর্শক তখন হেসেই কুটিকুটি।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বিশেষ সম্মাননা জানানো হয় নৃত্যশিল্পী মিনু হক ও লালনসংগীত শিল্পী ফরিদা পারভিনকে।

উৎসব উদ্বোধনের পর মঞ্চে আসেন বাংলাদেশের আরেক জনপ্রিয় লোকগানের শিল্পী চন্দনা মজুমদার। নজরুলসংগীতে তালিম নিতে শুরু করলেও লোকগানের প্রেমে পড়ে তালিম নিতে শুরু করেন লোকগানে। পরে লোকগান গেয়েই খ্যাতি অর্জন করেন তিনি।‘মনপুরা’ চলচ্চিত্রের ‘যাও পাখি বলো তারে’ গানটি তাকে এনে দেয় জনপ্রিয়তা।

চন্দনা তার পরিবেশনা শুরু করেন লালন সাঁইয়ের গান ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ দিয়ে। মানুষ ভজনের এমন আহ্বানের পর শিল্পীর দ্বিতীয় পরিবেশনা ছিল মরমি গায়ক শাহ আব্দুল করিমের ‘তুমি বিনে আকুল পরাণ, রাধারমণ দত্তের ‘ও জলে যাইও না’ গানগুলো।

তিনি মঞ্চ থেকে নামলে পরিবেশনা শুরু করেন তার স্বামী আরেক জনপ্রিয় লোকসংগীতশিল্পী কিরণ রায়। গানের কথা, সুরে, লয়ে বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢোলকে যিনি বিশ্বজুড়ে পরিচিতি দিয়েছেন, সেই ঢোল বাদনেই শুরু হলো তার পরিবেশনা।

প্রথমেই তিনি গান বিরহের গান ‘ওরে আমার সাধক পীর আওলিয়া’। বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশ ঘুরে দেখার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে তিনি তারপর গান কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের ‘আমার মন তো বসে না’। মনের মানু্ষের বিরহে অভিমানী এই গানে পরিবেশও যেন কেমন ভারী হয়ে উঠলো।

শ্রোতাদের আবার জাগিয়ে তুলতে কিরণ রায় এবার গান রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কালজয়ী গান ‘ভালো আছি ভালো থেকো’ গানটি।

তাদের পরিবেশনার পর মঞ্চে আসে ভারতের দল অর্ক মুখার্জি কানেকটিভ। কলকাতার ছেলে  লোকগান গবেষক অর্ক মুখার্জি মঞ্চে এসেই বলেন, “যে মঞ্চে ফরিদা পারভিনের মতো কিংবদন্তী শিল্পী গেয়ে গেলেন, সে মঞ্চে গাওয়া তো আমার ধৃষ্টতা।”

তারপর তিনি বলেন, “ আমি একটি প্রভাতের গান দিয়ে শুরু করব। এখন প্রভাত তো সব নিতান্ত কালো। গানে গানে আমরা সুন্দর এক প্রভাতকেই স্বাগত জানাই চলুন।”

নিজের উদ্ভাবিত বাঁশি সদৃশ ‘কাজো’, আর তার সঙ্গে পারকাশন, দোতরার ধুনে তিনি শুরু করেন প্রভাতের গান ‘রাই জাগো গো’। গানটির চিরায়ত ঢং ঠিক রেখেই তার সঙ্গে নিজের কথা, সুর আর আফ্রিকান লোকসংগীতের সুরের মিশেলে তিনি পরিবেশন করেন দুর্দান্ত এক  ফিউশন।

গানটি শেষ করে তিনি বলেন, “ফোক বা লোক গান যাই বলুন না কেন তার মূল অর্থ তো মানুষ।” তারপর ম্যান্ডোলিন বাজিয়ে শুরু করেন ‘রসিক পাগল’।

দর্শক তাদের অর্কের সঙ্গে হয়ে ওঠে ‘রসিক পাগল’। অর্ক গাইলেন বাংলাদেশের আরেক জনপ্রিয় লোকসংগীত ‘ দুয়ারে আইসাছে পালকি’।

গানের ফাঁকে তিনি বলেন, “ঢাকার এই আসরে এসে মনে হচ্ছে আমার ড্রয়িংরুমটি যেন হঠাৎ বড় হয়ে একটি স্টেডিয়াম হয়ে গেছে।  ঢাকার দর্শক আমাকে নিয়ে এত জানে! আমি তো ভাবতে পারিনি।”

তারপর ম্যান্ডোলিন, দোতরা আর পারকাশনের ধুনে তিনি বিজয় সরকারের গান আমার এমন দিনের সঙ্গে গাইলেন ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে রে…”।

এরপর শুরু হয় তার দলীয় পরিবেশনা ‘সিডলেস গ্রিন’।

গানের আসর মাতাতে তখন প্রস্তুত লাবিক কামাল গৌরব, রব ফকির, শফি মণ্ডল, পাপন অ্যান্ড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।