'কাদম্বরী': রবি জীবনের ধ্রুবতারা যখন পর্দায়

মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে যে সঙ্গীকে হারিয়ে ছিলেন, সারা জীবন ঘুরে ফিরে তার কথাই লিখে গেছেন গানে, গল্পে, কবিতায়। তারই ছবি এঁকে গেছেন ক্যানভাসে। রবীন্দ্রনাথের জীবনে নতুন বৌঠান কাদম্বরী ছিলেন প্রেরণা, প্রেম, বিষাদ ও বিরহের দেবী।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 August 2015, 03:03 AM
Updated : 6 August 2015, 09:44 AM

রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবীর মর্মস্পর্শী প্রেমকাহিনির নিবিড় আখ্যান রূপালি পর্দায় তুলে এনে বাংলা সিনেমাকে সমৃদ্ধ করেছেন সুমন ঘোষ। বলছি ‘কাদম্বরী’ ছবিটির কথা।

টালিগঞ্জের এ ছবিটি মুক্তি পেয়েছে চলতি বছর মে মাসে। পঁচিশে বৈশাখ এবং বাইশে শ্রাবণ- রবীন্দ্রনাথের জন্ম ও প্রয়াণ দিবসের মধ্যবর্তী সময়ে বাঙালির প্রাণের কবিকে ঘিরে এই শ্রদ্ধাঞ্জলি সত্যি অভিনব।

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক অবলম্বনে আজ পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে অনেক চলচ্চিত্র, মঞ্চনাটক, টেলিফিল্ম, টিভি নাটক। তার জীবনের ঘটনা নিয়েও নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি তথ্যচিত্র। ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ মঞ্চ নাটকটি তো গড়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ ও জীবনের অন্যান্য ঘটনা অবলম্বনেই। নতুন বৌঠান কাদম্বরী ও রবীন্দ্রনাথের জীবনের কিছু ঘটনা নিয়ে ২০১৪ সালে ভারতে ‘চির সখা হে’ নামে একটি সিনেমা নির্মিত হয়েছিল। তাতে কাদম্বরীর আত্মহত্যা ও অন্যান্য ঘটনা চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল। তিনটি ভাষায় একযোগে নির্মিত হলেও ছবিটি তেমন আলোচিত হয়নি। ছবিটিতে রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরীর ভূমিকায় ছিলেন সন্দীপ ভট্টাচার্য এবং দীপাঞ্জনা।  তাদের অভিনয়ে মোটেই ধার ছিল না। রূপা গাঙ্গুলি এবং সৌমিত্র চ্যাটার্জির মতো জাঁদরেল শিল্পীর উপস্থিতি সত্বেও ছবিটি সাফল্য পায়নি শুধুমাত্র প্রধান ভূমিকায় অভিনয়শিল্পীদের দুর্বলতার কারণে।

তবে সুমন ঘোষ এ ভুল করেননি। তিনি শিল্পী বাছাই করেছেন খুবই সচেতনভাবে। ‘কাদম্বরী’তে নাম ভূমিকায় কঙ্কনা সেন শর্মা এবং রবীন্দ্রনাথের চরিত্রে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকায় রয়েছেন কৌশিক সেন।

রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন স্মৃতি’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’ এবং রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট’- মূলত এই তিনটি বইয়ের উপর ভিত্তি করেই ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন সুমন ঘোষ। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি ছোট গল্পেরও ছায়া পড়েছে এতে।

ছবি শুরু হয়েছে কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যা দিয়ে। তার পর টুকরো টুকরো ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে এগিয়েছে গল্প। ১২৭৫ বঙ্গাব্দের ২০ আষাঢ় ঠাকুরবাড়িতে বৌ হয়ে আসেন কাদম্বরী দেবী। পিতৃগৃহে তার নাম ছিল কাদম্বিনী। ঠাকুর বাড়িতে এসে নতুন নাম হলো তার। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্বামী। রূপে গুণে অতুলনীয় যুবক জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ব্যস্ত ব্যবসা, সাহিত্য চর্চা, নাটক, গান আর বন্ধুদের নিয়ে। উপরন্তু আছেন মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী, ব্যক্তিত্বময়ী সুন্দরী জ্ঞানদানন্দিনী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পরিবারে ‘নতুন’ নামে পরিচিত। সেই সুত্রে কাদম্বরী নতুন বৌঠান। রাজপ্রাসাদের মতো বিশাল ঠাকুরবাড়িতে বালিকা কাদম্বরীর একমাত্র সঙ্গী সমবয়সী বালক দেবর রবি। গরীব পরিবারের মেয়ে বলে কাদম্বরীকে নিয়ে আড়ালে আবডালে মেয়ে মহলে বিদ্রুপ চলে। তিনিও মিশতে পারেন না কারও সঙ্গে তেমন ভাবে। এদিকে মুখচোরা কিশোর মাতৃহীন রবির একমাত্র আশ্রয় নতুন বৌঠানের কাছে। ক্রমে বড় হয়ে ওঠে দুজনেই। ঠাকুরবাড়ির তিন তলার মহলে কাদম্বরী সাজিয়ে তোলেন তার ঘর। প্রশস্ত বারান্দায় চিনে মাটির টবে ফুলের বাগান। গান, গল্প, কবিতায় মোহময় হয়ে ওঠে জীবন| জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সৌখিন মানুষ। তিনি স্ত্রী ও ছোট ভাইকে নিয়ে মাঝে মাঝেই জোড়াসাঁকোর প্রাসাদ থেকে দূরে অন্য কোথাও বাড়ি ভাড়া করে থাকেন। কখনও চন্দন নগরে মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে। কখনও সদর স্ট্রিটের বাড়িতে। সব জায়গাতেই রবি আর নতুন বৌঠান পরস্পরের বন্ধু ও সঙ্গী। রবির কবিতার প্রথম পাঠক বৌঠান। রবির সমালোচকও তিনি। দুজনের ‍খুনসুটি চলে সারাদিন।

ক্রমশ বন্ধুত্ব থেকে গভীরতর দিকে মোড় নেয় তাদের সম্পর্ক। তবে এ ভালোবাসা ঠিক শরীরে নয়, এ ভালোবাসা যেন আত্মার গভীরে। নিঃসন্তান কাদম্বরীর জীবনে এই সংকট যেমন আছে, তেমনি রয়েছে অন্য রকম সংকটও। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পেশাদারী মঞ্চের জন্য নাটক লেখেন। সেখানে তার প্রিয় অভিনেত্রী বিখ্যাত নটি বিনোদিনী। ঈর্ষার কাঁটা কাদম্বরীর বুকে বেঁধে। যদিও তার বিখ্যাত ও প্রতিভাবান স্বামীর কাছে এ নিয়ে অভিযোগ জানিয়েও কোনো লাভ হয় না। গোপনে থিয়েটারে গিয়ে কাদম্বরী দেখেন বিনোদিনীর অভিনয় দেখে কতটা আবেগে আপ্লুত হন তার স্বামী|

ননদ স্বর্ণকুমারীর ছোটমেয়েটিকে নিজের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন কাদম্বরী। মেতে থাকতেন শিশুটিকে নিয়ে, ভুলতেন নিঃসঙ্গতার দুঃখ। কিন্তু শিশুটির অকাল মৃত্যুর পর নিজেকে অপয়া বলে মনে হয় তার। বাড়ির অন্য মেয়েরা তাকে দোষারোপ করে। এতে আরও ভেঙে পড়েন তিনি।

জ্ঞানদানন্দিনীকেও ঈর্ষা করেন কাদম্বরী। কিন্তু সেটাও প্রকাশের কোনো পথ নেই। জ্ঞানদানন্দিনী তাকে পছন্দ করেন না। কারণ তিনি গরীব পরিবার থেকে এসেছেন। দেবর জ্যোতির সঙ্গে তার মাত্রাতিরিক্ত সখ্য। কাদম্বরীকে হেয় করেই যেন জ্ঞানদানন্দিনীর জয়। তার স্বামীকে ক্রমশ সরিয়ে নিয়ে তাকে একা করে দেওয়ার মধ্যে যেন জ্ঞানদানন্দিনীর সব আনন্দ।

রবির খ্যাতি হচ্ছে। এখন সে আর লাজুক কিশোর নয়। এখন ঘরে বাইরে তার আদর। তরুণ এই লেখককে ব্যস্ত থাকতে হয় অনেক কাজে। আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন নতুন বৌঠান। বিশেষ করে রবির বিয়ের পর।

রবির বিয়ের মাত্র চার মাস পর নতুন বৌঠানের আত্মহত্যা| সেদিন জলে ভাসছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নতুন জাহাজ সরোজিনী। প্রথম রাতে সেখানে বসবে গানের আসর। সে আসরে রবীন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, জ্ঞানদানন্দিনী তো থাকবেনই।কিন্তু কাদম্বরীও কি থাকবেন না? অবশ্যই  থাকবেন তিনি। নীলাম্বরী বালুচরী শাড়ি পরে সগর্বে তিনি বসবেন স্বামীর পাশে, দেখিয়ে দেবেন জ্ঞানদানন্দিনীকে তার আসল মর্যাদা কোথায়। শ্রীরামপুরে জাহাজটি রয়েছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো এসে স্ত্রীকে নিয়ে যাবেন সঙ্গে করে। কিন্তু ভাটায় জাহাজ আটকে পড়ায় আসা হয় না তার।

প্রহরের পর প্রহর চলে যায়, জ্যোতিরিন্দ্র আর আসেন না। অপেক্ষার পর অপেক্ষা করেন কাদম্বরী। তার কথা সবাই ভুলে গেছে । রবির খাতাতেও তিনি লেখা দেখেছিলেন ‘হেথা হতে যাও পুরাতন’। তিনি আর নতুন বৌঠান নন। সবার কাছে পুরাতন হয়ে গেছেন, বাতিল হযে গেছেন। স্বামীর জামার পকেটে তিনি আবিষ্কার করেন একটি প্রেমপত্র। যেটি কোনো এক নারী লিখেছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছে। তবে আর বেঁচে থেকে কি হবে, আসুক ঘুম, আসুক চির শান্তি। অভিমানী কাদম্বরী দেবীর এই ট্র্যাজেডির সাথর্ক রূপকার হয়েছেন সুমন ঘোষ|

কঙ্কনা সেন শর্মা তার অসাধারণ অভিনয়ের মাধ্যমে কাদম্বরী দেবীকে জীবন্ত করে তুলেছেন সার্থকভাবে। দুর্দান্ত সব অভিব্যক্তিতে আবার নিজের প্রতিভার পরিচয় দিলেন তিনি। পরমব্রত চলনসই অভিনয় করেছেন রবির চরিত্রে। তার মেকআপ ছিল দারুণ। তবে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের তুলনায় তার অভিনয় কিছুটা লঘু বলে মনে হয়েছে। কাদম্বরীর প্রতি তার গভীর আবেগ যথোচিতভাবে প্রকাশিত হয়নি বলে মনে হয়েছে কোনো কোনো দৃশ্যে। কৌশিক সেন জ্যোতিদাদার ভূমিকায় চমৎকার। যদিও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ছবির সঙ্গে তার চেহারার মিল কিছুটা কম। বিনোদিনী দাসীর ভূমিকায় শ্রীলেখা মিত্র যথাযথ।

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‍ভূমিকায় কণ্ঠশিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য  ভালো অভিনয় করেছেন। তবে সত্যেন্দ্রনাথের ফটোগ্রাফের সঙ্গে তার চেহারাও খুব বেশি মেলেনি।

ছবিটির সংগীতের কথা আলাদাভাবে বলা প্রয়োজন। ছবিটিতে ওস্তাদ আমজাদ আলি খানের সংগীত পরিচালনা এক কথায় বলা যায় অনবদ্য। বিশেষ করে সরোদের ব্যবহার  অসাধারণ মনে হয়েছে।

ছবির দৃশ্যায়নও যথাযথ। পিরিওডিকাল চলচ্চিত্র হিসেবে অসাধারণ হয়েছে ‘কাদম্বরী’। ছবির একটি অনবদ্য দৃশ্য-গঙ্গাবক্ষে বজরায় তিন জন রবীন্দ্রনাথ, কাদম্বরী ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। আকাশে ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যার ছায়া।

নতুন বৌঠানকে উদ্দেশ্য করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’। রবীন্দ্রনাথ তার এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে ছিলেন সারা জীবনের বেদনায় ও বিরহে। তার অসংখ্য গানে জীবন্ত হয়েছিলেন নতুন বৌঠান। তার কবিতায় বিরহে ও আনন্দে মিশে ছিলেন তিনি।‘নষ্টনীড়’এর চারুলতা, ‘চোখের বালি’র বিনোদিনী কিংবা ‘ঘরে-বাইরে’র মেজ বৌঠান ও বিমলারূপে তিনি ফিরে এসেছেন বারে বারে।তার জীবনে তিনিই ছিলেন প্রথম নারী।‘বৌঠান’ সম্বোধনের মায়া তিনি কাটাতে পারেননি কখনও।

এমনকি রবীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে যখন ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করেন তখনও তার ছবিতে ফিরে ফিরে এসেছে নতুন বৌঠানের মুখ।

তাদের এই গভীর ভালোবাসার শিল্পসার্থক চিত্রায়ণ ‘কাদম্বরী’।