সার্ক সুফি ফেস্টিভাল: প্রাচীন প্রাসাদে কুহকী কাব্য

ঝর্না রহমানঝর্না রহমান
Published : 27 Oct 2015, 01:55 PM
Updated : 27 Oct 2015, 01:55 PM

২০১৫ সনের ১০, ১১ ও ১২ অক্টোবর তারিখে ভারতের জয়পুরের অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো 'সার্ক সুফি ফেস্টিভাল'। এটি মূলত ৫০তম সার্ক সাহিত্য উৎসব। এ উৎসবে যোগ দিতে 'পিংক সিটি'সহ অজস্র ঐতিহাসিক কীর্তিশোভিত শহর জয়পুরের প্রাচীন রাজপুত প্রাসাদ 'ডিগ্গি প্যালেস'-এ সমবেত হয়েছিলেন সার্কভুক্ত আটটি দেশের জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিবর্গ। এঁরা প্রায় সবাই-ই ছিলেন নিজ নিজ দেশের স্বনামধন্য কবি, সাহিত্যিক, গবেষক, বিদগ্ধ পণ্ডিত ও ধীমান ব্যক্তিত্ব। এঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সুফিবাদ, সুফিসাহিত্য, মরমী সাহিত্য ও ভক্তিরসাশ্রিত লোকসাহিত্যে বিশিষ্ট প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। অক্টোবরের এই তিনটি দিন এ সমস্ত আলোকিত ব্যক্তিত্বের সুফিবাদকেন্দ্রিক সৃজনশীল ও মননশীল উপস্থাপনা, আলাপ-আলোচনা, পারস্পরিক চিন্তাচেতনা ও ভাববিনিময় এবং অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ সাংস্কৃতিক আয়োজনে মুখরিত ছিলো।

'সার্ক সাহিত্য উৎসব' সার্ক-এর এপেক্স বডি 'ফাউন্ডেশন অব সার্ক রাইটার্স অ্যান্ড লিটারেচার' ( FOSWAL ) আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন। ১৯৮৬ সনে এ ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু আর প্রথম সার্ক সাহিত্য সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় ২০০০ সনের এপ্রিল মাসে।
সার্কভুক্ত দেশসমূহ– বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তান-এর লেখক-কবি-সাহিত্যিকদের জন্য একটি আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম এই উৎসব।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকে প্রতি বছর একাধিকবার অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এ উৎসব। বছরে কমপক্ষে একটি 'সার্ক সাহিত্য উৎসব' ছাড়াও 'সার্ক ফোকলোর ফেস্টিভাল', 'সুফি ফেস্টিভাল' ইত্যাদি আঙ্গিকে সার্ক-এর সম্মেলনের আয়োজন করে আসছেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত বিখ্যাত পাঞ্জাবী কথাসাহিত্যিক অজিত কাউর। তিনি ফসওয়ালের প্রেসিডেন্ট। কমিটির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন সার্কভুক্ত দেশের স্বনামধন্য গুরুত্বপূর্ণ লেখককবিপণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কবি রুবানা হক প্রমুখ সার্ক-এর এপেক্স বডির সম্মানিত সদস্য।
মূলত অজিত কাউরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায়ের ফলে ব্যাপক আয়োজনের সার্ক সাহিত্য উৎসবটি প্রতি বছর নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। অগ্রগামী চেতনার অধিকারী জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিবর্গের সম্মেলনের মাধ্যমে সার্কভুক্ত দেশসমূহের মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি-ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিকাশ ও সমৃদ্ধির একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি তিনদিনের সম্মেলনে কবিসাহিত্যিক ও বিদ্বৎজনের মধ্যে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিসম্প্রীতিবন্ধুত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করা, শুভচেতনা, মানবিকতাবোধ ও ইতিবাচক মতাদর্শের জাগরণ ঘটানোর একটি অনন্য সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও প্রতিবেশী দেশসমূহের মধ্যে দ্বন্দ্বসংঘাত, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি সমস্যা যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নস্যাৎ করা ও বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত করার অন্যতম কারণ, তা নিরসনের ক্ষেত্রেও সার্ক সাহিত্য উৎসব একটা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।

সার্ক সাহিত্য উৎসব প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিলো দিল্লীতে। এরপর দিল্লী, আগ্রা, লক্ষ্নৌ, চন্ডিগড়, জয়পুর, সিমলাসহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০০১ সনে বাংলাদেশে ৩য় সার্ক-উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সে বছর প্রথম কবি শামসুর রাহমানকে সার্ক সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়। এর পর আবার গত বছর, ২০১৪ সনে ঢাকায় সার্ক সাহিত্য উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।
২০১৫ সনের 'সার্ক সাহিত্য উৎসব' অনুষ্ঠিত হয়েছিলো 'সিটি অফ লাভ' খ্যাত তাজমহলের শহর আগ্রায়। এ বছরেরই অক্টোবরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনটি ছিলো 'সার্ক সুফি ফেস্টিভাল'। সুফিবাদ প্রাচ্যের দেশসমূহে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ভক্তিদর্শন। নিজেকে চেনার মধ্য দিয়ে স্রষ্টা বা ঈশ্বরকে চেনা এবং তাঁকে নিজের মধ্যে ধারণ করা– সুফিবাদের এই আত্মদর্শনমূলক ধারণাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মরমী সাহিত্যসহ সার্কভুক্ত দেশসমূহে ভক্তিরসাশ্রিত বিচিত্র সাহিত্য ও সংগীতের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিটি সার্ক উৎসবেই অ্যাকাডেমিক সেশনে উপস্থাপনের জন্য আমন্ত্রিত কবিসাহিত্যকগণ থিমভিত্তিক প্রবন্ধ রচনা করেন। কবিতা অধিবেশনগুলোতেও কবিরা মূলত থিমভিত্তিক স্বরচিত কবিতা পড়েন। শুধু সাহিত্য নয়, বরঞ্চ সমস্ত কর্মকাণ্ডের মধ্যেই থিমের প্রতিফলন ঘটানোর একটা প্রচেষ্টা সার্ক উৎসবগুলোতে পরিলক্ষিত হয়। এবারের সুফি উৎসবেও তাই সমস্ত প্রবন্ধ উপস্থাপন ও কবিতা ছিলো সুফিবাদ ভক্তিবাদ বা মরমী সাহিত্যভিত্তিক।


এ উৎসবে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলাদেশের পাঁচজন কবিসাহিত্যিক যোগ দিয়েছিলেন। এঁরা হচ্ছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত স্বনামধন্য কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, কবি বিমল গুহ, কবি ও লোকগবেষক ফরিদ আহমেদ দুলাল, কবি, প্রাবন্ধিক ও সুফি গবেষক শেখ রবিউল হক, ও কথাশিল্পী-কবি ঝর্না রহমান। এ ছাড়া ভারত ও অন্যান্য সার্কভুক্ত দেশ মিলিয়ে প্রায় শ দেড়েক লেখক-কবি-সাহিত্যিকের এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিলো এবারের 'সার্ক সুফি ফেস্টিভাল'।
সার্ক সুফি উৎসবের এবারের ভেন্যু জয়পুরের ডিগ্গি প্যালেস। অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন প্রাচীন রাজকীয় অট্টালিকা ও সুদৃশ্য বাগবাগিচাশোভিত সুরম্য ও বর্ণাঢ্য ডিগ্গি প্যালেস-এ উৎসবের আয়োজন উৎসবকে নিঃসন্দেহে একটি ভিন্ন মাত্রা প্রদান করেছিলো।
বাংলাদেশের পাঁচজনের দলটি ৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় ডিগ্গি প্রাসাদে পৌছানোর পর তাঁদেরকে সেখানকার ঐতিহ্যবাহী রীতি অনুযায়ী কপালে শস্যচন্দনসিঁদুর ফোঁটা, মাথায় ধানদূর্বা বর্ষণ আর গলায় তাজা ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেয়া হয়। উৎসবের পরবর্তী তিনদিনই ছিলো ঐতিহ্যবাহী আচারআচরণের আড়ম্বর। বিশাল হল রুমে কারুকার্যখচিত উঁচু থাম আর খিলান গম্বুজের নিচে হাজার বাতির ঝাড়লণ্ঠন, দেয়ালে দেয়ালে রাজপুরুষদের সুবিশাল পেইন্টিংস, দেয়ালজোড়া প্রাচীন বেলজিয়াম আয়না, সিঁড়ির ল্যাণ্ডিংএ বিশাল বিশাল তামার পাত্র, ফুলদানি, রঙিন ফুললতাপাতার নকশা, শামলা পরা বয়-বেয়ারা-বাবুর্চি– সবকিছুই সার্ক সুফি ফেস্টিভালকে বর্ণাঢ্য আর আড়ম্বরপূর্ণ করে তুলেছিলো।
এ উৎসবের হোস্ট ছিলেন ডিগ্গি প্যালেসের স্বত্ত্বাধিকারী ঠাকুর রামপ্রতাপ সিং ও ঠাকুরানী জ্যোতিকা সিং। অত্যন্ত সাধারণ পোশাকে সজ্জিত ঠাকুর রামপ্রতাপ সিং এবং রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী ঘাগরা-কটি-দোপাট্টা-সিঁথিমৌর সজ্জিত ঠাকুরানী জ্যোতিকা সিং-এর সার্বক্ষণিক তদারকি এবং আন্তরিক আতিথেয়তা উৎসবের সাফল্যকে নিঃসন্দেহে ত্বরান্বিত করেছিলো।

১০ অক্টোবর ফেস্টিভালের উদ্বোধনী সময় ছিলো সকাল সাড়ে নয়টা। কিন্তু প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, রাজস্থানের মাননীয় গভর্নর শ্রী কল্যাণ সিং-এর আসতে দেরি হওয়ায় উদ্বোধন হয় সকাল সাড়ে দশটায় ডিগ্গি প্যালেসের দরবার হলে।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর পৌত্রী তারা গান্ধী ভট্টাচার্য। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্য বিশিষ্ট অতিথিবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ফসওয়ালের প্রেসিডেন্ট অজিত কাউর, ঠাকুর রামপ্রতাপ সিং, ঠাকুরানী জ্যোতিকা সিং, বিচারপতি এস এস কোঠারি, পণ্ডিত জগদীশ চন্দ্র, অধ্যাপক রেফাকাত আলী খান প্রমুখ।
একদল তরুণ শিল্পীর ভারতের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা ঘটে। প্রধান অতিথিসহ বিশিষ্ট অতিথিবৃন্দকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নেন শ্রী জগদীশ চন্দ্র এবং ঠাকুর রামপ্রতাপ সিং। এরপর মেঘোয়াল শিল্পীগোষ্ঠি গণেশবন্দনাগীতি পরিবেশন করেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এর পর ছিলো বক্তব্যপর্ব। প্রধান অতিথি রাজস্থানের মাননীয় গভর্নর শ্রী কল্যাণ সিং অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এর পর ফসওয়ালের প্রেসিডেন্ট অজিত কাউর স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন। অজিত কাউর বার্ধক্যজনিত শারীরিক দুর্বলতা সত্ত্বেও অত্যন্ত সতেজ আন্তরিকতায় লিখিত স্বাগত ভাষণ পাঠ করলেন। সার্ক সুফি উৎসবের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, উদার ও মহৎ উদ্দেশ্য এবং ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা ছিলো তাঁর ভাষণের মূল সুর। এর পর পর্যায়ক্রমে শ্রী জগদীশ চন্দ্র, বিচারপতি এস এস কোঠারি, বিশেষ অতিথি শ্রীমতী তারা গান্ধী এবং সুফি ফেস্টিভালের ডিরেক্টর প্রফেসর রেফকাত আলী খান বক্তব্য প্রদান করেন। ঠাকুর রামপ্রতাপ সিং-এর ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে উদ্বোধনী পর্বের সমাপ্তি ঘটে।
১০ অক্টোবর, উদ্বোধনী দিবসে সকাল বিকাল দুটো চা বিরতি আর মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় বাদে মোট তিনটি একাডেমিক সেমিনার ও তিনটি পোয়েট্রি সেশন চলে। সকালের সেশন শুরু হয় বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের মধ্য দিয়ে। ফসওয়ালের প্রেসিডেন্ট অজিত কাউর, ঠাকুর রামপ্রতাপ সিং ও শ্রী জগদীশ চন্দ্র আগত অতিথিদের মধ্য থেকে কয়েকজন কবির নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।
ওই দিন দুপুরে, তিনবার রাষ্ট্রীয় সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত শ্রীলংকান সাহিত্যিক মিঃ দয়া দিশানায়েকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনার পর্বে অন্যান্যদের সঙ্গে পেপার উপস্থাপন করেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ও ঝর্না রহমান। মুহম্মদ নূরুল হুদা উপস্থাপিত প্রবন্ধের শিরোনাম ছিলো Portarit of an Aesthetic Sufi এবং ঝর্না রহমান উপস্থাপিত প্রবন্ধের শিরোনাম ছিলো The Idol of Lalon Fakir.

বিকেলের সেমিনার পর্বটি পরিচালত হয় শ্রীলংকার কবি ও সাহিত্যক মিঃ এসএমজিএন ধর্মশেকারার সভাপতিত্বে। এ পর্বে বাংলাদেশের কবি ও লোক গবেষক ফরিদ আহমেদ দুলাল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তাঁর প্রবন্ধের শিরোনাম ছিলো Spirit of Poetry and World Peace.
একই দিন বিকেলের পোয়েট্রি সেশনে কবিতা পর্বে বিভিন্ন দেশের কবিদের সাথে বাংলাদেশের কবি ফরিদ আহমেদ দুলালও কবিতা পড়েন। এই সেশনের সভাপতিত্ব করেন ভারতের স্বনামধন্য কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক ড. তারান্নুম রিয়াজ।
সন্ধ্যায় ছিলো ইটিভির সৌজন্যে প্রাসাদ প্রাঙ্গণে বিশাল মঞ্চে আয়োজিত আড়ম্বরপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পুরো অনুষ্ঠানই ছিলো সুফি সংগীতনৃত্যবাদ্যের অপূর্ব পরিবেশনায় জমজমাট। 'বিশেষ' সংগীত গোষ্ঠীর বাদ্যযন্ত্র ও কণ্ঠধ্বনি সহযোগে সুফি ধ্যান-কোরাস দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা ঘটে। এর পরে সুফি ভক্তিগীত পরিবশেন করেন পাকিস্তানের স্বনামধন্য লোকশিল্পী ফকির ওয়াহিদ বখশ। ছাব্বিশ বছরের তরুণ নৃত্যশিল্পী সুহেল ভান অপূর্ব দক্ষতায় দীর্ঘসময় একটানা চারটি সুফি ভরতনাট্যম পরিবেশন করে দর্শক শ্রোতাকে বিস্ময়ে আবিষ্ট করে রাখেন। সব শেষে ছিলো পাঞ্জাবের বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী জিয়া নাথ পরিবেশিত সুফি ডান্স।
ইটিভি মঞ্চ ছাড়াও প্রাসাদ প্রাঙ্গণে ইটিভি নিউজ নেটওয়ার্কের সৌজন্যে আরও একটি সাংস্কৃতিক মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল। ওই মঞ্চে দিনভর চলেছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিল্পী কবি ও তরুণদের কবিতা গানসহ নানারকম পরিবশেনা।
১১ অক্টোবর, দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানমালাও ছিল একই ধারার। সারাদিনে তিনটি অ্যাকাডেমিক সেশন ও তিনটি পোয়েট্রি সেশন এবং সন্ধ্যায় জমজমাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।


সকালের পেপার উপস্থাপন পর্বের পরে কবিতা অধিবেশনে বিশেষ আকর্ষণ ছিলো শিল্পী শবনম ভার্মানি ও বিপুল রিখির দ্বৈতকণ্ঠে কবীর-ভজন পরিবেশনা এবং ড. আনন্দ কুমার পরিবেশিত মধ্যযুগের কবি মালিক মহম্মদ জায়সীর পদুমাবৎ কাব্য থেকে আবৃত্তি।
দ্বিতীয় দিন বিকেলে নেপালের কবি নাট্যকার লোক গবেষক ও কলামিস্ট প্রফেসর অভি সুবেদীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পোয়েট্রি সেশনে সার্ক দেশীয় অন্যান্য কবিদের সাথে স্বরচিত কবিতা পড়েন বাংলাদেশের কবি বিমল গুহ, ঝর্না রহমান ও কবি শেখ রবিউল হক। এঁরা প্রত্যেকেই প্রথমে একটি করে কবিতা মাতৃভাষায় উপস্থাপন করে পরে ইংরেজি ভাষায অনূদিত কবিতা পড়েন। এই সেশনে দর্শক গ্যালারিতে উপস্থিত ফসওয়ালের প্রেসিডেন্ট অজিত কাউরের অনুরোধে ঝর্না রহমান একটি নজরুল সংগীত পরিবেশন করেন।
বিকেলের অ্যাকাডেমিক সেশনে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশের শেখ রবিউল হক। তাঁর প্রবন্ধের শিরোনাম ছিলো ঝঁভরংস ধহফ ডড়ৎষফ চবধপব. এ সেশনটি পরিচালনা করেন ভুটানের কবি ড. বাল বাহাদুর ভান্ডারি।

দ্বিতীয় দিনের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যাটি ছিলো অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ এবং সার্ক অতিথিবৃন্দ ছাড়াও আমন্ত্রিত বিশিষ্ট অতিথিবৃন্দের উপস্থিতিতে জমজমাট ও বর্ণাঢ্য।
অনুষ্ঠানে আবৃত্তি ও তাৎপর্য বিশ্লেষণসহ কবীরের ভজন পরিবেশন করে দীর্ঘ সময় দর্শক শ্রোতাকে এক অনির্বচনীয় ভাবাবেশে আবিষ্ট করে যেন অতীন্দ্রিয়লোকে নিয়ে যান শিল্পী শবনম ভার্মানি ও বিপুল রিখি। এ ছাড়া ছিলো স্বনামধন্য পাঞ্জাবি শিল্পী হর্ষদীপ কাউরের সুফি সংগীত পরিবেশনা।
তৃতীয় দিন, ১২ অক্টোবর ছিলো উৎসবের সমাপনী দিবস। এ দিন মধ্যাহ্ন ভোজের আগেই অ্যাকাডেমিক ও কবিতা সেশন সমাপ্ত হয়। সমাপ্তি অধিবেশন পরিচালনা করার দায়িত্ব ছিলো বাংলাদেশের কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার। কিন্তু অনিবার্য কারণবশত তাঁর বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন জরুরি হওয়াতে ওই দিন তিনি এবং আরও তিনজন ( ফরিদ আহমেদ দুলাল, শেখ রবিউল হক, ঝর্না রহমান ) জয়পুর ত্যাগ করেন। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা তাঁর দায়িত্বটি কবি বিমল গুহকে অর্পণ করে আসেন। কবি বিমল গুহ সমাপনী অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন। সব শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সার্ক সুফি ফেস্টিভাল-এর ডিরেক্টর প্রফেসর রেফাকাত আলী খান।
শেষ দিন সমাপনী অধিবেশনের পরের পর্ব ছিলো আমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে 'সিটি-টুর'। সার্ক-এর ব্যবস্থাপনায় সুফি ফেস্টিভালে আগত বিভিন্ন দেশের অতিথিবৃন্দকে জয়পুর শহরের দর্শনীয় স্থান ও স্থাপনা ভ্রমণ করিয়ে আনা হয়।
সন্ধ্যায় শ্রীরাম দরবার হলে থিয়েটার শিল্পী টম অলটার ও তার দল পরিবেশিত স্বনামখ্যাত লেখক ও নাট্যপরিচালক সায়ীদ আলমের মঞ্চনাটক 'লাল কিল্লে কা আখেরি মুশায়রা' পরিবেশনার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে জয়পুরের ইতিহাসখ্যাত গোলাপি শহরের কেন্দ্রস্থলে ডিগ্গি প্যালেসে অনুষ্ঠিত তিন দিনব্যাপী সার্ক সুফি ফেস্টিভালের।