একাল সেকালের ঈদ

মোস্তাক শরীফমোস্তাক শরীফ
Published : 3 May 2022, 06:44 AM
Updated : 3 May 2022, 06:44 AM

মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। গোটা রমজান মাসের সিয়াম সাধনার পর শাওয়াল মাসের প্রথম দিন পালিত হয় ঈদুল ফিতর। যেহেতু মুসলিমরা চান্দ্র মাস অনুসরণ করেন সেহেতু বছরের যেকোনো ঋতুতেই অনুষ্ঠিত হতে পারে এটি। আরবি ঈদ শব্দের আভিধানিক অর্থই উৎসব। সারা বিশ্বের মুসলিম এদিন উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠেন, যদিও দেশ ও সংস্কৃতি ভেদে এ উৎসবের ধরন নানারকম হতে পারে। ঈদ উৎসবের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ হচ্ছে স্বজনদের সঙ্গে মিলেমিশে আনন্দ করা। ঈদের আগে ঢাকা ছেড়ে দেশের নানা প্রান্তে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করার উদ্দেশে পাড়ি জমানো মানুষের ছবি আমাদের অতি পরিচিত। আমরা একা নই। মুসলিম প্রধান অনেক দেশেই এটি পরিচিত ছবি, যদিও আমাদের মতো এত বেশি সংখ্যায় হয়ত বড় শহর ছাড়েন না সেসব দেশের মানুষ। বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়ার কথাই ধরি। সেখানে ঈদের সময় বাড়ি যাওয়ার প্রথাটি মুদিক (বাড়ি ফেরা) নামে পরিচিত এবং এর ঐতিহ্য অতি প্রাচীন। এসময় স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়ার উদ্দেশে বড় বড় শহর থেকে দলে দলে নিজেদের এলাকায় ফিরতে থাকেন মানুষ। সেদেশে ঈদ উৎসবের আরেকটি অনুষঙ্গ হচ্ছে 'হালাল বিহালাল', যেটি হচ্ছে মূলত ঈদ উপলক্ষ্যে বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করা। তুরস্কে ঈদ-উল-ফিতর পরিচিত 'রামাজান বেয়রামি' (রমজান উৎসব) বা 'সাকের বেয়রামি' (মিষ্টির উৎসব) নামে। এ উপলক্ষ্যে মানুষ নতুন পোশাক পরে এবং একজন আরেকজনের সঙ্গে 'বেয়রামিনিজ মুবারেক ওলসুন' (আপনার বেয়রাম [ঈদ] আনন্দময় হোক) বলে সম্ভাষণ বিনিময় করে। তুর্কিদের ঈদ উৎসবের একটি ব্যতিক্রমী অনুষঙ্গ আছে-সৈকতে ভ্রমণ। ঈদ উপলক্ষে তুরস্কবাসী বিপুল সংখ্যায় পর্যটন শহরগুলোতে ভ্রমণ করে এবং অতি অবশ্যই ঘুরতে যায় সৈকতে। যত দিন যাচ্ছে সমুদ্র সৈকতে ভ্রমণ তাদের ঈদ উদযাপনের অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত হচ্ছে।


দিল্লি জামে মসজিদের পূর্ব গেট (১৭৯৫)

যাই হোক, বর্তমান ছেড়ে একটু অতীতচারী হওয়া যাক। এ সহস্রাব্দের গোড়ার দিকে ভারতবর্ষে ইসলামের প্রসারের পরই এদেশের উৎসবের তালিকায় দুই ঈদের সংযুক্তি ঘটে। ছয় মহা মুঘল সম্রাট-বাবুর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের সময় ঈদ উদযাপনের বিস্তারিত তথ্য খুব যে সহজলভ্য তা নয়, তবে হুমায়ুন, আকবর ও জাহাঙ্গীরের আমলে ঈদুল আজহার সময় গরু জবাইয়ের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার কথা জানা যায়, যদিও অন্যান্য পশু জবাইয়ে নিষেধাজ্ঞা ছিল না। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত না করার প্রয়াসই এমন নিষেধাজ্ঞার কারণ হতে পারে। প্রথম মুঘলদের সময় ঈদের সমান উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়েই ভারতীয় হিন্দুদের নানা উৎসব, বিশেষ করে হোলি উৎসব পালিত হতো।

বৃটিশদের হাতে মুঘল সাম্রাজ্যের গৌরবরবি যখন প্রায় অস্তমান তখনকার সময়ের মুঘল সম্রাটদের ঈদুল ফিতর পালনের কিছু তথ্য পাওয়া যায়। শেষ দুই মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর ও বাহাদুর শাহ জাফর শোভযাত্রা সহকারে দিল্লি জামে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে যেতেন। ঊনত্রিশ রমজানের দিন দিকে দিকে সম্রাটের প্রতিনিধিদের পাঠানো হতো চাঁদ দেখার জন্য। সবার উদগ্রীব নজর থাকত তখন আকাশের দিকে, ঈদের চাঁদ দেখার আশায়। সম্রাটের বার্তাবাহক যখন চাঁদ দেখার খবর নিয়ে ফিরে আসতেন তখনই শুরু হতো ঈদের বাঁধভাঙা আনন্দ। বাজনাঘর বা নাকারখানায় পঁচিশ বার গান স্যালুটের মাধ্যমে ঈদের আগমনী বার্তা ঘোষণা করা হতো। সেদিন চাঁদ দেখা না গেলে গান স্যালুট করা হতো পরদিন, ত্রিশ রোজার সমাপনান্তে।

ঈদের রাজকীয় শোভাযাত্রা (১৮৪৩)
ঈদের আগের রাতেই শামিয়ানা, বন্দুক, গালিচা এসব পাঠিয়ে দেয়া হতো ঈদগাহে। সম্রাটকে বহনকারী হাতিকে নানা রঙে সাজানো হতো। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্নান করে রত্নখচিত নতুন পোশাক পরিধান করতেন সম্রাট। দস্তরখান বিছিয়ে তার ওপর পরিবেশন করা হতো ঈদের দিনের বিশেষ নাস্তা-পোলাও, শুকনো ফল, মিষ্টি, দুধ ইত্যাদি। সম্রাট একে একে সবগুলো খাবারের স্বাদ নিতেন। এরপর কুলকুচো করে বাইরে বেরিয়ে আসতেন। রাজকীয় ঘোষক উপস্থিত সবাইকে সতর্ক করে দিত সম্রাটের আগমন সম্বন্ধে। কড়ানাকাড়ার শব্দে সহচরদের নিয়ে সম্রাট এগিয়ে যেতেন রাজকীয় হাতির দিকে। ফৌজদার খানের ইঙ্গিতে হাতি হাঁটু ভেঙে বসত। হাতিতে চেপে সম্রাট প্রথমে যেতেন দিওয়ান-ই-আম তথা সাধারণ মানুষদের যেখানে দর্শন দিতেন সেখানে। ময়দানে তখন একুশ বার তোপধ্বনি করা হতো। ঈদগাহ প্রাঙ্গনে পৌঁছে দু'ভাগ হয়ে যেত রাজকীয় শোভাযাত্রা। তোপধ্বনিতে আরো একবার মুখরিত হতো চারদিক। সম্রাট হাতির পিঠ থেকে নেমে হাওয়াদার বা রৌপ্যনির্মিত একটি চেয়ারে বসতেন। সর্বজ্যেষ্ঠ যুবরাজ উঠতেন পালকিতে। বাকিরা হেঁটে হেঁটে ঈদগাহ প্রাঙ্গনে প্রবেশ করতেন।

হাওয়াদারসহ সম্রাটকে বহন করে ওজু করার স্থানে নিয়ে যাওয়া হতো। সম্রাটের ওজু শেষ হলে তাঁর সহচরেরা হাঁকডাক করে সাধারণ মুসল্লিদের সরে গিয়ে সম্রাটের জন্য পথ ফাঁকা করে দিতে বলত। সম্রাট তখন যুবরাজ ও অভিজাত ব্যক্তিদের সাথে নিয়ে মসজিদের ভেতর প্রবেশ করতেন। সম্রাটের জায়নামাজ বিছানো হতো ইমাম সাহেবের ঠিক পেছনে। তাঁর বামে বসতেন সর্বজ্যেষ্ঠ যুবরাজ, বামে অন্য যুবরাজেরা। তাঁর অনুমতিক্রমে ইমাম মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা পাঠ শুরু করতেন। তাঁর কোমরে একটা তলোয়ার ঝুলিয়ে দিতেন 'দারোগা-ই-কুর' বা অস্ত্রাগারের তত্ত্বাবধায়ক। ইমাম সাহেব এক হাতে তরবারির বাঁট ধরে খুতবা পড়তেন। খুতবা শেষে একে একে পরলোকগত সকল মুঘল সম্রাটের নাম উচ্চারণ করা হতো। বর্তমান সম্রাটের নাম ঘোষণার সময় এলে সম্রাটের পোশাকাগারের তত্ত্বাবধায়ককে নির্দেশ দেয়া হতো ইমামকে একটি আলখেল্লা উপহার দেয়ার জন্য। এরপরই নামাজ পড়াতে শুরু করতেন ইমাম। নামাজশেষে কিল্লায় ফিরে যেতেন সম্রাট। সেখানে অভিজাতদের সাথে বিশেষ সভায় বসতেন দিওয়ান-ই-খাসে। অমাত্য ও অভিজাতদের কাছ থেকে উপঢৌকন গ্রহণ করতেন, বিনিময়ে তাদের দিতেন ফুলের মালা ও পাগড়ি। দিওয়ান-ই-খাসের সভা শেষ করে রূপার তৈরি সিংহাসনে বসে মহলে ফিরে যেতেন সম্রাট, সেখানে হারেমের নারীরা অপেক্ষায় থাকতেন নানারকম উপহার নিয়ে।
সপ্তদশ শতকে বাংলা, কুচবিহার, আসাম ও বিহারের সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে মির্জা নাথানের লেখা বিখ্যাত বই 'বাহারিস্তান ই গায়েবি'তে মুঘল আমলে বাংলার সেনাক্যাম্প ও বিভিন্ন শহরে রমজান ও ঈদ পালনের বিবরণ পাওয়া যায়। মির্জা নাথান তাঁর পিতার সঙ্গে বাংলায় এসে মুঘল সম্রাটের চাকুরি গ্রহণ করেন। ধারণা করা যায় এর আগেও আফগান/পাঠান শাসনের সময় জাঁকজমকের সঙ্গে বাংলার মুসলিমরা ঈদ উৎসব পালন করতেন। তবে মুঘল শাসন পাকাপোক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে উৎসবের আনন্দও অনেকটাই বেড়ে যেতে থাকে। মির্জা নাথানের বিবরণী থেকে জানা যায়, সব বয়সের মানুষ রমজানের সময় সেনাব্যারাকে সমবেত হয়ে সেহরি ও ইফতার করতেন। সেসময় ঢাকা মুঘল সাম্রাজ্যের প্রান্তবর্তী অতি সাধারণ একটি জনপদ, এ কারণে পুরনো আফগান কেল্লাকে (পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায়) ঘিরেই মূলত ঈদের উৎসব পালন করা হতো। ঈদের আগের দিন ঢাকার আকাশে চন্দ্রদর্শনের জন্য সবার জড়ো হওয়াও ছিল সে সময়ের অন্যতম ঈদ আকর্ষণ। চাঁদ দেখা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যরা বিউগল বাজিয়ে ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে সে খবর জানান দিত। পদাতিক সেনারা কামান দাগত ও আতশবাজির বিস্ফোরণ ঘটাত। এটি চলত মধ্যরাত পর্যন্ত। ঈদের দিন সেনাব্যারাক, প্রাসাদ ও কিল্লায় ভোজসভার আয়োজন করা হতো। সেখানে ধনী গরীব একসঙ্গে খানাপিনা করতেন। আয়োজন করা হতো নাচ ও গানের। এছাড়া মুঘল অভিজাতেরা দরিদ্রদেরকে সাধ্যমত দান করতেন।

উৎস:
উইকিমিডিয়া কমন্স

How the Badshahs of Delhi celebrated eid during the final years of the mughal empire, Rana safvi