ঈদ: উড়ুন থেকে ব্লেন্ডার

নূরিতা নূসরাত খন্দকার
Published : 2 May 2022, 06:10 PM
Updated : 2 May 2022, 06:10 PM


ঈদ এলেই মশলার গন্ধ ছড়ানো শৈশব। উড়ুনে ভাঙা হচ্ছে ঈদের রান্নার জন্য মশলা। বাতাস মৌ মৌ করা মশলার গন্ধ। অন্তরাত্মায় মন কেমন করা এক অন্যরকম মহাজাগতিক অনুভ‚তি ছড়িয়ে যেত ভাজা মশলার গন্ধে। মশলার নয়, সে যেন ছিল প্রকৃতির গায়ের সৌরভ। চারিদিক থেকে ঢুকঢুক করে উড়ুনে মশলা ভাঙার আওয়াজ ভেসে আসত, আর আমি সেই শব্দের তালে মিশে যেতাম। হৃদপিণ্ডের ধুকধুক শব্দের মতোই বাজত সেই তাল। যেন বিশ্বপ্রকৃতির হৃদপিণ্ডের শব্দ শুনছি- শিশু বয়সে আমার এমনি মনে হত। 'আধ্যাত্মিক', 'আধ্যাত্মিকতা'- এসব শব্দের সাথে তখনও আমার পরিচয় হয়নি। কিন্তু ঈদের আগের তিন চার দিন সোনালি বিকেলগুলো আমার চারিদিক ঘিরে থাকত বিশ্বপ্রকৃতির ধুকধুকির শব্দ। উড়ুন গাইনের পাড়গুলোও সংগীতের ছন্দ-তাল- মাত্রার মতন বাঁধা। একজন না দু'জন গাইন চালাচ্ছে তাও বুঝে নিতাম ভেসে আসা গাইনের শব্দ থেকে। একজন পাড় দিলে গাইনের তাল চলত মধ্যলয়ে, দুইজন পাড় দিলে গাইনের তাল মাত্রা চলত দ্রুত লয়ে।

বাড়ির উঠোনে খেলতে খেলতে কখন যেন কানে ভেসে আসা উড়ুন-গাইনের শব্দের সাথে নাচের ঝোঁক উঠে যেত। আনমনে নিজেই সেই শব্দের ঢুলুনি ছন্দে কল্পনার উড়ুন-গাইনে পাড় দিতে শুরু করতাম। এ ছিল আমার কাছে এক প্রকার নৃত্যই। স্মৃতির জানালায় যতদূর চোখ যায় তাতে আজও স্পষ্ট দেখি, ঘাম ঝরানো শ্রমিক নারীর শরীর দুলে দুলে উঠছে। তার এক পা সামান্য পেছনে, আরেক পা উড়ুনের কাছে। ডান হাতে গাইনটাকে আকাশ পানে তুলে উড়ুনের গহ্বরে টেনে নামিয়ে এনে পাড় দিচ্ছে। 'মুগুর উঠছে মুগুর নামছে' তার সর্বগাত্র জুড়ে গাইনের সাথে ভারসাম্য ধরে রাখার ছন্দ যেন ঢেউ তুলে তুলে ঘাম আর নিঃশ্বাসে ঝড় তুলছে। মাথার ঘোমটাটি তবু ভুলে যায়নি সে। হাতের কাঁকন-বালাও যেন সেই নৃত্যের তাল ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কখনো দুই হাতে গাইন ধরে আকাশে তুলছে আবার উড়ুনের পেটে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। ভাজা মশলাগুলোও লাফিয়ে লাফিয়ে গুঁড়ো হওয়ার জন্য ছটফট করছে। মাঝে মাঝে বাড়ির কর্ত্রী এসে উড়ুন থেকে মশলা তুলে চালনীতে ছেঁকে নিচ্ছে। শ্রমিক নারীর ক্ষুধার্ত বাচ্চাটি মুড়ির বাটি নিয়ে উঠোনের এক কোণে মাটিতে বসে নিজেও মুড়ি খাচ্ছে, আশপাশ ঘিরে ধরা হাঁসমুরগিদেরও ছিটিয়ে দিচ্ছে বিরক্ত মনে। হয়ত এক দুই ডালি ধান কিম্বা চালের বিনিময়ে শ্রমিক নারীটি ঈদের মশলা গুঁড়ো করার সওদা নিয়েছে। এখন হয়ত মেশিনের যুগে, কোম্পানির প্যাকেটে সহজলভ্য গুঁড়ো মশলার যুগে শ্রমিক নারীদের এমন সওদার সুযোগ হয়ত নেই আর।

অনেক বাড়িতে রোজার ঈদ কিম্বা কোরবানির ঈদের মরশুমেই সারা বছরের জন্য প্রয়োজনীয় সব মশলা গুঁড়ো করে রাখত। উড়ুন গাইন অনেকে চেনে, অনেকে কখনো চোখেও দেখেনি। কেউ কেউ তো নামও শোনেনি। তো আমার শৈশবে আমি উড়ুন-গাইন ঢের দেখেছি। উড়ুন গাইন হল একপ্রকার হাত ঢেঁকি বা ঢেনকি। ঢেনকিতে চলে পা, উড়ুনে গাইনে চলে হাত। উড়ুন হলো মোটা গাছের গুঁড়ি কেটে তৈরি করা বৃহৎ পাত্র। দূর থেকে দেখতে অনেকটা দাবার গুটি নৌকার মত। তবে উড়ুনের পেট ফোকরানো। হাতে খোদাই করে এটি বানানো হয়। উড়ুন গাইনে গম, ধান, জব, ভুট্টা ভেঙ্গে গুঁড়ো করা হয়। চিরা, ছাতু, শিদল, বরই ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা ইত্যাদিও তৈরি করা হয়।

উড়ুনের ফাঁকা পেট ঢেকে যদি চামড়া দিয়ে মুড়িয়ে দড়ি টেনে বেঁধে দেওয়া হয়, তাহলে আমার মনে হয় এটিও একপ্রকার পার্কেশনে পরিণত হবে। অনেকটা মোড়ার মত কিম্বা ওয়েস্ট আফ্রিকার প্রাচীন তালবাদ্য জ্যাম্বেই (Djembe)- এর মতোই দেখতে উড়ুনের অবয়ব। জ্যাম্বেইয়ের মতোই গাছের গুঁড়ি কেটে উড়ুন বানানো হয়। আর গাইনও কাঠের তৈরি লম্বা ও মসৃণ ডাণ্ডা। সম্ভবত শাল কাঠ দিয়ে গাইন তৈরি করা হয়, এটি দেখতে কালো এবং লহার মতোই শক্ত হয়। এক হাতের মুঠোয় ধরার মতো এর ব্যাস।

যা হোক, শৈশবের ঈদের আগমন মানেই উড়ুন গাইনে পাড় দেওয়া মশলার খুশবু ছড়ানো দিন। এই উড়ুন গাইন সবার বাড়িতে থাকত না। যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো, তাদের বাড়িতেই পাওয়া যেত উড়ুন গাইন। অবশ্য বংশ পরম্পরাতেও উড়ুন-গাইন প্রাপ্ত হত কেউ কেউ। ঈদ এলে দেখা যেত এ বাড়ির উড়ুন বাড়িতে গেছে মশলা গুঁড়োর জন্য। সে অর্থে উড়ুন গাইন আমাদের গ্রামবাংলার একপ্রকার সম্প্রীতির নিদর্শনও। কোথাও কোথাও উড়ুন-গাইনকে সম্ভবত উল্কিও বলে। উত্তরবঙ্গের লোকেরা উড়ুন গাইন বলে।

আমাদের বাড়িতে উড়ুন গাইন ছিল না। আমার জন্মের ঠিক এক দশক আগে মা-বাবাকে অনেক ভোগান্তি পাড় করতে হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদেরকে ব্যবসা-সংসার সব ফেলে কেবল কোলে দুই ছেলে সন্তান নিয়ে ভারতে শরণার্থী হতে হয়েছিল। হায় জীবনের কত রঙ্গ! নিয়তির পরিহাসে বাবা হলেন নিজ দেশে পরবাসী, ভারতের কুচবিহার ছিল বাবার জন্মভিটা। যুদ্ধের সময় গলায় হারমনিয়ম ঝুলিয়ে নিজের সেই জন্মভিটাতেই পূর্ববাংলার শরণার্থী, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ক্যাম্পে ক্যাম্পে গান গেয়েছেন তখন। সব খুইয়ে স্বাধীনতার পর লালমনিরহাটে প্রত্যাবর্তন করে আমার মা-বাবাকে আবারও শুরু থেকেই শুরু করতে হয়েছিল যাপনের যুদ্ধ। সব খোয়ানোর মধ্যে হয়ত এক প্রকার স্বতন্ত্র শিক্ষা রয়েছে, আমার বাবা জীবিতকালে কখনই কণ্ঠযোদ্ধার সার্টিফিকেট পাওয়া বা নেওয়ার জন্য কোন বাসনা প্রকাশ করেননি। পারিবারিকভাবে কথা প্রসঙ্গে তিনি সবসময়ই একটাই কথা বলেছিলেন, 'আমি যে দেশের মুক্তির জন্য নিজেরই জীবন সমর্পণ করেছিলাম সেই সময়, সময় বদলে গেছে বলে নিজের প্রতিজ্ঞার সাথে কম্প্রোমাইজ করতে হবে নাকি? ইতিহাস কোন সার্টিফিকেটে তৈরি হয় নাই, যা সত্য তা সত্যই থাকবে। সত্যের জন্য সার্টিফিকেট লাগে না'। যা হোক, এমনই সুকঠিন ব্রতধারী বাবার মেয়ে আমি, কিন্তু আমিই বা কী করে, কোথায় গেলে আমার বাবার ইতিহাসকে ধরে রাখার পথ পাব -তাও জানি না। সত্যি বলতে কি, বাবা আকাশের ঠিকানায় চলে যাওয়ার পর ঈদ এলে আমি এসব ভাবনারও জাবর কাটি।


শতবর্ষীয়ান পারিবারিক ইতিহাস ঐতিহ্য থাকলেও আমি কোন বনেদী বা বিত্তবান বাড়ির মেয়ে নই। কঠিন সংগ্রামের ভিতর দিয়ে চলতে চলতে বাবা-মা যখন খেয়ে পড়ে কিছুটা বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা পেয়েছিলেন তখনই আমার জন্ম। শৈশবে ঈদের সময় দেখতাম আমাদের বাড়িতে সারা বছর ধরে একটু একটু করে জমিয়ে রাখা মশলা গুঁড়ো করার জন্য আশপাশের কারোর বাড়ি থেকে ধার করে আনা হত উড়ুন গাইন, এক দুইদিনের জন্য। বাকী সারা বছর মাকে দেখেছি হাম্বল দিস্তা দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে।

অভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে গরু-বাছুর, ছাগল, হাঁস, মুরগী নিয়ে মায়ের সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের দৃশ্য দেখে দেখে বড় হয়েছি। সংসারে এতসব পরিশ্রমের মাঝেও মা তার ছেলেমেয়েদের জন্য ঈদের পোশাক নিজে সেলাই করতেন। সেলাই করার সময় মায়ের মুখটা খুব আবেগি হয়ে থাকত, যেন কোন ক্লান্তি নয় বরং পরম তৃপ্তির সাথে তিনি নিজের বাচ্চাদের জন্য নিজের মনের মতন জামা বানানোর সুখ নিচ্ছেন। আমার দুই সহোদও ভাইয়ের শৈশব কেটেছিল চরম অভাবে বিপর্যস্ত এক সংসারে। সংসারের কঠিন সময় কাটিয়ে ওঠার ঊষাকালে আমার জন্ম, তাই দুধে-ডিমে ভরপুর আমার শৈশব অভাব বোঝেনি। এখন আমি নিজে নিজের যাপন সংকট মোকাবেলা করি। তাই এখন বুঝতে পারি মা-বাবার ধৈর্য্য আর ত্যাগের মহিমা। শত অভাবের মাঝেও আমার মা-বাবা নিয়মিত বই পড়তেন, গান শুনতেন। আর আমার যখন হাত শূন্য থাকে তখন বই তো দূরে থাক বিষাদময় লাগে গোটা পৃথিবীটাই। তখন আমি নিরুপায় হয়ে স্মৃতির খাঁচা খুলে শৈশবে ঢুকে যাই, মা-বাবার কাছে দীক্ষা নিই- শত অভাবেও যেন স্বভাব নষ্ট না হয়।

ঈদ এলেই কানে ভাসে মায়ের সেলাই মেশিনের শব্দ, একটা কমলা রঙের জামা হচ্ছে আমার জন্য। ঈদ মানেই আমা পাতা নকশার নূপুর পায়েয়া ঝুমঝুমিয়ে ঘুরতে ঘুরতে মায়ের বানিয়ে দেওয়া সেই কমলা রঙের জামায় ফুলে ওঠা কুচির ঘের দেখার আনন্দ। সেই কমলা রঙের জামাটি সময়ের ছিনতাইয়ে হারিয়ে ফেলেছি আমি। কিন্তু উড়ুন গাইনের শব্দও যে একদিন কেড়ে নিবে সময়- তা বোঝার আগেই বুঝে ফেলেছি ঈদ মানে টিউব মেহেন্দি।

ঈদ এলেই মেহেন্দি পাতা ভরা শৈশব-আনন্দ। বন্ধুরা মিলে কোমরে গামছা বেন্ধে এ পাড়া সে পাড়া তোলপাড় করে এ বাড়ি সে বাড়ির বাগান ঘেঁটে মেহেন্দি গাছের পাতা জোগাড়ের জন্য বেরিয়েছি। কোন বাড়িতে ঢুকে মেহেন্দি পাতা ছেঁড়ার অনুমতি পেয়েছি হয়ত। কোন কোন বাড়িতে না পেলেও জেনে বুঝেই পাতা চুরি করেছি। চুরি খারাপ কাজ হলেও এই জাতীয় চুরির যে আনন্দ তার ব্যাখ্যা দেওয়া মুশকিল। কারণ যত জন গিয়েছি প্রত্যকের ভাগ সমান সমান হতে হবে, সেই সাথে প্রত্যেকের বাড়ির সবাই যেন মেহেন্দি দিতে পারে সেই বিষয়েও আমাদের ভাবনা ছিল ব্যাপক। আমরা কেউ মাস্টারের মেয়ে, কেউ ওসির মেয়ে, কেউ নার্সের মেয়ে কেউ বা চাউল ব্যবসায়ীর মেয়ে। তাই যত গাছ থেকে যত পাতা সংগ্রহ করি, প্রতিবারই পাঁচভাগ করে মেপে মেপে দেখি পাটায় বাটলে কতটুকু পরিমাণ হতে পারে। কম মনে হলে আবারও অন্য কোন বাড়ির বাগানে হামলা করেছি। মোটামুটি সবারই পেটে একটা মাঝারি সাইজ বিড়ালের সমান থলে ঝুলছে মেহেন্দি ভরা গামছায়। খুব সাবধানে যতটা পারা যায় টাইট করে আমাদের কোমরে গামছাগুলো বাড়ির লোকেরা বেঁধে দেওয়া হত। কোন ঈদে খুব ভাল কালেশন হত, যদিয় কোন কোন বার আমরা পৌঁছানোর আগেই কিছু গাছ উজাড় হয়ে যেত। যা হোক, মেহেন্দি পাতা ভাগাভাগি করে আমরা যে যার বাড়িতে ফিরতাম। এরপর আমরা কেউ কারো মুখও দেখতাম না ঈদের দিন সকাল ছাড়া। কার হাতের মেহেন্দি কত লাল হয়েছে, কে কত কূটনীতি মানে চুন-খয়ের-চাপাতা প্রয়োগ করে রঙ গাঢ় করেছে, কার নকশা কত বেশী স্টাইলিশ হয়েছে- এসবই ছিল আমাদের ঈদের দিন সকালের প্রথম আলোচ্য-বিবেচ্য বিষয়। সূর্যসেনা মাঠে ঠিক সকাল নয়টায় আমরা মিলিত হতাম। ঝকঝকে সকালের আলোয় সেজেগুজে অস্থির রাজকন্যা টাইপ ভাব নিয়ে একেকজন হাত মেলে ধরতাম। সবসময়ই আমি লাড্ডু খেতাম। কারণ, আমার মা কিম্বা ছোটভাইয়া কোন কূটনৈতিক চালই চালতে পারত না। মায়ের ছিল কাজের চাপ, ছোটভাইয়ার ছিল মেহেন্দির নকশা আঁকায় অসিদ্ধ হাত। আর আমার ছিল অধৈর্যপনা। কিন্তু তবুও সব দোষ ছোটভাইয়ার ঘাড়েই চাপিয়ে দিতাম বন্ধুদের সামনে নিজের মানসম্মান বাঁচাতে। আসলে সারারাত হাতে মেহেন্দি এঁকে ঘুমানোর মতন ধৈর্য ছিল না, বরং একটু পরপর একচিমটি করে নকশা তুলে তুলে রঙ দেখাতেই ছিল আমার আকুলতা। এই করতে করতে একপর্যায়ে ছোটভাইয়ার বকাঝকার কামান ছুটত, তারপর আমারও রাগের চোটে জেদের ঠ্যালায় হাত ধুয়ে ফেলাই ছিল শেষ পরিণতি। তারপর সদ্য ধুয়ে আসা হাতে সরিষার তেল মালিশ করতাম মায়ের বকুনি শুনতে শুনতে।

আমার শৈশবকালের ঈদ ছিল বিকেলের আলো অব্দি। খুব মন খারাপ লাগত, তখন বড়ভাইয়া, ছোটভাইয়া কেউই বাসায় থাকত না। ওদের মত কবে বড় হব, কবে আমিও সন্ধ্যার সময় বাসায় ফিরব এইসব ভেবেই ঈদের সন্ধ্যা কেটে যেত। মা ছাড়া আমি আর কোন মেয়ের সাথে বড় হইনি। যার ফলে ভাইয়াদের স্বভাব চরিত্রই আমার অনুকরণের বিষয় ছিল। মা ঈদের দিন কোথাও যেত না। মা কেন কোথাও যায় না বেড়াতে- এটা নিয়ে আদৌ মনে হয় তখনকার কালে আমি ভাবিনি। এখন আফসোস লাগে। কিন্তু তখন মনে হত, মা তো বাসাতেই থাকবে, না হলে মেহমান এলে খেতে দিবে কে? আহা! বড় আহাম্মক ছিলাম বটে। মাকে কখনই বলিনি মা আজ তুমি বেড়াতে যাও, আমিই সব মেহমানকে খেতে দিব। ঈদের দিন ঘেমে নেয়ে খড়ির চুলো ঠেলতেই দেখেছি মাকে। অনেক পড়ে অবশ্য গ্যাসের উনুনে মাকে রাঁধতে দেখেছি। সে দৃশ্য খুব বেশিদিন চোখে ধরে রাখতে পারিনি, সম্ভবত ক্লাস এইট থেকে কলেজ পড়া অব্দি। তারপরেই তো মা আকাশের ঠিকানায় চলে গেলেন। যা হোক, ঈদ এলে এসব স্মৃতির ভিড় ঠেলে বর্তমানে ফিরতে হয় আমাকে। এখনকার ঈদ এলে পার্লার, দেশি-বিদেশি নামী দামী কোম্পানির মেহেন্দি টিউব নয়ত শাকের আঁটির মতন মেহেন্দির অপুষ্ট ডাল, ডিজাইনার ড্রেস আরও কত কি না আছে! কিন্তু এখনকার ঈদ এলে অমন বিশ্বপ্রকৃতির হৃদপিণ্ডের ধুকধুকি শোনার মতন উড়ুন-গাইন, প্রকৃতির গায়ের সৌরভ অনুভবের মতন মশলার গন্ধ, বাড়ি বাড়ি ফেরি করে মেহেন্দি পাতা কালেকশন করার কোন সুযোগ নেই। পাঁচ মিনিটের কালার গ্যারান্টি দেওয়া মেহেন্দি আছে কিন্তু সব দোষ ছোটভাইয়ার ঘাড়ে চাপানোর মধ্যে যে আনন্দ সে আনন্দ লাভের সুযোগ তো টিউব মেহেন্দিতে নেই। আমরা মডার্ন হতে হতে আমাদের এখনকার শিশুরা মুখস্থ মেহেন্দির রঙে হাত রাঙাচ্ছে, অথচ আমার শিশুবেলা নিঃসন্দেহে পাতা ভাগাভাগির আনন্দে মুখর ছিল। ঘরে ঘরে ব্লেন্ডার, তাই ভোঁ ভোঁ করে বেজে ওঠা ব্লেন্ডারের বিকট শব্দে শিশুপরান, বুড়োপরান আচমকা কেঁপে ওঠে। অথচ উড়ুন-গাইন কত সুন্দর তাল-লয়-ছন্দে ঈদকে মুখরিত করে তুলত আমাদের ছেলেবেলায়। মিলের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও আজ আর অমন ভাজা মশলার প্রাকৃতিক সৌরভ নাকে লাগে না। আসলে ঈদ এলে আমরা সবাই মনে মনে শিশু হয়ে যাই। কারণ শিশুকালের স্বতঃস্ফূর্ত দিনগুলোই সবার মনে ভেসে ওঠে বড়বেলায় ঈদ এলে। তাছাড়া আমার ব্যক্তিগত অভিমত, বই-বাবা-মা ইত্যাদি চিরায়ত বিষয় সহ এখন এত এত বিষয়ের দিবস আর উৎসবের ভিড়ে যেন সব উতসবই ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে; যেমন উড়ুন-গাইনের জায়গায় ব্লেন্ডার, গ্রেন্ডার সহজ পন্থা হলেও এগুলো উৎসব আমেজ তৈরি করতে পারে না। যেমনঃ উড়ুন গাইন স্বয়ং উৎসব আমেজ তৈরি করতে সক্ষম। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা আর প্রাকৃতিক জীবন থেকে উদ্ভূত কৃষ্টির আমেজ ভিন্ন বিষয়। সকলকে জানাই ঈদ শুভেচ্ছা এবং শুভকামনা।