সবিশেষসহজবোধ্য ঝড় সতর্কীকরণ ব্যবস্থা চালু হয়নি দেড় দশকেও

ঘূর্ণিঝড়প্রবণ বাংলাদেশে ঝড় সতর্কীকরণের যুগোপযোগী ও সহজবোধ্য সংকেত পদ্ধতি এখনো চালু হয়নি। গত দেড় দশকে এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও দীর্ঘসূত্রতার জালে আটকে গেছে তা। প্রচলিত সংকেত ব্যবস্থা উপকূলের জনসাধারণের জন্য তেমন কার্যকর হচ্ছে না। জানাচ্ছেন মঈনুল হক চৌধুরী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Feb 2008, 05:52 AM
Updated : 13 Feb 2008, 05:52 AM
মঈনুল হক চৌধুরী
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক
ঢাকা, ফেব্র"য়ারি ১৩ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- ঘূর্ণিঝড়প্রবণ বাংলাদেশে ঝড় সতর্কীকরণের যুগোপযোগী ও সহজবোধ্য সংকেত পদ্ধতি এখনো চালু হয়নি। গত দেড় দশকে এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও দীর্ঘসূত্রতার জালে আটকে গেছে তা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো বলছে, দেশের সমুদ্র ও নৌবন্দরের জন্য ব্রিটিশ আমলের সনাতন সংকেত পরিবর্তন করে আধুনিকায়নের বিকল্প নেই। প্রচলিত সংকেত ব্যবস্থা উপকূলের জনসাধারণের জন্য তেমন কার্যকর হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সনাতনী সতর্ক সংকেত মূলত জাহাজ ও বন্দরকেন্দ্রিক। ঝড়ের কবল থেকে কেবল জাহাজকে নিরাপদে রাখতে এ ধরনের সংকেত ব্যবস্থা গড়ে ওঠে ঔপনিবেশিক আমলে। জনসাধারণের জন্য সতর্কবার্তার বিষয়টি সেখানে খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। মানুষের নিরাপত্তার বিবেচনায় ও সহজবোধ্য করার জন্য আধুনিক সতর্ক সংকেত ব্যবস্থা প্রবর্তন এখন জরুরি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরোর পরিচালক আবু সাদিক মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "সনাতনী সংকেত ব্যবস্থার আধুনিকায়নের কোনো বিকল্প নেই। ঝড়ের সতর্কতা সংকেত উপকূলের জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য ও সহজবোধ্য করে তুলতে হবে।"
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের বর্তমানে সমুদ্রবন্দরের জন্য সাধারণভাবে ১০টি এবং নৌবন্দরের জন্যে চারটি সংকেত চালু রয়েছে। এতে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ রয়েছে। সমুদ্রবন্দরের জন্য ঝড় সতর্কীকরণের অনেকগুলো সংকেত থাকায় জনসাধারণের কাছে বিপদের সর্বোচ্চ পর্যায়টি জানাতে অনেকগুলো ধাপ পার হতে হয়। সাধারণ মানুষও সংখ্যানুক্রমিক সংকেত বাড়ার অপেক্ষায় থাকে। ফলে দ্রুততম সময়ে বিপদ সম্পর্কে সচেতন করার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশে সমুদ্রবন্দরে ঝড় সতর্কীকরণের জন্য ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত, ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত, ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত, ৪ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত, ৫ নম্বর বিপদ সংকেত, ৬ নম্বর বিপদ সংকেত, ৭ নম্বর বিপদ সংকেত, ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত, ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত ও ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখানো হয়। সর্বশেষ ১১ নম্বর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সংকেতও রয়েছে সমুদ্রবন্দরের জন্য।
পাশাপশি অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরের জন্যে ১ নম্বর নৌ সতর্ক সংকেত, ২ নম্বর নৌ হুঁশিয়ারি সংকেত, ৩ নম্বর নৌ বিপদ সংকেত ও ৪ নম্বর নৌ মহাবিপদ সংকেত চালু রয়েছে।
কর্মকর্তারা আরও জানান, বর্তমান পদ্ধতিতে বেশ কয়েকটি সংকেত ঝড়ের তীব্রতাকে না বুঝিয়ে বন্দর থেকে এর দূরত্বকে বোঝায়। জনসাধারণের জানমাল রক্ষার চেয়ে বন্দরের নিরাপত্তা রক্ষাই এ ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব পায়। যেমন, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখানো হলে বুঝতে হবে ঝড়ো বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার। এক্ষেত্রে সংকেতের মাত্রা পরিবর্তনের জন্য ঝড়টি বন্দরের বাম কিংবা ডান দিক দিয়ে যাচ্ছে কি না বা সরাসরি বন্দরের ওপর আঘাত হানবে কি না সেটাই বিবেচিত হয়।
১৯৯২-৯৩ সালে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে মাস্টার প্ল্যান তৈরির সময় সমুদ্রবন্দর ও নৌবন্দরের জন্যে একীভূত সতর্কীকরণ সংকেত প্রণয়নের সুপারিশ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। এছাড়া, সংকেত ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ করে জনমুখী ও সহজীকরণের জন্য প্রায় বছর আড়াই আগে আবহাওয়া অধিদপ্তর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্পার্সো ও ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের প্রধানদের নিয়ে একটি কমিটি করে সরকার। ওই কমিটি একটি প্রতিবেদন দিলেও পরে সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
গত বছরের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতের পর ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ওই প্রতিবেদন নতুন করে পর্যালোচনার জন্য ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী নেতৃত্বে গঠিত আরেকটি কমিটিকে নির্দেশ দেয়। এই কমিটি গত ১৩ জানুয়ারিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিয়েছে। এতে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরামর্শক কমিটির পরামর্শ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর প্রতিবেদনে বন্দরের পাশাপাশি জনসাধারণের জন্য সতর্কবার্তাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, সমুদ্রবন্দরের জন্য প্রচলিত ১০টি সংকেতের মধ্যে ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত ও ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত বহাল রেখে অন্য সংকেত কমাতে বলা হয়েছে। গুরুত্ব কম বলে ৩, ৫, ৬, ৭, ৯ নম্বর সংকেত সমন্বয় করে সেখানে মাত্র একটি সংকেত রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।"
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ড. আসাদউজ্জামান সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "সতর্কীকরণ সংকেত যুগোপযোগী করে সমুদ্র ও নৌবন্দরের জন্য সমন্বিত একটি ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিষয়টি বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন আছে। জামিলুর রেজা চৌধুরী কমিটির প্রতিবেদনটি উপদেষ্টা পরিষদে পাঠানোর অপেক্ষায় রয়েছে।"
এ বিষয়ে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "সংকেত আধুনিকায়নের বিষয়ে ১৯৯২ সাল থেকে কথা হচ্ছে। সর্বশেষ সিডর পরবর্তী সময়ে সরকার বিষয়টিতে মনোযোগ দিয়েছে। গত ১৩ জানুয়ারি আমার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছি। আবহাওয়া অধিদপ্তর ১০টির কথা বললেও কার্যত বর্তমানে ১ থেকে ১১টি সংকেত সমুদ্রবন্দরের জন্য এবং নৌবন্দরের জন্যে চারটি সংকেত রয়েছে। এর পরিবর্তে সমন্বিত সংকেত প্রবর্তনের সুপারিশ করেছি আমরা। প্রতিবেদনে সতর্কীকরণ সংকেতের সংখ্যা কমিয়ে ছয় থেকে সাতটির মধ্যে রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।"
এদিকে, আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের আটটি দেশ ভারত, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ওমান, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারে একই ধরনের ঘূর্ণিঝড় সতর্ক সংকেত ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাব দেওয়ার কথাও ভাবছে বাংলাদেশ। এ আট দেশের মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের সমুদ্রবন্দরে একই ধরনের সংকেত চালু রয়েছে।
আবহাওয়া দপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছর ওমানে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সাইক্লোন সংক্রান্ত আঞ্চলিক সংস্থা এসকাপ (ইকনমিক অ্যান্ড সাইন্টেফিক কমিশন ফর এশিয়া প্যাসিফিক) এর সভা হবে। সেখানে আরব সাগর ও বঙ্গোপসার সংলগ্ন বাংলাাদেশ, ভারত, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ওমান, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার অংশ নেবে। এতে সমন্বিত সতর্ক সংকেত বার্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাবটি উপস্থাপন করবে বাংলাদেশ।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক ড. সমরেন্দ্র কর্মকার সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "প্রচলিত ঝড় সতর্কীকরণ সংকেতের পরিবর্তে 'সমন্বিত সতর্কীকরণ সংকেত' প্রবর্তনের বিষয়টি সরকারি পর্যায়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত যে সিদ্ধান্তই হোক না কেন