প্লাস্টিক ছাড়া মানুষের চলবে?

কোনো জাদুর কাঠি নেড়ে হিং টিং ছট বলে যদি পৃথিবীর সমস্ত প্লাস্টিক এক নিমিষে উধাও করে দেওয়া যায়, তাহলে এই গ্রহের চেহারাটা কেমন দাঁড়াবে?

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 July 2022, 07:22 PM
Updated : 18 July 2022, 03:45 AM

মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেভাবে প্লাস্টিকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তাতে প্লাস্টিক ছাড়া আমরা কি বাঁচতে পারব? এক প্রতিবেদনে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে বিবিসি।

২০১৫ সালের শেষ পর্যন্ত উৎপাদিত ৮ হাজার ৩০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিকের মধ্যে ৬ হাজার ৩০০ মিলিয়ন টন ব্যবহারের পর ফেলা দেওয়া হয়েছে। এই প্লাস্টিক বর্জ্যের বেশির ভাগই এখনও আমাদের চারপাশে পড়ে আছে, ল্যান্ডফিলের উচ্চতা বাড়াচ্ছে, কিংবা পরিবেশ দূষিত করছে।

অ্যান্টার্কটিককার বরফে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। পানীয় জল এবং গভীর সমুদ্রে থাকা প্রাণির পেটেও এর অস্তিত্ব মিলেছে। প্লাস্টিক বর্জ্য এখন এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে তা অ্যানথ্রোপোসিনের (পৃথিবীর ওপর মনুষ্য কর্মকাণ্ডের প্রভাবে শুরু নতুন যুগ) ভূতাত্ত্বিক সূচক হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা।

মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে লাক্ষাকীট থেকে তৈরি রেজিনের মত উপকরণ ব্যবহার করে আসছে প্লাস্টিকের মত করে। কিন্তু আজকের যে প্লাস্টিক আমরা চিনি, তার শুরু ২০ শতকে। ১৯০৭ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে তৈরি প্রথম প্লাস্টিকের নাম বেকেলাইট।

তবে সামরিক বাহিনীর বাইরে সিন্থেটিক প্লাস্টিকের ব্যবহার শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে। তখন থেকে প্রতি বছর বেড়েছে প্লাস্টিকের উৎপাদন। ১৯৫০ সালের দুই মিলিয়ন টন থেকে ২০১৫ সালে ৩৮০ মিলিয়ন টন হয়েছে।

যদি এই হারে চলতে থাকে, তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক উৎপাদনের বার্ষিক পরিমাণ তেল উৎপাদনের ২০ শতাংশ হবে।

পিইটি বোতলের এই স্তুপ যশোরের একটি প্রক্রিয়াজাত কারখানার পাশে। ভারত এবং চীনে পিইটি ফ্লেক্স রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় দেশের অনেক কারখানায় এভাবেই জমছে বোতল।ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

বিবিসি লিখেছে, বর্তমানে ভার্জিন প্লাস্টিক বা নতুন প্লাস্টিক সবথেকে বেশি ব্যবহৃত হয় প্যাকেজিং শিল্পে। তবে দীর্ঘস্থায়ী প্লাস্টিকও ব্যবহার করা হয় ব্যাপক হারে। ভবন, পরিবহন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, টিভি, কার্পেট, ফোন, জামাকাপড় এবং অগণিত দৈনন্দিন জিনিসপত্রে প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। এর মানে হল, প্লাস্টিক ছাড়া পৃথিবী এখন এক অবাস্তব কল্পনা।

হাসপাতালে প্লাস্টিক না থাকলে অবস্থা হবে শোচনীয়। যুক্তরাজ্যের কিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবিলিট অ্যান্ড গ্রিন টেকনোলজির সিনিয়র লেকচারার শ্যারন জর্জ বলেন, “প্লাস্টিক ছাড়া একটি ডায়ালাইসিস ইউনিট চালানোর কথা কল্পনা করুন তো...।”

গ্লাভস, টিউব, সিরিঞ্জ, রক্তের ব্যাগ, নমুনা টিউব এবং আরও অনেক কিছুতে প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। এক সমীক্ষার বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের একটি হাসপাতালে একটি টনসিলেক্টমি অপারেশনে ১০০টির বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়।

কিছু সার্জন অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন, হাসপাতালে প্রয়োজনের বেশি প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। তবে এই মুহূর্তে চিকিৎসার কাজে অনেক প্লাস্টিক সামগ্রী অপরিহার্য এবং সেগুলো ছাড়া জীবন বাঁচানো কঠিন হবে।

দৈনন্দিন কিছু প্লাস্টিক উপকরণ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অত্যাবশ্যক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি সামগ্রীর তালিকায় রয়েছে কনডম এবং ডায়াফ্রাম। প্লাস্টিকভিত্তিক সার্জিক্যাল মাস্কসহ ফেইস মাস্ক, শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার জন্য রেসপিরেটর, পুনরায় ব্যবহারযোগ্য মাস্ক করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করেছে।

জর্জ বলেন, “কোভিডের জন্য আপনার সঙ্গে থাকা মাস্ক আমাদের নিরাপত্তা এবং অন্যদের নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি না থাকলে জীবন বিপন্ন হওয়ার কারণ ঘটতে পারে।”

প্লাস্টিক না থাকলে তা এখন আমাদের খাদ্য ব্যবস্থার ওপরও প্রভাব ফেলবে। পরিবহনের সময় খাবার নিরাপদ রাখা, সুপারমার্কেটের তাক পর্যন্ত পৌঁছানো এবং বিপণনের জন্যও প্লাস্টিক এখন জরুরি উপকরণ।

লন্ডনের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পরিবেশ ব্যবস্থাপনার শিক্ষক এলেনি ইয়াকোভিডুর ভাষায়, “আমাদের পুরো সিস্টেমে থেকে প্লাস্টিককে কীভাবে প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব, আমি জানি না।”

এক্ষেত্রে কেবল ভোক্তাদের অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে তা নয়; সুপারমার্কেট সাপ্লাই চেইনে যে প্যাকেজজাত পণ্য বিক্রি হয়, সেগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। খামারের অত্যন্ত পচনশীল পণ্যগুলো, যেমন- অ্যাসপারাগাস, সবুজ মটরশুটি এবং বেরি ক্ষেতেই পচতে পারে প্লাস্টিক বাদ দিলে।

সাপ্লাই চেইনের সমস্যার সমাধান করতে চাইলে ফল এবং শাকসবজি খোলা বিক্রি করতে হবে। এতে আমাদের ঘনঘন কেনাকাটার প্রয়োজন হবে।

যুক্তরাজ্যের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত দাতব্য সংস্থা র‌্যাপের গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের ব্রোকলি ফ্রিজে রাখলে তা এক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকে। ঘরের তাপমাত্রায় কলা থাকে ১.৮ দিন।

তারা বলছে, ফলমূল এবং শাকসবজি খোলা বিক্রি করে খাদ্যের অপচয় কমানো যেতে পারে। কারণ মানুষের যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই কিনবে।

ঢাকার কেরানীগঞ্জ তেলঘাট এলাকার এই খালটিতে ফেলা বর্জ্যের মাত্রা এতই বেশি যে তার উপর দিয়ে হেঁটেই প্লাস্টিক সংগ্রহ করছে দুই শিশু। ছবি: কাজী সালাহউদ্দিন রাজু

প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ে পরিবর্তন আনলে তা পরিবেশের ওপরও প্রভাব ফেলব। প্লাস্টিকের তুলনায় কাচের কিছু সুবিধা রয়েছে- যেমন, কাচ অবিরাম পুনর্ব্যবহারযোগ্য। কিন্তু এক লিটারের একটি কাচের বোতলের ওজন হবে ৮০০ গ্রাম, যেখানে প্লাস্টিক বোতলের ওজন হয় ৪০ গ্রাম।

দুধ, ফলের রস, কোমল পানীয়র সব বোতল যদি কাচে বদলে ফেলা হয়, তার পরিবেশগত প্রভাব হবে প্লাস্টিকের চেয়েও ব্যাপক। কারণ একই পরিমাণ বোতল দূরের গন্তব্যে পরিবহন করতে বইতে হবে কয়েকশ গুণ বেশি ওজন। তাতে জ্বালানি খরচ এবং কার্বন নিঃসরণও একই অনুপাতে বাড়বে।

প্লাস্টিক ছাড়া জীবন চালাতে গেলে আমাদের পোশাকের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনতে হবে। ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত টেক্সটাইল ফাইবারগুলোর ৬২ শতাংশ ছিল সিন্থেটিক, যা পেট্রোকেমিক্যাল তৈরি। যদিও তুলা ও শণের মতো অন্যান্য প্রাকৃতিক আঁশ পোশাকের জন্য ভালো বিকল্প হতে পারে, তবে বর্তমান চাহিদা মেটাতে উৎপাদন বাড়াতে গেলে মূল্য দিতে হবে অন্যভাবেও।

বিশ্বে ২ দশমিক ৫ শতাংশ আবাদযোগ্য জমিতে তুলা জন্মায়; কিন্তু ১৬ শতাংশ কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় ওই তুলা চাষের জন্য। এটা কৃষকদের স্বাস্থ্যের জন্য যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি পানি দূষণেরও কারণ। প্লাস্টিক বাদ দিলে দ্রুত পরিবর্তনশীল ফ্যাশনের বদলে টেকসই পোশাকের কথা ভাবতে হবে।

নৌকায় করে ঢাকা সদরঘাট এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদী থেকে ভাসমান প্লাস্টিক সামগ্রী সংগ্রহ করছে এই কিশোরেরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ব্যাপকভাবে সিন্থেটিক প্লাস্টিক আসার আগে জুতা চামড়া দিয়েই তৈরি হত। কিন্তু পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষের অনেক জোড়া করে জুতা রয়েছে। ২০২০ সালে তৈরি হয়েছিল ২০ দশমিক ৫ বিলিয়ন জোড়া জুতা।

শ্যারন জর্জ বলেন, “আমরা এই গ্রহের প্রত্যেক মানুষের জন্য চামড়ার জুতা তৈরি করতে পারিনি.. .সেটা সম্ভবও নয়।”

বিবিসি লিখেছে, দুনিয়ার সব প্লাস্টিক যে অন্য কিছু দিয়ে বদলে দেওয়া সম্ভব হবে না, সেটা স্পষ্ট। কোন প্লাস্টিকগুলো অপ্রয়োজনীয়, পরিহারযোগ্য এবং সমস্যার কারণ, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলসহ বেশ কয়েকটি দেশ সেই চেষ্টা করছে।

এর থেকেও এগিয়ে গিয়ে বাস্তবিক অর্থে কোন প্লাস্টিকগুলো জরুরি, কেবল সেগুলোই ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। কোন প্লাস্টিকগুলো গুরুত্বপূর্ণ, তার একটি ধারণা সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বইয়ে তুলে ধরেছেন যুক্তরাজ্যের কিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার জর্জ।

খাদ্য, আশ্রয় বা ওষুধের মত অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন বিবেচনা এবং প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো বা প্রতিস্থাপনের প্রভাব বিবেচনা করার কথা বলেছেন তিনি। তার ভাষ্য, আমরা দেখতে পারি, কোন প্লাস্টিক জরুরি এবং কোনগুলো ছাড়া আমরা চলতে পারি না।