সেই সুন্দরবনেই এবার দেখা মিলল একটি নয়, একসঙ্গে চারটি রাজকীয় বাঘের। আর তা দেখলেন পেশায় চিকিৎসক, নেশায় ‘বার্ড ফটোগ্রাফার’ নিয়াজ আবদুর রহমান।
দুই দিনের সফরে একসঙ্গে এতগুলো বাঘ দেখে ফিরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শোনালেন সেই গল্প।
“আমি গত বছর সুন্দরবন গিয়েছি, তার আগের বছরও গিয়েছি, কখনও বাঘ দেখিনি।”
বলাবাহুল্য ওই সফরগুলোর বেশিরভাগই ছিল পাখি দেখার জন্য।
“সুন্দরবনে আমি পাখি দেখতে বহুবার গিয়েছি। যতবার সুন্দরবনে গিয়েছি, যতই পাখি দেখেছি, মনের মধ্যে একটা সুপ্ত আশা ছিল- আহা! যদি কখনও বাঘ দেখে ফেলতে পারতাম!”
অথচ এবার, এই মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সহকর্মী চিকিৎসক আর তাদের পরিবার নিয়ে ‘অনেকটা পিকনিকের মতো’ আয়োজনে দেখা মিলল বাঘের।
খুলনা থেকে দ্য ওয়েভ নামের বেশ বড় একটি জাহাজে এবার প্রায় ৭০ জনের একটি দল নিয়ে গিয়েছিলেন ডা. নিয়াজ। শ্যালা নদী ধরে কটকা পর্যন্ত গিয়ে আবার ফেরত আসছিলেন তারা।
“ছিটা কটকা পর্যন্ত যখন ফিরে এসেছি, দুপুর বেলা, ল্যাপটপ নিয়ে বসে বসে তোলা ছবিগুলো তখন গুছাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে শুনলাম- বাঘ, বাঘ, বাঘ দেখা গেছে।”
“তার পরের মিনিট পাঁচেক কী হয়েছে, তার সবটা আমি বলতে পারব না।”
চক্ষু রোগ বিশেষজ্ঞ নিয়াজের ভাষায়, “আমার কাছে এটা অনেকটা ঝাপসা একটা সময়! আমি দৌড় দিয়ে বেরিয়ে গেছি, বাঘ দেখেছি। তিনটা বাঘ তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। তারা রোদ পোহাচ্ছে।”
নিজ অফিসে বসে যখন এই গল্প শোনাচ্ছিলেন নিয়াজ, তখনও বাঘ দেখার উচ্ছ্বাস খেলা করছিল তার চোখে-মুখে।
নিজে তিনটা বাঘ দেখলেও তার সফরসঙ্গীরা পরে বলেছেন, পেছনে ঝোঁপের মধ্যে আরও একটি বাঘ ছিল, যেটা তারা দেখেছেন।
কেমন রোমাঞ্চকর ছিল ওই অভিজ্ঞতা?- নিয়াজ বললেন, বাঘ দেখার উত্তেজনায় ওপরে সারেঙের কক্ষে কেউ একজন নিজের অজান্তেই চাপ দিয়ে বসেন লঞ্চের হুইসেলে। ওই আওয়াজে সম্ভবত চতুর্থ বাঘটি চলে যায়।
“কিন্তু এই তিনটা বাঘ আমাদের যথেষ্ট সময় দিয়েছে। তারপর আমরা যখন ধীরে ধীরে বাঘের কাছাকাছি গিয়েছি, তারা উঠে আস্তে করে বনের ভেতরে চলে যায়।”
বাঘের এমন দেখা মেলা কতটা দুর্লভ?
বাংলাদেশে ওয়াইল্ড লাইফ বা বন্যপ্রাণি বিষয়ে যারা আগ্রহী আলোকচিত্রী তাদের কাছে সুন্দরবনে বাঘের দেখা পাওয়া বা এর ছবি তুলতে পারাটা ‘বিশেষ কিছু’।
ছবি তোলার জন্য সুন্দরবনে ৪০ থেকে ৫০ বার গিয়েছেন আলোকচিত্রী সৈয়দ জাকির হোসেন। স্মৃতি থেকে তিনি বললেন, “এমন ঘটনা অনেক আগে একবার ঘটেছিল। খসরু চৌধুরী পেয়েছিলেন মা বাঘের সঙ্গে কয়েকটি শাবকের ছবি।”
আর, অর্ধশতবারের সফরে স্রেফ দুবার বাঘের দেখা পেয়েছেন জাকির হোসেন। তা-ও ডাঙ্গায় নয়, নদীর পানিতে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান আলোকচিত্রী মুস্তাফিজ মামুন অন্তত ৫০ বারের সফরে বাঘের দেখা পেয়েছেন মোটে তিনবার, আর ছবি তুলতে পেরেছেন কেবল একবার।
“আমি তো তবু একবার ছবি তুলতে পেরেছি, এমন অনেক আলোকচিত্রী আছেন, যারা ৭০-৮০ বারের চেষ্টায় একবারও পাননি সেই মহার্ঘ্য মুহূর্ত,” বললেন মামুন।
এবার একাধিক বাঘ কেন?
পূর্ণ বয়স্ক বাঘ সাধারণত একা থাকে।
সুন্দরবনে বাঘ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন খসরু চৌধুরী, বিশেষজ্ঞ হিসেবে ‘সোয়াম্প টাইগার্স’সহ বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র তৈরিতেও যুক্ত ছিলেন তিনি।
বর্তমানে টরোন্টো প্রবাসী এই আলোকচিত্রী নিয়াজের তোলা বাঘের ছবি এবং ভিডিও দেখে বললেন, এখানে সদ্য তারুণ্যে পৌঁছানো বাঘ রয়েছে।
“সম্ভবত কিছুদিনের মধ্যেই এরা আলাদা হয়ে যাবে এবং নিজ নিজ এলাকা বেছে নেবে।”
তবে, এলাকা বেছে নেওয়ার বিষয়টিও খুব সহজ হবে না কৈশোর পেরোনো এই বাঘেদের জন্য। এলাকার দখল নিয়ে অনেক সময়ই বড় বাঘের আক্রমণে মারা যায় অল্প বয়সী বাঘগুলোর কেউ কেউ।
“সাধারণত বাঘ বাচ্চা দেয় ৩-৫টি। এদের মধ্যে শিশু বয়সেই ২/৩টি মারা যায়। কিন্তু মা বাঘিনী পরিপক্ক হলে আর জঙ্গলে প্রচুর শিকার থাকলে প্রায় সবগুলোই টিকে যায়। পুরুষ বাঘ আড়াই বছরে মেয়ে বাঘ তিন বছর বয়সে নিজের টেরিটোরি তৈরি করে নেয়।”
অস্বাভাবিক নয়, তবে বিরল
সদ্য বড় হওয়া ‘কাব অ্যাডাল্ট’দের মা বাঘিনীর সঙ্গে থাকাটাই স্বাভাবিক বলে জানালেন ড. মনিরুল এইচ খান।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার এই অধ্যাপকের পিএইচডি থিসিসের বিষয় ছিল সুন্দরবনের বাঘের জীবন ও পরিবেশ।
তিনি বলেন, “সুন্দরবনে তো বাঘ সহজে দেখা যায় না, বাঘের দেখা পাওয়াটাই ভাগ্যের ব্যাপার।”
এখন সুন্দরবনে অবস্থানরত মনিরুল টেলিফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সুন্দরবন যেহেতু খুব গভীর বন, বাঘ যদি স্বেচ্ছায় বের না হয় বা খাল পার না হয়, বাঘের দেখা মেলে না। আর কয়েকটি বাঘ একসঙ্গে দেখা তো আরও ভাগ্যের ব্যাপার।”
‘ভাগ্যের’ পাশাপাশি গোটা বিষয়টিকে আশাব্যঞ্জক বলে বর্ণনা করলেন তিনি।
“বাঘ যে সুন্দবনে মোটামুটি ভালো আছে, এই ছবি তার একটি ইন্ডিকেটর।”
একটি ‘পজিটিভ বিষয়’
“যে ছবি ডা. নিয়াজ তুলতে পেরেছেন, সুন্দরবনের বাঘের এর চেয়ে সুন্দর ছবি আমি কখনও দেখিনি,” বললেন আলোকচিত্রী জাকির হোসেন।
তবে সৌন্দর্যের চেয়েও আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।
“বাঘের ভিডিও আমি সামাজিক মাধ্যমে দেখেছি। খেয়াল করবেন, বাঘগুলো কিন্তু ওখানে ঠায় বসেছিল বেশ কিছুক্ষণ। এর মানে হচ্ছে, বাঘ আক্রান্ত বোধ করেনি বা নিজেদের সেখানে নিরাপদ বোধ করেছে।”
এই বিষয়টিকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন ঢাকা ট্রিবিউনের এই প্রধান আলোকচিত্রী।
“এটি খুবই পজিটিভ লক্ষণ।”