এমন হিংস্রতার কারণ বিশ্লেষণের তাগিদ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাতি রক্ষায় আইনি উদ্যোগের সঙ্গে চাই নিয়মিত পর্যবেক্ষণ। শুধু মামলা নয়, প্রয়োজন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
কক্সবাজারের চকরিয়ার হারবাং এলাকায় গত ১৩ নভেম্বর তার চার দিন আগে মাটি চাপা দেওয়া একটি হাতির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ফসল রক্ষার জন্য পেতে রাখা বৈদ্যুতিক ফাঁদে পড়ে ১৫ বছর বয়সী হাতিটি মারা যায়।
গত ৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের সাতকানিয়া এলাকার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের একটি ধানক্ষেত থেকেও উদ্ধার করা হয় একটি হাতির মৃতদেহ। এই হাতিটিকেও বৈদ্যুতিক ফাঁদ পেতে মারা হয়েছিল।
এছাড়া গত ৯ নভেম্বর কক্সবাজার বন বিভাগের ঈদগাঁও রেঞ্জের পূর্ণগ্রাম বিটের আওতাধীন এলাকায় গুলি করে মারা হয় ১২ বছর বয়সী আরেকটি হাতি।
আবাস সঙ্কুচিত হওয়ায় খাবার নিয়ে হাতি আর মানুষের দ্বন্দ্বে একের পর এক এমন মৃত্যু ‘মহাবিপন্ন’ প্রাণিটির জীবনযাত্রাকে আরও বেশি হুমকির মুখে ফেলছে। ছোট হয়ে আসছে হাতির প্রতিবেশ।
বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) আবাসিক প্রতিনিধি রকিবুল আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা অবশ্যই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব আগেও ছিল, থাকবে।
“আগে হাতি মারা গেছে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্বে মানুষ হুড়াহুড়ি করেছে, হাতি মরেছে। কিন্তু এত নৃশংসভাবে হাতি মেরেছে, আগে শুনিনি। মানুষ এত হিংস্র কীভাবে হল?”
হাতি মানুষের দ্বন্দ্বে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আইন শৃঙ্খলা বিষয়ের পুরোটাই বিশ্লেষণ করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
“কেন মানুষ এত ডেসপারেট হয়েছে? এটা কি আর্থিক, এটা কি গভর্নেন্সের বিষয়? নাকি বিনা দ্বিধায় যে চক্র হাতি মারছে তার কিছুই হবে না? অবৈধভাবে বন্দুক রেখেছে, রাষ্ট্রের একটা মূল্যবান প্রাণীকে অবলীলায় মেরে ফেলছে, তোয়াক্কা করছে না। আমি মনে করছি, এটা আরও ডিপার সমস্যা।”
ঠেকানো যাচ্ছে না হাতি হত্যা
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত মারা গেছে ৪৩টি হাতি। যার মধ্যে ১৬টি চট্টগ্রামে এবং বাকিগুলো বান্দরবান ও কক্সবাজারে।
এসব হাতির মধ্যে ১৯টি অসুস্থতাজনিত কারণে, পাঁচটি বার্ধক্যজনিত এবং অন্যগুলো মানবসৃষ্ট কারণে মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া পানিতে ডুবে কিংবা পাহাড় থেকে পড়েও বেশকিছু হাতির মৃত্যু হয়েছে।
বন বিভাগের হিসেব অনুযায়ী, এ তিন বছরে নয়টি হাতি মারা হয়েছে বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদ পেতে। যার মধ্যে চারটি চট্টগ্রামে, একটি বান্দরবানের লামায় ও বাকি চারটি হাতি হত্যা করা হয়েছে কক্সবাজারে।
আইইউসিএন জরিপ অনুযায়ী, ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বন্যহাতির সংখ্যা ছিল ২৬৮টি।
এছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন ৮২টি, চিড়িয়াখানায় তিনটি ও দেশের দুটি সাফারি পার্কে ১১টি হাতি রয়েছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কিছু হাতির প্রজনন হয়েছে বলেও মনে করেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা।
তিন বছরের চিত্র >> ২০১৯ সালে মারা গেছে ১১টি হাতি। যার মধ্যে বান্দবানের লামা ও চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় দুইটি হাতি বৈদ্যুতিক শকে মারা গেছে। কক্সবাজারে একটি পাহাড় থেকে পড়ে এবং বান্দরবানে দুটি হাতি পানিতে ডুবে মারা যায়। এছাড়া পাঁচটি হাতি অসুস্থতাজনিত ও একটি মারা গেছে বার্ধক্যজনিত কারণে। >> ২০২০ সালে মারা গেছে ২০টি হাতি। যার মধ্যে ১০টি অসুস্থতার কারণে ও দুটি বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছে। এছাড়া কক্সবাজারে তিনটি হাতিকে গুলি করে এবং পাঁচটি হাতি বৈদ্যুতিক ফাঁদ পেতে হত্যা করা হয়। >> ২০২১ সালে সাড়ে ১০ মাসে মারা গেছে ১২টি হাতি। যার মধ্যে চারটি হাতির মৃত্যু হয়েছে এ মাসের ৬ থেকে ১৩ নভেম্বরের মধ্যে, যার তিনটিকে হত্যা করা হয়। এবছর মারা যাওয়া হাতিগুলোর মধ্যে চারটি অসুস্থতাজনিত ও দুটি বার্ধক্যজনিত এবং দুটি পাহাড় থেকে পড়ে মারা গেছে। এছাড়া তিনটি বৈদ্যুতিক ফাঁদে এবং একটি হাতিকে গুলি করে মারা হয়েছে। |
সঙ্কট কোথায়?
বনবিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, হাতির কারণে ফসল নষ্ট হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, যার মূল্য আগের চেয়েও বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন সহায়তা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না হাতি হত্যা।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী জানান, বিভিন্ন স্থানে হাতি চলাচলের পথ অবরুদ্ধ হচ্ছে। বন ধ্বংসের কারণে খাবার সঙ্কটে পড়ে ফসলের ক্ষেতে ঢুকে যাচ্ছে হাতিগুলো।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ফসলের ক্ষেত রক্ষায় অনেকে ফাঁদ তৈরি করে হত্যা করছে হাতি।”
তিনি জানান, বিভিন্ন স্থানে উন্নয়ন হচ্ছে, টেকনাফের পাহাড়ি অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গায় রোহিঙ্গা বসতি গড়ে উঠেছে। আবাস সঙ্কুচিত হয়ে খাবার নিয়ে হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব বাড়ছে। মানুষকে বিভিন্নভাবে সচেতনও করা হচ্ছে।
“তবুও হাতির মৃত্যু হচ্ছে। এ জন্য মামলাও হচ্ছে” বলেন এ বন কর্মকর্তা।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের কর্মকর্তা মো. সফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিভিন্ন সময়ে আমরা মামলা করেছি। হারবাং ও সাতকানিয়ার ঘটনায় পাঁচজন ও তিনজনকে আসামি করে মামলা হয়েছে।”
কোনো মামলায় কারো কোনো সাজা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তা নিশ্চিত করতে পারেননি এই বন কর্মকর্তা।
বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক এ এস এম জহির উদ্দিন আকন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বন্যপ্রাণী হত্যা বন্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে।
“হাতি সংরক্ষণে এ মুহূর্তে অন্তত দুটি কাজ করতে হবে। একটি হচ্ছে- বন বিভাগের জমিতে কোনো ফসল চাষ করা যাবে না। আরেকটি হচ্ছে- প্রত্যেকটি ঘটনাতেই মামলা হচ্ছে, আইন অনুযায়ী মামলাগুলো যথোপযুক্ত মনিটরিং করতে হবে।
“মামলা পরিচালনার করার জন্য কাজ করতে হবে, যাতে আসামি পক্ষ আইনের আওতায় শাস্তির আওতায় আসে। হাতি হত্যার কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আমরা দেখতে পাইনি।”
করিডোর সুরক্ষা
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় হাতি চলাচলের ১১টি করিডোর চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের অধীনে চারটি করিডোর- চুনতি-সাতঘর, লালটিয়া-বড়দুয়ারা, সুখবিলাস-কোদালা ও নাড়িচ্ছা-কোদালা।
কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের তিনটির মধ্যে রয়েছে- উখিয়া-ঘুমধুম, তুলাবাগান-পানেরছড়া, নাইক্ষ্যংছড়ি-রাজারপুল।
এছাড়া কক্সবাজার দক্ষিণ বিভাগের অধীনে আছে ভোমরিয়া ঘোনা-রাজঘাট, তুলাতলি-ঈদগড়, পুচাখালি-মেধাকচ্ছপিয়া।
এর মধ্যে চুনতি রেঞ্জে হাতি চলাচলের তিনটি পথের কাছ ঘেঁষে তৈরি হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইন।
আইইউসিএন আবাসিক প্রতিনিধি রকিবুল আমিন বলেন, “এমনিতেই হাতি মানুষের দ্বন্দ্ব বাড়ছে। চলাচলের পথ বন্ধ হচ্ছে। তাদের আবাস দখল করছে, হাতি তো উৎপাত করবেই।
“বনের বাইরে যে দ্বন্দ্ব, তা নিরসনে হাতি ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে হবে। হাতি চলাচলের পথ বাধাগ্রস্ত হলে আরও দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাড়বে।
তিনি বলেন, “হাতি চলাচলের যে করিডোরগুলো রয়েছে তার অনেকগুলোই ফরেস্টের বাইরে। খাস, ফরেস্ট, প্রাইভেট ল্যান্ড রয়েছে। এর রক্ষণাবেক্ষণ কে করবে?
“এজন্য বন বিভাগ একা পারবে না, আমাদের দরকার মাল্টি সেকটরাল অ্যারেঞ্জমেন্ট। রেলওয়কেও হাতি সংরক্ষণ করতে হবে, বনও রক্ষা করতে হবে। সবাইকে এক করতে না পারলে হাতি থাকবে না।”
ফাইল ছবি
দ্বন্দ্ব কমাতে দ্রুত ক্ষতিপূরণ ও সমন্বিত ব্যবস্থার পরামর্শ
চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের কর্মকর্তা মো. সফিকুল ইসলাম জানান, হাতি বংশানুক্রমিকভাবে একই পথে চলাচল করে আসছে। কিন্তু মানুষ এখন পাহাড়ি এলাকায়ও তাদের চাষাবাদ শুরু করেছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এতে করে হাতির প্রতিবেশ নষ্ট হচ্ছে। খাবারের সন্ধানে মানুষের ক্ষেতে যাচ্ছে, আর তা রক্ষায় মানুষ বিভিন্ন ফাঁদ পাতচ্ছে।
“স্বভাবত হাতি সহজেই মানুষের ক্ষতি করে না। যদি তাকে বিরক্ত করা না হয়। কিন্তু লোকজন হাতি নেমে আসা দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এতে ভীত হয়ে হাতি মানুষের ক্ষতি করছে।
“হাতি কোনো ফসলের ক্ষেত নষ্ট করলে কৃষককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। যা আগের চেয়েও বাড়ানো হয়েছে। তবু তারা ফাঁদ পাতচ্ছে এতে মারা যাচ্ছে অনেক হাতি।”
সফিকুল ইসলাম জানান, হাতি রক্ষায় মানুষকে সচেতন করতে কাজ করা হচ্ছে। হাতি লোকালয়ে প্রবেশ করলে তাদের চলাচলের রাস্তায় বাধা সৃষ্টি না করে পটকা ফোটানো, মশাল কিংবা আলো জ্বালিয়ে বা শব্দ করে ভয় দেখাতে বলা হয়।
হাতি মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে ‘সুফল’ নামে একটি প্রকল্পের আওতায় পাহাড়ে বনায়ন করার পাশাপাশি এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমগুলোকে সক্রিয় করা হচ্ছে এবং বনের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
প্রকৃতিরক্ষাকর্মী আইইউসিএন আবাসিক প্রতিনিধি রকিবুল আমিন বলেন, “ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি দীর্ঘসূত্রতা না করে দ্রুত দিতে হবে। তাতে লোকে এতো ডেসপারেট হতো না।
“প্রযুক্তিগত সহায়তায় হাতির চলাচলের উপর নজর রাখা সম্ভব হলে অনেক দ্বন্দ্ব কমানো যাবে। দক্ষিণ ভারতে এ দুটি বিষয়ে সফলতা এসেছে। ক্ষতিপূরণ ও টেকনোলজি ব্যবহার করে এখানেও সংঘাত কমানো সম্ভব।
“মানুষের ক্ষতি হবে, ক্ষতিপূরণ পেয়ে যাবেন। এমন ডেসপারেট হলে তো হাতিগুলো রাখা যাবে না। খুবই শঙ্কার বিষয় এটি। আমাদের এমন একটা বিষয় দরকার- যেখানে অপরাধই হবে না।”