প্রজনন বেড়ে অতিরিক্ত প্রাণীই এখন চিড়িয়াখানার ‘মাথাব্যথা’

ঢাকার জাতীয় চিড়িয়াখানা এক সময় খবরের শিরোনাম হত প্রাণী স্বল্পতার জন্য, মহামারীর মধ্যে লকডাউনে প্রজনন বেড়ে যাওয়ায় এখন অতিরিক্ত প্রাণীই কর্তৃপক্ষের ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Nov 2021, 06:53 PM
Updated : 7 Nov 2021, 06:54 PM

হরিণ ও ময়ূরের চাপ কমাতে এই প্রাণীগুলো বিক্রি শুরু করেছে। অন্য আরও প্রাণী বিনিময় করার চিন্তাভাবনা করছে। বাঘ নিয়ে কী করা যায়, তাও ভাবা হচ্ছে।

চিড়িয়াখানার পরিচালক ডা. মো. আব্দুল লতিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনুকূল পরিবেশ, যত্ন আর ভালো ব্যবস্থাপনায় অন্তত পাঁচ-সাতটি প্রাণির খাঁচা ভরে গেছে আমাদের। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি রয়েছে, এগুলো বিনিময়ের চেষ্টা করছি।

“আর বিক্রি হচ্ছে হরিণ, ময়ূর। সরকারি নিয়ম নীতি মেনে আগ্রহী মানুষ কিনতে চাইলে কিনতে পারে।”

বর্তমানে মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় ১৩৫ প্রজাতির সর্বমোট ৩ হাজার ১৫০টি প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ধারণক্ষমতার বেশি রয়েছে অনেক প্রাণী।

>> জলহস্তী এখন ১৪টি, ধারণ ক্ষমতা ৭টির।

>> ইমু পাখি ৫০টি রয়েছে। ধারণ ক্ষমতা ২০-২২টি।

>> জেব্রা ১০টি রয়েছে। ধারণ ক্ষমতা ৬টির।

>> জিরাফ রয়েছে ১০টি, রাখার ক্ষমতা ৭টি।

>> বাঘ রয়েছে সব মিলিয়ে ১০টি। মাসখানেকের মধ্যে আসবে আরও দুটি বাচ্চা। ধারণ ক্ষমতা ছয়টি।

>> আফ্রিকান ঘোড়ার তিনটি বাচ্চা হয়েছে এবার। সর্বমোট রয়েছে ৯টি। এটাও ধারণ ক্ষমতার বেশি।

>> দক্ষিণ আফ্রিকার প্রজাতি ইম্পালা। এটার সংখ্যা এখন ১৫। ধারণ ক্ষমতা ৬-৭টি।

>> রয়েছে তিনশর বেশি হরিণ। বিক্রির যোগ্য রয়েছে ১০০টির মতো।

>> ময়ূর রয়েছে ৮০টির মতো। অবশ্য বিক্রির কারণে ময়ূর ইতোমধ্যে কমে এসেছে।

জাতীয় চিড়িয়াখানায় জন্ম হয়েছে এই জলহস্তী শাবকের। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ধারণ ক্ষমতার বেশি জলহস্তীর প্রসঙ্গে চিড়িয়াখানার পরিচালক লতিফ বলেন, “এখন এটা মাথা ব্যথা, খাবার দেই কোত্থেকে? মন্ত্রী দায়িত্ব দিয়েছেন সাফারি পার্ক রয়েছে, অন্য কোনো চিড়িয়াখানা রয়েছে তাতে বিনিময় করার।

“নতুবা বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিনিময় করার। কারণ, এটা বিক্রির অনুমতি নেই, আবার কিনবেও না কেউ।”

তিনি জানান, ইমু পাখির খাঁচাও ভরে গেছে। এবার প্রায় ৪০টির মতো ডিম ফুটিয়েছে। “জেব্রা ৬টা রাখতে পারি আমি, এটা ধারণ ক্ষমতা। সেপ্টেম্বরে জিরাফের দুটি বাচ্চা এসেছে; প্রতিটি জিরাফের দাম এক কোটি টাকা। রাখার জায়গা নেই, ভরে যাচ্ছে।”

করোনাভাইরাসের মহামারীর জন্য দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় যেসব প্রাণীর প্রজনন বেশি বেড়েছে তার মধ্যে ইমু অন্যতম। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

সমস্যার দিকটি তুলে ধরে চিড়িয়াখানার পরিচালক বলেন, “ভাবতে হবে এটা একটা চিড়িয়াখানা, এটা ডিসপ্লে সেন্টার, বা খামার নয়। খালি প্রজনন করিয়ে বড় করব, তা তো নয়, তাদের খাবার লাগবে, যত্ন লাগবে, নির্দিষ্ট একটা বাজেট রয়েছে।

“কেয়ারটেকারের বিষয় রয়েছে, রাখার জায়গা লাগবে, ক্যাপাসিটি রয়েছে। সব মিলিয়ে ধারণ ক্ষমতার বাইরে হয়ে গেছে। বাজেট সঙ্কুলান হয় না, আমার লোকবল কম থাকে- এ সমস্যা দেখা দেয়, এ জন্য মাথাব্যথা।”

সমাধানের পথ হিসেবে তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন চিড়িয়াখানার সঙ্গে আলোচনা করে সরকারের অনুমোদন নিয়ে নিজেদের মধ্যে বন্যপ্রাণী বিনিময় করা হবে। সম্ভব হলে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গেও আলোচনার কথা ভাবা হচ্ছে।

তবে চিড়িয়াখানা থেকে সুন্দরবন কিংবা অভয়ারণ্যে এখনই বাঘ, জলহস্তী, জিরাফ, জেব্রা, ইমু পাখির মতো প্রাণী মুক্ত করে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি আসেনি বলে মনে করেন ডা. লতিফ।

“আমরা প্রথমে নেচারে ছাড়ব না। চিন্তা করছি বিনিময়ের। …মন্ত্রী মহোদয় দায়িত্ব দিয়েছেন ঘুরে ঘুরে তাদের সঙ্গে আলাপ করে বিনিময় করতে পারি কিনা দেখব। যদি না পারি দেশের বাইরে গিয়ে ভারতের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করব।”

ময়ূরও বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি করছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। ছবি: সাদ আব্দুল্লাহ

হরিণ-ময়ূর বিক্রিতে সাড়া

চিড়িয়াখানার পরিচালক লতিফ জানান, তাদের কাছে বর্তমানে তিনশরও বেশি হরিণ রয়েছে। ময়ূর রয়েছে ৮০টির মতো। এর মধ্যে বিক্রি করার মতো হরিণ শ’খানেক।

চলতি বছরে প্রায় ৮৩ লাখ টাকার হরিণ এবং ময়ূর বিক্রি করেছে জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে প্রায় ৬৬ লাখ টাকায় ১২৫টি হরিণ এবং প্রায় ১৭ লাখ টাকায় ৬৮টি ময়ূর বিক্রি করা হয়।

আব্দুল লতিফ বলেন, “আমার টার্গেট হলো- ময়ুর, হরিণ এখন ওয়াইল্ড এনিমেল রয়েছে, দুই তিন বছর যদি এখানে কাজ করা যায়, তাহলে গ্রামের বাড়িতে মানুষ যেমন গবাদি পশু রয়েছে তেমনি হরিণ পালন করবে।”

জ্যৈষ্ঠের দুপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানায় গাছের ছায়ায় চিত্রা হরিণের দল। হরিণ বেড়ে যাওয়ায় এখণ বিক্রি হচ্ছে। ছবি: সাদ আব্দুল্লাহ

তার ভাষায়, এটা একটা ‘অবিশ্বাস্য’ কাজ হবে।

“রিসোর্টের মালিক ও শিল্পপতিদের কনভিন্স করেছি- আপনার শিল্পের কর্নারে হরিণ রাখলে শিল্পের মান বেড়ে যাবে, আভিজাত্য বাড়বে, পরিবার, সন্তান ও কর্মীদের বিনোদনের বিষয় হবে।”

৭৫ জন খামারির কাছে হরিণ বিক্রি করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “দামও কমানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে এখন এক জোড়া এক লাখ টাকায় আনা হয়েছে।”

নোয়াখালীর চরে হরিণ ছাড়ার পরিকল্পনাও জানান তিনি।

বিনিময় প্রক্রিয়া

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রাণিসম্পদ-২) এস এম ফেরদৌস আলম জানান, চিড়িয়াখানাটি নিয়ে আলাদা একটা কর্মপরিকল্পনা এবং আগামীতে অতিরিক্ত কিছু প্রাণী বিনিময় করার চিন্তাভাবনাও করছেন তারা। এ নিয়ে পরিচালক বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় ঘুরে ঘুরে তাদের কাছে ‘অফার’ দেওয়ার কথা ভাবছে।

বিনিময় প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক লতিফ জানান, নভেম্বরের মাঝামাঝি চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা, ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক এবং খুলনা অঞ্চলে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য এক সপ্তাহের ট্যুরে যাবেন।

“যদি সম্ভব হয় তাদের সঙ্গে বিনিময় করব। এমন একটা প্রজাতি তাদের বেশি রয়েছে, যেটা আমার কম রয়েছে; অথবা তাদের কম রয়েছে আমার বেশি রয়েছে আরেকটি। বিনিমিয় চুক্তির চেষ্টা করব।”

চিড়িয়াখানায় গণ্ডার।

তিনি বলেন, দেশের ছোট-বড় অন্যান্য চিড়িয়াখানা রয়েছে। ক্যান্টনমেন্টগুলোয় চিড়িয়াখানা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের চিড়িয়াখানা, রাজশাহী সিটির চিড়িয়াখানা, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক রয়েছে।

“তাদের কাছে আফ্রিকান লায়ন যদি থাকে নেব; গন্ডার, ক্যাঙ্গারু, পেলিক্যান পাখি থাকে-এরকম কিছু লিস্টেড প্রাণি আমাদের প্রয়োজন রয়েছে। তাদের এক্সেস থাকলে আমার যেটা এক্সেস রয়েছে তা দিয়ে একচেঞ্জ করতে পারি।

“সাফারি পার্কে যদি গণ্ডার থাকে, যদি একটি দিতে পারে তাহলে আমরা হয়ত একটা টাইগার দিতে পারি। লায়ন হয়তে তাদের বেশি রয়েছে, আফ্রিকান লায়ন সিঙ্গেল রয়েছে তারা যদি দিতে চায় এক্সচেঞ্জ হতে পারে।”

এছাড়া সাউথ আফ্রিকার একটা রাইনো রয়েছে জানিয়ে লতিফ বলেন, “রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বদলে আরেকটা রাইনো পেলে লাভবান হয়। নিজেদের মধ্যে অদলবদল করে ব্রিডিং হলে প্রজন্মটা ভালো হয়।”

বাঘ নিয়ে অন্য চিন্তা নয়

চিড়িয়াখানায় বাঘের সংখ্যা বাড়লেও সুন্দরবন বা প্রকৃতিতে ছাড়ার বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানান জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক।

আব্দুল লতিফ বলেন, “আমাদের ক্যাপটিভ অবস্থায় যেটা আছে সেটা আমরা ফার্স্ট চিন্তা করব দেশের অন্য কোনো চিড়িয়াখার সঙ্গে বিনিময় করতে পারি কি না। নেক্সট চিন্তা করব দেশের বাইরে কারও সঙ্গে চুক্তি করে বিনিময় করা যায় কি না।

“নেচারে ছেড়ে দেওয়ার কথা পরে চিন্তা করব। নেচারে ছেড়ে দিলেই যে খুব ভালো হবে, তা নয়, হয়ত শিকারির কবলে পড়বে, না হয় পাচারকারীর কবলে পড়বে।”

তিনি জানান, এখনই সুন্দরবনের কথা ভাবা হচ্ছে না। চিড়িয়াখানায় রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গ্রোথ ভালো। এখানে বন্দি অবস্থায় প্রজননক্ষম রয়েছে। আফ্রিকান টাইগার যেটা, সেটা অতটা ভালো না। …

“সাফারি পার্ক অনেকটা নেচারের কাছাকাছি অবস্থা। তাদের পরিবেশটা অনুকূল করতে হয়। তাদের স্বাস্থ্যসম্মত অনুকূল পরিবেশ না থাকলে, রোগ থাকলে, ওজন বেশি হলে প্রজননে আসবে না।”

মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ঢাকায় বাঘ রয়েছে সব মিলিয়ে ১০টি। এর মধ্যে ৫টি পুরুষ, ৫টি স্ত্রী। চারটি করে আটটি রয়েছে বয়স্ক আর বাচ্চা দুটি। নভেম্বরে-ডিসেম্বর আরও দুটি বাচ্চা আসছে। এছাড়া রংপুরে বাঘ রয়েছে ৩টি, চট্টগ্রামে ১২টি, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে ১০টি।

বঙ্গবন্ধুর সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমান জানান, ২০১৮ সালের পর এখানে বাচ্চা নেই বাঘের। ১০টি বাঘ রয়েছে। এরমধ্যে দুটি আড়াই বছরের মতো বয়স হয়েছে। বাকিগুলো বয়স্ক।

“এখানে রয়েছে আফ্রিকান বাঘ, তাদের নেচারে ছাড়ার প্রয়োজনও নেই। রয়েল বেঙ্গল হলে থাকতে পারত। দেশি প্রজাতির বন্যপ্রাণী যেগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে বা হুমকির মুখে বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে সেগুলো কনজারভেশনের চেষ্টা করা হয়।”

তিনি জানান, নীল গাই, ময়ুর, সাম্বার, মায়া হরিণ এগুলো প্রকৃতিতে ছাড়া যাবে। তবে আফ্রিকান টাইগার কিংবা লায়ন সেসব পরিবেশে মুক্ত করে দেওয়া যাবে না।

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি কিউরেটর ও চিকিৎসক শাহাদাত হোসেন শুভ জানান, চট্টগ্রামে সব মিলিয়ে ১২টি বাঘ রয়েছে; এরমধ্যে ৬টি রয়েছে বাচ্চা।

“আমরা আরও সম্প্রসারণের চেষ্টায় রয়েছি। আমাদের টার্গেট বাঘের সংখ্যা ২০টিতে নিয়ে যাওয়া। যে জায়গা রয়েছে, তা বড় করা হবে। টার্গেট হচ্ছে বাংলাদেশের মধ্যে খুব ভালো একটা টাইগার কনজারভেশন, সেটা হোক চিড়িয়াখানা।”

তবে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প নেওয়ার মাধ্যমে বাঘ পুনর্প্রবর্তন করে সুন্দরবনে বাঘ ছাড়া সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।