বদলে যাওয়া জলবায়ু কোন ভবিষ্যত আনছে শিশুর জন্য?

ঘূর্ণিঝড়ে ঘর হারানো যে শিশুটি পরিবারের সঙ্গে উপকূলীয় গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে টিকে থাকার আশায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কথা সে কখনও শোনেনি।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Nov 2021, 06:11 PM
Updated : 2 Nov 2021, 06:11 PM

কিন্তু সেই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবেই বাংলাদেশে ১ কোটি ৯০ লাখের বেশি শিশুর জীবন ও ভবিষ্যত হুমকির মুখে পড়ছে বলে ধারণা দিয়েছে ইউনিসেফ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কম বয়সীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; অন্ধকার এই যাত্রায় নিরাপদ থাকছে না গর্ভের শিশুও।

বাংলাদেশে শিশুদের সামগ্রিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে জলবায়ুর বহুমুখী পরিবর্তন। শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সময়টাতেই স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা এবং নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ছে শিশুরা।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ধাক্কা সামলাতে সরকার প্রশমন আর অভিযোজনের নানামুখী পরিকল্পনা নিয়েছে। তার সঙ্গে শিশুদের জন্যও বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও বুধবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে শিশুদের ‘চিন্তাধারাও’ যোগ করা জরুরি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে নেতৃত্ব দিতে পারে।

যেভাবে বিপদ আসছে

শিল্প ও পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে শক্তি তৈরির সময় বাতাসে মেশে বিভিন্ন কার্বন গ্যাস, এর বেশিরভাই কার্বন ডাইঅক্সাইড। এসব গ্যাস সূর্যের আলো থেকে তাপ ধরে রাখে। ফলে বাড়তে থাকে পৃথিবীর তাপমাত্রা।

এই বাড়তি তাপমাত্রাই বদলে দিচ্ছে জলবায়ু, এক দিনে বরফ গলে যাচ্ছে, আরেক দিকে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। চরম আবহাওয়া ডেকে আনছে মৃত্যু আর ধ্বংস।

জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিপর্যয় এড়াতে রোববার স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে কপ-২৬ সম্মেলনে বসেছেন বিশ্ব নেতারা। সম্মেলনে ধ্বংসের হাত থেকে এই পৃথিবীকে বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দাবি করছেন পরিবেশবিদরা।

পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক ডা. লেলিন চৌধুরী বলছেন, বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা সত্যি হলে বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে।

“সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেলে সুন্দরবনের একটি অংশসহ উপকূলবর্তী কিছু অঞ্চল ডুবে যাবে এবং মধ্যবর্তী বাংলাদেশে লবণাক্ত পানির আগ্রাসন ঘটবে। এর প্রভাবে আমাদের পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান- দুটোরই ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে। পরিবেশ বিপর্যয়জনিত যে অসুখ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ- এটি জনস্বাস্থ্যকে নাজুক অবস্থায় নিয়ে যাবে।”

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, লবণাক্ততা বেড়ে গেলে শস্য উৎপাদনে তার প্রভাব পড়বে। মানুষ তখন বিকল্প খাদ্যের দিকে যাবে। তাতে পুষ্টির ঘাটতি তেরি হওয়ার ঝুঁকি থাকবে।

এনভায়রমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন- এসডো’র সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন শীতকালেও তাপমাত্রা বেশি থাকছে। খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

“এভাবে চলতে থাকলে বড় ধরণের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। বন্যা প্রাকৃতিকভাবেই তিন বছর পর পর হয়; কিন্তু আমরা গত চার-পাঁচ বছর ধরে দেখছি প্রতি বছরই বন্যা হচ্ছে। বন্যার সময়টাও পরিবর্তন হচ্ছে।

“গত মাসে উত্তরাঞ্চলে বন্যা হয়েছে। যদিও বলা হচ্ছে, আপস্ট্রিমে বাঁধের গেইট খুলে দেওয়ায় পানি এসেছে। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে এই পানিটা এসেছে হিমালয় থেকে। তার মানে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াতে বরফ গলেছে বেশি। তখন পানিটা অসময়ে চলে এসেছে।”

শাহরিয়ার হোসেন বলেন, বন্যা, ঘূণিঝড়, খরার মতে দুর্যোগ মানুষের জীবনধারণের ওপর বেশি প্রভাব ফেলে, মানুষের টিকে থাকার অবলম্বন ভেঙে পড়ে, মাইগ্রেশন বাড়ে। জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের উদ্বেগও তাই বেশি।

“ভিটামাটি চলে গেলে সে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যায়। দক্ষিণাঞ্চল থেকে প্রতি বছরই মানুষ অন্য শহরে চলে যাচ্ছে। এটাও মাইগ্রেশন, কিন্তু আমরা এটাকে গণনা করছি না।”

ফাইল ছবি

শিশুদের বিপদ যেখানে

এসডো’র সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন যেভাবে সামাজিক সমস্যাগুলোকে প্রকট করছে তাতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়ছে শিশুরা।

“বাস্তুচ্যুত হলে জীবিকার জন্য বাধ্য হয়ে একটা শিশুকে কাজে ঢুকতে হচ্ছে। পরিবারের সবাই মিলে আয় করেই চলার চেষ্টা করে। একটা মেয়েকে তখন পরিবারে বোঝা মনে করা হয়, তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।”

জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ ২০১৯ সালের এপ্রিলে এক প্রতিবেদনে জানায়, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভাঙন, খরাসহ অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয় বাংলাদেশে ১ কোটি ৯০ লাখের বেশি শিশুর জীবন ও ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলছে।

বিশ্বজুড়ে শিশুদের উন্নয়নে বিভিন্ন দেশের যে অর্জন গত কয়েক দশকে হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা ম্লান হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দু’ভাবেই মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পুষ্টিহীনতার মুখে পড়বে।

“এতে শিশুরা যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। গর্ভের শিশু এবং গর্ভবতী মায়েদের বিষয়ে বলাই বাহুল্য।”

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যেহেতু পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাবে, তখন বিশুদ্ধ পানির অভাব পড়বে- এতে সংক্রামক ব্যাধি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশুদ্ধ পানি না হলেই পেটের পীড়ায় ভুগবে। খাদ্যবাহিত রোগ আসবে।

“তাপমাত্রা বাড়লে মশাবাহিত ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া বেড়ে যাবে। বৃষ্টির সময়ে ঠাণ্ডা বা ঠাণ্ডার সময়ে বৃষ্টি হলে হাঁচি-কাশির মাধ্যমে যে রোগগুলো ছড়ায় সেগুলো ছড়াবে। মলমূত্র, স্পর্শের মাধ্যমে রোগবালাই ছড়াবে।”

হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক লেলিন চৌধুরী বলেন, “যে সময়টাতে মানুষ বিকাশ প্রাপ্ত হয়, সেই বয়সটাই শিশু বয়স। নিঃসন্দেহে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে বহুমুখী পরিবর্তনগুলো হচ্ছে, সেটা থেকে শিশুরাও রক্ষা পাবে না।”

সমাজে নারী ও শিশুরাই ‘সবচেয়ে ভালনারেবল’ হওয়ায় তাদের ওপরই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশি পড়বে বলে মনে করেন নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।

তিনি বলেন, “আমরা যেসব শিশুদের কাজ করতে দেখছি, শিশুশ্রমে দেখছি, তাদের অনেকেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে। এতে ভীষণভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয়।”

সেজন্য জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় পরিকল্পনার ক্ষেত্রে শিশুদের বিষয়টি আলাদা করে বিবেচনায় নেওয়ার তাগিদ দেন মালেকা বানু।

ফাইল ছবি

কিছুই করার নেই?

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান- আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন মনে করেন, ব্যক্তিগত পর্যায়ে উদ্যোগ নিয়ে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে শিশুদের সুরক্ষিত রাখা যাবে না।

“সামাজিক ও জাতীয় পর্যায়ে সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। একা এটা করা সম্ভব না।”

আর এসডোর শাহরিয়ার হোসেন বলছেন, প্রাকৃতিক এই প্রক্রিয়াকে একা কোনো দেশই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। সেজন্য বাংলাদেশকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বিত কার্যক্রম চালানোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

“সার্কের মত আঞ্চলিক সংস্থাকে কার্যকর করে ব্যবস্থা নিলে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে সক্ষম হব।”

যেসব কারণে দূষণ বাড়ছে, সেগুলো নিয়ন্ত্রণের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, “বায়ু, মাটি, পানিদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। টক্সিক কেমিকেলের ব্যবহার সহনীয় মাত্রায় রাখলে সেটা পরিবেশের ক্ষতি করবে না। এগুলো নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে।”

পরিবর্তিত বাস্তবতায় খাপ খাওয়ানোর জন্য জলবায়ু অভিযোজনের পথ খোঁজার পরামর্শ দিচ্ছেন শাহরিয়ার।

“এর মধ্যেও কীভাবে বাঁচা যায়, সেটা আয়ত্ত করতে হবে। এই আবহাওয়ায় কী ধরনের ফসল জন্মাবে, সেদিকে নজর দিতে হবে। পানির মধ্যেও যেসব ফসল জন্মায়, সেদিকে যেতে হবে। তাহলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।”

আরও পড়ুন