সুখস্মৃতির সিংহ নদী এখন দুঃখই জাগায়

“এখানে সিংহ নদীটা কোথায়?” প্রশ্ন শুনে কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিলেন ইউসুফ খান। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “হ হ, সিং নদীটা আছে, অনেকদিন পর কেউ নদীটার কথা জিগাইল। সামনে আউগ্গাইলেই পাইবেন।”

গোলাম মর্তুজা অন্তু জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Sept 2021, 06:19 PM
Updated : 25 Sept 2021, 06:19 PM

নিজের দোকানে বসে সিংহ নদীর কথা বলতে বলতে স্মৃতিকাতর হয়ে যান ৬২ বছরের ইউসুফ খান।

“ওই সিং নদী দিয়াই নৌকায় আমরা ঢাকা যাইতাম। দুই ঘুন্টি বাদাম দিয়া পাট বোঝাই গয়না নাও এই নদী দিয়া সোয়ারীঘাট যাইত। উই সিঙ্গাইর, পাড়াগ্রাম থিকা ধান-পাট এদিক দিয়াই নৌকায় যাইত।”

ঢাকার কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া ইউনিয়নে ফতেনগর এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে জানা যায় সিংহ নদীর স্মৃতিগাথা।   

একাত্তরে ইউসুফ খানের বয়স ছিল ১২ বছর। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি বাহিনী কেরানীগঞ্জেও ঢুকতে শুরু করে। তার পরিবার তখন নৌকা করে ওই সিংহ নদী পথেই পালিয়েছিল।  

সবশেষ ২০০০ সালে বর্ষায় সিংহ নদী দিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বছিলা পর্যন্ত গিয়েছেন বলে জানালেন ইউসুফ খান।

সিংহ নদীর কথা বলতে বলতে স্মৃতিকাতর হয়ে যান ইউসুফ খান। ছবি: গোলাম মর্তুজা অন্তু

ষাটোর্ধ্ব এই দোকানির বাতলে দেওয়া পথ ধরে পূর্ব আকছাইলে খাসের ঘাট গ্রামে গিয়ে দেখা মেলে সিংহ নদীর। বর্ষার পর শরতের যখন তখন বৃষ্টিতেও নদীতে নেই স্রোত। নদীর অনেক অংশ প্রায় ঢেকে ফেলেছে কচুরিপানা। নদীর দুই পাড়কে যুক্ত করেছে একটি ছোট কালভার্ট; আর এর একেবারে গা ঘেঁষে উঠেছে তিন তলা স্থাপনা।

কালভার্টের পাড়েই পাওয়া গেল মধ্য বয়সী হোসেন আলীকে। ১৭ বছর সৌদি আরবে ওয়েল্ডার হিসেবে কাজ করছেন। গত বছর মহামারীতে দেশে এসে আটকা পড়েন। এখন আবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ফেরার।

এক সময় হোসেন আলীর বাড়ি ঘেঁষেই বয়ে যেত সিংহ নদী। এখন তার বাড়ি আর নদীর মাঝ দিয়ে রাস্তা করা হয়েছে।

“আগে সন্ধ্যার দিকে কলাতিয়া বাজার থেকে সবজিবোঝাই নৌকা ছেড়ে যেত ঢাকা সোয়ারীঘাটে। ভোরবেলায় সেই নৌকা সোয়ারীঘাটে সবজি নামিয়ে আবার ফিরে আসত। ছইওলা যাত্রীবাহী নৌকাও চলত। নৌকাতেই অভ্যস্ত ছিল এখানকার জীবন,” বললেন তিনি।

সিংহ নদীর পাড়ে হোসেন আলী। ছবি: গোলাম মর্তুজা অন্তু

হোসেন আলীর প্রতিবেশী হলেন জাহিদুল ইসলাম। তার প্রয়াত বাবা ঈমান আলী আশির দশক থেকে সবজির ব্যবসা করতেন। প্রতিদিন এই সিংহ নদী দিয়ে সবজির নৌকা নিয়ে ঢাকায় যেতেন।

নিজেও সবজি ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম বললেন, তার বাবা নৌকা নিয়ে চকোলিয়া, টাকিমারা, শাওরাইল এসব এলাকা থেকে সবজি সংগ্রহ করে নিয়ে আসতেন। তারপর সেই নৌকাতেই সোয়ারীঘাটের উদ্দেশে রওনা হতেন।

“সিংহ নদী হয়ে ধলেশ্বরী ধরে ভেসে চলত নৌকা; এরপর বুড়িগঙ্গা। দৌলতকান্দি, গোয়ালখালি, খোলামুড়া, বামনশুর হয়ে নৌকা সোয়ারীঘাটে ভিড়ত। পরের দিকে শুকনো মৌসুমে নদীতে আর নৌকা চালানোর পানি থাকত না। এরপর ধীরে ধীরে নদী শুকিয়ে একেবারে নালায় পরিণত হল।”

কলাতিয়ার সিঙ্গাশুরে তিন রাস্তার মোড়েই আব্দুস সালামের মোটর গ্যারেজ। এর ঠিক পেছনেই সিংহ নদী। হঠাৎ বৃষ্টিতে গ্যারেজে আশ্রয় নিলেন রফিকুল ইসলাম (৫৮)।

জীবনের অর্ধেক সময় সৌদি আরবে কাটিয়ে আসা রফিকুল বলেন, “মাঝখানে তো সিংহ নদীতে পানিই আসত না। বর্ষাতেও নদীতে ঝিরঝির করে নালা বইত।

“তবে গত কয়েক বছর ধরে ধলেশ্বরীর ভাঙনে নদীতে একটু পানি আসছে। এখন যে পানি আছে সেটা আবার শুকনো মৌসুমে থাকবে না।”

আকছাইল এলাকায় সিংহ নদী গর্ভে গড়ে তোলা হচ্ছে পাকা স্থাপনা। ছবি: গোলাম মর্তুজা অন্তু

সিংহ নদীতে মাছ ধরার স্মৃতি এখনও মনে করতে পারেন কলাতিয়া কলেজের উপাধ্যক্ষ মিজানুর রহমান (৫২)।

বরশি বা ঝাঁকি জালে মাছ ধরার সেসব কথা টেনে তিনি বলেন, “বাড়ির নারীরা সিংহ নদীতে বরশি ফেলে চার কেজির আইর মাছও ধরেছেন। কয়েকবার ঝাঁকি জালের খ্যাপ মারলেই খলা ভরে উঠত ছোট মাছে।”

মিজানুর রহমানের স্মৃতির সিংহ নদী এক স্রোতস্বিনী প্রবাহ।  

“দুইশ-তিনশ মণ ধান নিয়ে নৌকাগুলো সিংহ নদী হয়ে সোয়ারীঘাট যেত। বর্ষায় স্রোতের এমন টান থাকত যে দুই মাল্লা, এক মাঝি মিলেও নৌকা তীরে ভেড়াতে পারত না।”

কলাতিয়া কলেজের  এই শিক্ষক বলেন, “শনি ও বুধবার পাড়াগ্রাম হাট ছিল। নৌকায় করে আনাজপাতি আসত। হাটুরেরাও নৌকাতেই যাতায়াত করত।

শীর্ণ হয়ে খালের ধারায় বইছে এখন সিংহ নদী। ছবি: গোলাম মর্তুজা অন্তু

“পরের দিকে শুকনো মৌসুমে নৌকা চলত না। তখন এখানকার লোকজন হেঁটে রুহিতপুর গিয়ে সেখান থেকে ‘মুড়িরটিন’ বাসে জিনজিরা গিয়ে নামত। তারপরে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে ঢাকা।”

নদীর এভাবে মরে যাওয়া মানুষকে জীবিকার সংকটে ফেলে জানিয়ে মিজানুর রহমান বলেন,  “এই নদীটা এই অঞ্চলের মানুষের জীবন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মিশে ছিল।

“২০০০ সালের পরে হঠাৎ করে অপরিকল্পিত সড়ক, কালভার্ট ও বাঁধ নির্মাণ হল এলাকাজুড়ে। আর তাতেই নদীটা মরে নালা হয়ে গেল। নদী মরে গেলে কি সভ্যতা টেকে? এই জিনিসটাই তো আমাদের হর্তাকর্তারা বোঝেন না।”

সিংহ নদীর কী হবে?

কেরানীগঞ্জ উপজেলার সরকারি ওয়েবসাইটে এ অঞ্চলের নদী পরিচিতিতে সিংহ নদীর হদিস নেই। সেখানে উল্লেখ রয়েছে উপজেলার দুটির নদীর কথা; বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী। তবে ধলেশ্বরী নদীর পরিচিতিতে গিয়ে সিংহ নদীর কথা এসেছে ওয়েবসাইটে।  

ধলেশ্বরীর শাখা নদী হিসেবে শুরু হয়ে কেরানীগঞ্জের জাজিরায় আবারও ধলেশ্বরীতে মিলিত হয়েছে সিংহ নদী। গত প্রায় চার দশক ধরেই নদীটি ধীরে ধীরে শুকিয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে দখলদারদের তৎপরতা।

সিংহ নদী নিয়ে কলাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আবদুল মোতালেব বিশেষ কোনো তথ্য দিতে পারেননি। কার্যালয়ে পাওয়া গেল না চেয়ারম্যান তাহের আলীকেও।

তবে পরিষদে সচিবের কক্ষে কাজে আসা স্থানীয় নারী পারুল বেগম বলেন, তারা ছোটবেলা থেকেই ধীরে ধীরে নদীটাকে শীর্ণ হয়ে যেতে দেখেছেন।

“এখন ওটাকে আর নদী বলে মনেই হয় না। কোথাও কোথাও দখলের কারণে নদীর অস্তিত্বই বোঝা দায়।”

কচুরিপানায় ভরা নদীগর্ভ। ছবি: গোলাম মর্তুজা অন্তু

রুহিতপুর, বাঘাসুর, রামেরকান্দা, গোয়ালখালী, বটতলী, পাইনারচর, চান্দেরচর, নয়াগাঁওয়ের কয়েকটি জায়গায় নদীটিকে খুঁজে পাওয়া যায় না বলছেন অনেকেই।

স্থানীয় সংসদ সদস্য (ঢাকা-৩) ও প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ২০১৮ সালের নির্বাচনী প্রচারে উপজেলার ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা ও সিংহ নদী রক্ষায় সম্ভাব্যতা যাচাই করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন।

স্থানীয়রা বাস্তবে এই নদী উদ্ধারে কোনো উদ্যোগ দেখছেন না বলে উদ্বেগ জানালেও কেরানীগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেদি হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নদী বাঁচাতে স্থানীয় সাংসদ আন্তরিক।

“আইন অনুযায়ী নদীগর্ভ থেকে অবৈধ দখলদারদের সরাতে প্রশাসনের উদ্যোগ চলমান থাকবে। নদীগুলোকে সংরক্ষণের জন্য সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে যাবে প্রশাসন।”