শকুনকে চিড়িয়াখানায় টিকিয়ে রাখাও এখন কেন মুশকিল?

বাংলাদেশে বিলুপ্তির পথে থাকা শকুনকে চিড়িয়াখানায় সংরক্ষণের উপায়ও এখন খুঁজে পাচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।

সাবিকুন্নাহার লিপিসাবিকুন্নাহার লিপিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 May 2021, 03:34 AM
Updated : 16 May 2021, 10:25 AM

দেশে কয়েক যুগ আগেও গ্রামেগঞ্জে যেখানে সেখানে উড়তে দেখা যেত এই প্রজাতির পাখিটিকে। বাড়ির আনাচে কানাচে থেকে মুরগির বাচ্চা ছোঁ মেরে নেওয়া ছিল নিত্য ঘটনা। মাঠে গরু মরে পড়ে থাকলে ঝাঁক বেঁধে নামত শকুনের দল।

এই পাখিটির বিচরণ দর্শন এখন দুর্লভ হলেও ঢাকার জাতীয় চিড়িয়াখানায় গেলে তা দেখার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে আসা সেই শকুনগুলোর প্রজননে সক্ষমতা না থাকাটা দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক আব্দুল লতিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শকুন আসলে বিলুপ্তপ্রায়। আমাদের চিড়িয়াখানা স্থাপনের উদ্দেশ্য যে শুধু বিনোদন তা তো নয়; আমরা সংরক্ষণও করি। কিন্তু নতুন করে যে শকুন আনব, দেশের কোথাও তো নাই।”

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, বিভিন্ন পদক্ষেপের পরও এখানকার শকুনদের প্রজনন সক্ষমতা না আসায় চিড়িয়াখানা শকুনশূন্য হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।

আর দেশে শকুন বিপন্ন হয়ে পড়ায় নতুন করে এই পাখিটিকে এনে সংরক্ষণ করার উদ্যোগও নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

মিরপুর চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখা যায়, বয়সের ভারে ন্যুব্জ শকুনদের কোনটা আবদ্ধ খাঁচায় চুপচাপ বসে আছে আবার কোনটা ডানা ঝাপটিয়ে উড়ার চেষ্টা করছে।

ঢাকার জাতীয় চিড়িয়াখানায় সিনোরাস প্রজাতির একটি শকুন।

১৯৭৯ সালে মিরপুর চিড়িয়াখানায় প্রথম শকুন সংরক্ষণ শুরু হয়। তিনটি শকুনের মাধ্যমে সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছিল কর্তৃপক্ষ। পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষের হাতে ধরা পরা আরও চারটি শকুন এখানে আসে।

২০১৬ সালে বার্ধক্যজনিত কারণে একটি পুরুষ শকুন মারা যাওয়ার পর এখন টিকে আছে ছয়টি।

এর মধ্যে বেঙ্গল প্রজাতির কালো ও সাদা মিশ্র রংয়ের চারটি শকুন রয়েছে, যাদের বসবাস বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

কালো রংয়ের সিনোরাস প্রজাতির দুটি শকুন রয়েছে, যাদের বিস্তার এশিয়া ও ইউরোপ অঞ্চলে।

তবে এই দুই প্রজাতির শকুনই এখন দেশে বিলুপ্তির পথে।

সাধারণত বেঙ্গল প্রজাতির শকুনের গড় আয়ু ৩৫ থেকে ৪০ বছর আর সিনোরাস প্রজাতিরটি বাঁচে ৩৯ বছর।

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, বর্তমানে সেখানে থাকা সব শকুনের স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে।

এখানে ‍তিনটি স্ত্রী ও তিনটি পুরুষ শকুন রয়েছে, তবে তারা একবারও প্রজনন করেনি।

বেঙ্গল প্রজাতির শকুন মার্চ থেকে অক্টোবরে শিমুল, বট এসব গাছে বাসা বেঁধে অক্টোবর মাসে একটি করে ডিম পারে। সেই ডিম ফুটে বাচ্চা হতে ৪০ থেকে ৪৫ দিন সময় লাগে।

আর সিনোরাস প্রজাতির শকুনের প্রজননকাল জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত। সিজনে তারা দুটি ডিম দেয়। ৫০ থেকে ৫৬ দিন সময় লাগে সেই ‍ডিম ফুটে বাচ্চা হতে।

এদের প্রজনন সক্ষমতার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তা কাজে আসেনি বলে জানান চিড়িয়াখানার পরিচালক আব্দুল লতিফ।

তিনি বলেন, “প্রজনন বিষয়টা নেচারাল। তারপরও যা পদক্ষেপ নেওয়ার নিয়েছি। যেমন তার কমফোরেটেবল, খাদ্যাভ্যাস, সেক্সুয়াল সক্ষমতা যাতে আসে সেজন্য আমরা কিছু খাবার এবং ভিটামিন দিয়েছি। তারপরও এটা আসে না।

“এরা তো বনে জঙ্গলে থেকে অভ্যস্ত। তাকে যখন খাঁচায় নিয়ে আসি তখন তাদের পরিবর্তন আসে। এখানে কিছু প্রাণি আছে তাদের প্রজনন সফল, কিন্তু কিছু প্রাণির তো সেভাবে প্রজনন হচ্ছে না।”

ঢাকার জাতীয় চিড়িয়াখানায় খাঁচায় বন্দি বেঙ্গল প্রজাতির একটি শকুন।

জাতীয় চিড়িয়াখানার জু অফিসার বাহারুল ইসলাম তালুকদার মনে করেন, আবদ্ধ অবস্থায় থাকার কারণেই চিড়িয়াখানার শকুনদের প্রজনন হয়নি।

তিনি বলেন, “ওদের উড়ার জন্য যে জায়গা প্রয়োজন সেটা তো আমাদের খাঁচায় সম্ভব না। প্রজননের জন্য বড় জায়গা, বনভূমি, প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রয়োজন এসব তো চিড়িয়াখানায় সম্ভব না।”

তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ধারালো থাবা আর ঘ্রাণ শক্তিহীন এই পাখি বর্তমানে অতি বিপন্ন হলেও উত্তরাঞ্চলে এদের দেখতে পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন বাহারুল ইসলাম তালুকদার।

“একটা অঞ্চল ধরে সেখানে তাদের যে পরিবেশ, খাবার দরকার সে ব্যবস্থা করে তাদের বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানো যায়।”

চিড়িয়াখানার পরিচালক আব্দুল লতিফ মনে করেন, অন্যান্য কারণের পাশাপাশি মানুষের সচেতনতা বাড়াও শকুন বিলুপ্তির কারণ হিসেবে আসছে।

তিনি বলেন, “মরা গরু খেয়ে এরা অভ্যস্ত। আগে দেখতাম কোথাও গরু মরলে শকুন এসে খাওয়া দাওয়া করে। এখন তো গ্রামেগঞ্জে আর শকুন ওভাবে দেখা যায় না। কারণ গরু মরে ঠিকই, কিন্তু সেটা পুঁতে ফেলা হয়।

“এখন তাদের খাবারের অভাব হয়ে গেছে। খাবারের অভাব হয়ে গেলে তো তাদের টিকে থাকাটা কষ্টকর হয়ে যাবে। তারপরও এটা যেহেতু জাতীয় চিড়িয়াখানা, সেদিক বিবেচনায় আমরা সংরক্ষণ করে রাখছি।”

খাবার হিসেবে চিড়িয়াখানার শকুনদের দিনে ৫০০ গ্রাম করে গরুর মাংস দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।