কেশবপুর সম্প্রীতি মন্দির কমিটির সভাপতি ষাটোর্ধ্ব সুন্দর সাহা থাকেন সাহাপাড়ার। এক সময় সেখানে বাড়িতে বাড়িতে প্রচুর ফলজ গাছ ছিল। হনুমানেরা সেসব গাছ থেকে ফল খেত, গৃহস্থদের তাতে আপত্তি থাকত না। গাছের ফল আর মানুষের দেওয়া খাবারেই চাহিদা মিটে যেত বলে হনুমানরা অযথা উৎপাত করত না।
“কিন্তু কিছুই তো আর আগের মত নেই। এলাকায় গাছ গেছে কমে, চারদিকে অনেক ভবন হয়েছে। তার মধ্যে এসেছে মহামারী, অভাবে পড়ে অনেকে বাগানের বা বাড়ির গাছ কেটে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এই হনুমানরা তাহলে যাবে কোথায়?”
কালোমুখো হনুমানগুলো এখন বাড়ির ছাদে, টিনের চালে দাপাদাপি করে, মানুষও বিরক্ত হয়। হনুমানদের খাবার আর আশ্রয় দুটোরই অভাব।
সুন্দর সাহা বলেন, “লকডাউনের মধ্যে হনুমানগুলোর খাবারের অভাব প্রকট হয়ে গিয়েছিল। এখন লকডাউন না থাকলেও অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি, কারণ মানুষেই অভাবে পড়েছে; নিজে খাবে, না হনুমানদের খাওয়াবে?”
প্রাইমেট বর্গের এই প্রাণীগুলোকে স্থানীয়রা বলেন ‘কালোমুখো হনুমান’। বৈজ্ঞানিক নাম ‘সেমনোপিথেকাস এনটেলাস’ Semnopithecus entellus। দলবদ্ধ হয়ে চলাচল করা এই প্রাণী ‘নর্দান প্লেইনস গ্রে লেঙ্গুর’ নামেও পরিচিত।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচারের (আইউসিএন) লাল তালিকায় কালোমুখো হনুমানকে রাখা হয়েছে ‘লিস্ট কনসার্ন’ ক্যাটাগরিতে। হনুমানের এই প্রজাতি ভারতেই বেশি দেখা যায়, সেখানে অনেকের কাছে এটি ‘পবিত্র’ প্রাণী। তবে ভারতেও এর সংখ্যা দিন দিন কমছে।
যশোরের কেশবপুর অঞ্চলে এই হনুমান মানুষের কাছাকাছি বাস করছে কয়েকশ বছর ধরে। মহামারী শুরুর পর লকডাউনের সময় খাবারের সঙ্কটে মানুষের বাড়িতে হনুমানের হানা দেওয়ার ঘটনা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার জন্ম দেয়।
তার আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে হনুমানদের একটি দল কেশবপুর থানা ঘেরাও করেছিল। মারধরে আহত শাবককে নিয়ে তারা থানায় অবস্থান নিয়েছিল, যা সে সময় সংবাদের শিরোনাম হয়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এদের জীবনযাত্রা কীভাবে পাল্টে গেছে, তা জানা গেল কেশবপুর পৌরসভার মেয়র রফিকুল ইসলাম মোড়লের কথায়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা ছোটবেলায় দেখতাম হনুমান পাউরুটি, বিস্কুট, কেক এসব খেত না। প্রচুর ফলের গাছ ছিল, এরা মূলত ফলই খেত। ধীরে ধীরে গাছ কমে যাওয়ায় হনুমানদের খাদ্যাভ্যাস পাল্টে গেছে। পাউরুটি, কেক-বিস্কুট দিলে সেসব খাচ্ছে। হনুমান আগে ফসলের ক্ষেত থেকে খাবার সংগ্রহ করত না, এখন করছে।”
এর মধ্যে মহামারীর কারণে যখন লকডাউন শুরু হল, তখন মানুষের কেক-বিস্কুট দেওয়াও বন্ধ হয়ে গেল।
রফিকুল বলেন, “দোকানপাট তো তখন বন্ধ ছিল, মানুষের কাছ থেকে তারা খাবার পায়নি। এখন আবার খুলেছে, কিন্তু মানুষ আর আগের মত খাবার দিতে পারছে না।”
খাবারের অভাবে কেশবপুর থেকে বেশ কিছু হনুমান দল বেঁধে অন্য এলাকায় চলে গেছে বলেও জানালেন পৌর মেয়র রফিকুল।
বন বিভাগের প্রতিবেদনও বলছে, মহামারীকালে স্থানীয় অধিবাসীদের কর্মসংস্থানের অভাব, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ উৎপাদন হ্রাস পাওয়া, কেশবপুর/মহেশপুর পর্যটক শূন্য হয়ে যাওয়ায় হনুমানদের খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী হনুমান অন্যান্য এলাকায় চলে যাচ্ছে ও স্থানীয় অধিবাসীদের তারা খাবারের জন্য উত্যক্ত করছে।
বন বিভাগের কর্মকর্তাদের হিসাবে, এই হনুমানদের খাবারের জন্য বছরে দরকার ৭৬ লাখ টাকা। সেখানে সরকার এ অর্থবছরে দিয়েছে ১০ লাখ টাকা। এই অর্থ দিয়ে প্রতিদিনি ৩৬ কেজি কলা, ৫ কেজি চীনাবাদাম ও ৪ কেজি পাউরুটি দেওয়া হচ্ছে।
গত অর্থবছরে হনুমানদের জন্য দৈনিক বরাদ্দ ছিল ৩৫ কেজি কলা, ৪ কেজি বাদাম ও ৪ কেজি পাউরুটি। বন বিভাগের উদ্যোগে ঠিকাদারের মাধ্যমে কেশবপুরের সদর, বালিয়াডাঙ্গা, ব্রহ্মকাটি, রামচন্দ্রপুর, দূর্গাপুর ও মুজগুন্নি এলাকায় হনুমানদের এই খাবার দেওয়া হয়। তাতে হনুমানপ্রতি ভাগে পড়ে ৩৫ গ্রাম করে খাবার।
প্রতিবেদেন বলা হয়েছে, “বন বিভাগ থেকে যে খাবার সরবরাহ করা হয়, তা হনমুানের সংখ্যার তুলনায় খুবই সামান্য। ফলে খাদ্যের অভাবে হনুমানগুলো অন্যত্র চলে যাচ্ছে। বর্তমানে এরা সত্যিকার অর্থে খাদ্য ও নিরাপদ আশ্রয়ের অভাবে খুবই সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। হনুমানের খাবারের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করা বা নতুন প্রকল্প প্রণয়ন করা খুবই জরুরি।”
বন বিভাগ বলছে, গাছে কীটনাশক স্প্রে করায়, গাড়ি চাপা পড়ে এবং বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রায়ই হনুমান মারা যাচ্ছে। পাশাপাশি মানুষের নৃশংসতাও এদের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে।
২০১৫ সালে কেশবপুর অঞ্চলের হনুমানদের ওপর গবেষণা চালিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের গবেষকরা। সে সময় তারাও খাবারের বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং আবাবস্থল তৈরির জন্য প্রকল্প নেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন বলে জানালেন সেই গবেষকদের একজন অধ্যাপক ফিরোজ জামান।
“মনিটরিং এজন্য দরকার যে, ওদের সংখ্যা বাড়লেও সমস্যা, কমলেও সমস্যা। সেজন্য নিবিড় মনিটরিং দরকার। কমলে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। হয়ত সরকার আমাদের গবেষণার সুপারিশগুলো দেখেছে। সেজন্য এসব সুপারিশ হয়ত তারাও করেছে।”
অধ্যাপক ফিরোজ বলেন, “বাংলাদেশে মূলত কেশবপুর অঞ্চলেই এই হনুমানের কনসেনট্রেশন। অন্য জায়গায় মাঝে মাঝে যা দেখা যায় সেটা আসলে কোনোভাবে চলে গেছে। নেচারাল ডিস্ট্রিবিউশনটা ওখানেই। বহুদিন ধরে এরা এখানে অবস্থান করছে। সেটা কয়েকশ বছর ধরে।”
বন বিভাগের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, কেশবপুর এলাকা একসময় প্রচুর ফলদ ও বনজ গাছে পরিপূর্ণ ছিল এবং হনুমানের প্রজনন প্রক্রিয়া ও গর্ভকালীন নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল। বন-জঙ্গল হ্রাস পাওয়ায় এদের খাদ্য ও নিরাপদ আশ্রয়ের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে।
যশোর অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিম বলেন, “সব প্রাণীরই জীবনগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয়। এই এলাকায় থাকতে থাকতে তারা তাদের জীবন ধারা একরকম তৈরি করেছে। বাংলাদেশে এই এলাকাতেই এই প্রজাতিকে বেশি দেখা যায়। এরা ভূমিতে থাকা এডাপ্ট করেছে বলে এখনও টিকে আছে। না হলে এখান থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেত।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময় লাগে। কিন্তু প্রজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে দ্রুত এই প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরি।”