করোনাভাইরাস: বাদুড়কে যে কারণে দায়ী করা চলে না

নতুন করোনাভাইরাস হয়ত বাদুড় অথবা অন্য কোনো প্রাণী থেকেই মানুষের শরীরে এসেছে; কিন্তু সেজন্য কি সেই প্রাণী দায়ী? না মানুষই বারবার নিজের সীমানা পেরিয়ে অন্য প্রাণীর রাজ্যে হানা দিয়ে সংক্রমিত হচ্ছে, যার ফল হচ্ছে মহামারী? বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে সেই তত্ত্বের তালাশ নিয়েছেন বিবিসির পরিবেশ বিষয়ক প্রতিবেদক হেলেন ব্রিগস।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Oct 2020, 03:36 AM
Updated : 20 Oct 2020, 04:56 AM

***

জিম্বাবুয়ের মাবুয়া গুয়ানো গুহা স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে ‘পবিত্র স্থান’ হিসেবে বিবেচিত। গবেষণার কাজে যতবারই ওই গুহায় যেতে হয়, তার আগে প্রতিবারই ‘আত্মার সন্তুষ্টির জন্য’ উপঢৌকন নিয়ে গ্রামের বয়োজেষ্ঠদের কাছে অনুমতি চাইতে হয় ড. ম্যাথিউ বার্গারলকে।

অক্সিজেন মাস্ক, দীর্ঘ ওভারঅল, তিন স্তরের গ্লাভস পরে অন্ধকারের ভেতরে দড়ির মই বেয়ে গুহার ওই সরু পথে নামতে হয়।

গুহার সর্বত্র বাদুড়ের চেনা গন্ধ; মেঝেতে তাদের বিষ্ঠার স্তর পরে গেছে। ওর মধ্যে দিয়েই, যেন সদ্য জমা তুষার ঠেলে ঠেলে হাঁটতে হয়।

হঠাৎ কখনও চমকে ঘুম ভাঙে বাদুড়ের; ডানা ঝাপটে সে উড়াল দেয়।  

জিম্বাবুয়ের এই অংশে বাদুড়কে বলে ‘ডানাওয়ালা ড্রাগন’; কেউ বলে ‘উড়ুক্কু ইঁদুর’, নয়তো ‘শয়তান’।

ম্যাথিউ বার্গারল বলেন, বিশ্বের অন্য অনেক জায়গার মত জিম্বাবুয়েতেও উড়তে জানা এই স্তন্যপায়ীদের নিয়ে মানুষের ভুল ধারণা আছে। অথচ এরাও সুন্দর, দারুণ সব প্রাণী।

“ওরা তো রীতিমত মুগ্ধ হওয়ার মত। মানুষ আসলে সেই জিনিসকে ভয় পায়, যার সম্পর্কে সে জানে না।”

ফ্রেঞ্চ রিসার্চ ইনস্টিটিউট সিরাডের জন্য ভাইরাস তালাশ করে বেড়ান ড. ম্যাথিউ বার্গারল। ইউনিভার্সিটি অফ জিম্বাবুয়ের সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বাদুড়ের নমুনা ও মল সংগ্রহের জন্য তাকেও গুহায় যেতে হয়।  

এসব নমুনা ল্যাবে পৌঁছালে বিজ্ঞানীরা বাদুড়ের শরীরে থাকা ভাইরাসের জিন বিন্যাস বের করেন। এভাবে তারা কয়েক রকম করোনাভাইরাস খুঁজে পেয়েছেন, যার মধ্যে আছে সার্স এবং সার্স-সিওভি-২।

বাদুড় শরীরে যত ধরনের ভাইরাস বহন করে, সেগুলোর বিবর্তন ও জেনেটিক রূপ নিয়ে গবেষণা চলছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ম্যাথিউ বার্গারলদের গবেষণাও তারই অংশ।

ইউনিভার্সিটি অব জিম্বাবুয়ের ড. এলিজাবেথ গোরি বলেন, ফসলের ক্ষেতে সার হিসেবে ব্যবহারের জন্য স্থানীয়রা প্রায়ই ওই গুহায় যান বাদুড়ের বিষ্ঠা সংগ্রহ করতে। সে কারণে ওই গুহার বাদুড়ের শরীরে কোন কোন পরজীবী আছে তা জানাটা দরকার; কারণ বাদুড় থেকে তা মানুষের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে।

বাদুড় নিয়ে মানুষের মনে ভয় আর কুসংস্কার এই প্রাণীটির সংরক্ষণকে কঠিন করে তুলছে। সে কারণে বাদুড় বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে একটি প্রচার শুরু করেছেন। তারা বলছেন- ‘বাদুড়কে দোষ দেবেন না’।

তাদের মতে, পৃথিবীতে যে প্রাণীগুলোকে মানুষ সবচেয়ে বেশি ভুল বোঝে এবং অবমূল্যায়ন করে, তার একটি হল বাদুড়।

দীর্ঘদিন ধরেই অনেক সমাজে একটি কুসংস্কার চালু রয়েছে, তা হল বাদুড়ের ভেতর বাস করে ‘অপদেবতা’, আর তা মানুষের শরীরেও আছর করে। আর করোনাভাইরাসের এই মহামারীর মধ্যে বাদুড় নিয়ে কুসংস্কার আর ভুল ধারনাগুলো যেন আরও বদ্ধমূল হল।

বাদুরের জানা-অজানা

>> বাদুড় হচ্ছে একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যারা উড়তে পারে

>> যেসব বাদুড় পোকামাড়ক খায়, তারা প্রতি বছর ফসলের ক্ষতি কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষকদের ৩৭০ কোটি ডলার বাঁচিয়ে দিতে পারে

>> শত শত উদ্ভিদের পরাগায়ণ হয় বাদুড়ের মাধ্যমে

>> বসতি উজাড় হওয়া, জলবায়ু বদল ও শিকারের কারণে বাদুড় বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে

সূত্র: ব্যাট কনজারভেশন ইন্টারন্যাশনাল 

পুরা বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া নতুন করোনাভাইরাসের আসল উৎপত্তিস্থল কোথায় তা এখনও জানা যায়নি। তবে বিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ একমত হয়েছেন, এই ভাইরাস মানুষের শরীরে পৌঁছেছে কোনো প্রাণীর মাধ্যমে, আর খুব সম্ভবত সেটা বাদুড়।

তবে সেজন্য বাদুড়কে দোষ দিতে রাজি নন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বণ্য প্রাণীর আবাসস্থলে মানুষের আনাগোনা বাড়াই সমস্যার মূল কারণ।

মানুষ যেভাবে প্রকৃতি ধ্বংস করে চলেছে, তার সঙ্গে নতুন নতুন রোগের বিস্তার ঘটার যোগসূত্র রয়েছে। গরু চড়াতে, সয়া চাষ করতে, কিংবা রাস্তা বা স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের জন্য মানুষ যখনই বন ও তৃণভূমি দখল করছে, তখনই আসলে বন্যপ্রাণীদের বাধ্য করা হচ্ছে মানুষের বা মানুষের পালিত গবাদিপশুর কাছাকাছি আসতে; আর তাতে বন্যপ্রাণী থেকে মানুষের মাঝে ভাইরাস ছড়ানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

পর্তুগালের ইউনিভার্সিটি অফ পোর্তোর রিকার্ডো রোচা বলেন, অন্য অনেক প্রাণীর মত বাদুড়ও যে সম্ভাব্য অনেক রোগের পোষক, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

তবে বাদুড়ের ১৪শ প্রজাতির মত পাখি, গৃহপালিত প্রাণী ও ইঁদুর প্রজাতির প্রাণী থেকেও একই অনুপাতে মানুষের মাঝে ভাইরাস সংক্রমিত হচ্ছে।   

বিজ্ঞানীদের ধারণা, প্রতি চারটি নতুন সংক্রামক রোগের মধ্যে তিনটিই মানুষের মাঝে আসে অন্য কোনো প্রাণীর মাধ্যমে। 

বিপদের আভাস মিলেছিল ২০০২ সালেই, যখন চীনে ছড়িয়ে পড়ল সার্স ভাইরাস, বিশ্বে ৮০০ মানুষের মৃত্যু হল।

পরে ২০১৭ সালে গবেষকরা চীনের উনান রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক গুহায় হর্সশু বাদুড়ের একটি বসতি খুঁজে পান। সেসব বাদুড়ের দেহে যেসব ভাইরাস পাওয়া গিয়েছিল, তার মধ্যে সার্সের জন্য দায়ী ভাইরাসের কাছাকাছি জিন বিন্যাসের ভাইরাসও ছিল।

তখনই তারা সতর্ক করেছিলেন, এরকম আরও রোগ মানুষে মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাদের সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি প্রমাণিত হতে সময় নেয়নি বেশি।

তবে সেজন্য কোনো প্রাণী প্রজাতিকে দোষ না দিয়ে বরং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন করতে বলছেন ড. রোচা।

তার ভাষায়, একটি সুস্থ বাস্তুসংস্থান এবং মানুষের ভালোর জন্য বাদুড়ের ভূমিকা ‍গুরুত্বপূর্ণ।

ফসলের জন্য ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ সাবাড় করে বাদুড়। ক্রান্তীয় অঞ্চলে ডুরিয়ান ফলের মত অনেক গাছের পরাগায়নেও ভূমিকা রাখে। রেইন ফরেস্টের বৃক্ষের বীজ বাদুড় বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়; যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় জরুরি।

সুতরাং বাদুড়কে ‘অপদেবতা’ বানিয়ে দেওয়াটা ‘ভয়ঙ্কর বিপর্যয়’ ডেকে আনবে বলে মনে করেন ইউনিভার্সিটি অফ গ্লাসগোর ড. ডেভিড রবার্টসন। তিনিও বলছেন, প্রাণী থেকে মানুষের মাঝে রোগ ছড়াচ্ছে মানুষের কারণেই, কারণ তারা বার বার নিজেদের সীমানা ছাড়িয়ে প্রাণী রাজ্যে হানা দিচ্ছে।

সার্স-সিওভি-২ এর আদি রূপ হয়ত বাদুড়ের শরীরে আছে বহু বছর ধরেই, হয়ত আগে অন্য প্রাণীদেরও তা সংক্রামিত করেছে।

এর মধ্যে করোনাভাইরাসের বিস্তার শুরুর পর পেরু, ভারত, চীন ও ইন্দোনেশিয়ায় বাদুড়ের উপর চড়াও হওয়ার মত কিছু ঘটনা ঘটেছে। কোথাও কোথাও খুঁজে খুঁজে বাদুড় মারা হয়েছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের এ ধরনের ভুল পদক্ষেপ বিপন্ন বাদুড় প্রজাতির জন্য শোচনীয় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে; আর তাতে নতুন নতুন রোগ বিস্তারের ঝুঁকি আরও বাড়তেও পারে।

কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ডগলাস ম্যাকফারলেন বলেন, “সবচেয়ে শঙ্কার জায়গাটা হল, অনেক বাদুড় প্রজাতিই রয়েছে অস্তিত্বের সঙ্কটে। কাজেই এ ধরনের খুব ছোটখাটো ভুলও বাস্তু ব্যবস্থার অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হতে পারে, যে বাস্তু কাঠামোর ওপর মানুষকেও নির্ভর করতে হয়।”

শত শত বছর ধরে মানুষ আর বাদুড় পাশাপাশি আছে, আর তাতে পরস্পরের ভালোই হয়েছে।

পর্তুগালের বিশ্ববিদ্যালয় শহর কোইমব্রাতে ১৮ শতকের একটি লাইব্রেরিতে প্রায় তিনশ বছর ধরে বাদুড়ের বসবাস। বাদুড় ওই পাঠাগারের পোড়ামাকড় খেয়ে না ফেললে সেগুলো হয়ত লাইব্রেরির বই নষ্ট করত। সন্ধ্যার দিকে সেখানে গেলে দেখা যায় পাঠাগারের জানালা গলে বেরিয়ে আসছে বাদুড়ের ঝাঁক। 

রিকার্ডো রোচা বলছেন, বাস্তু ব্যবস্থাকে সুস্থ রাখার জন্য প্রকৃতির যে জটিল জাল, বাদুড় যে তারই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, সে কথা মানুষকে মনে রাখতে হবে।

তিনি বলেন, “ইতিহাসের এই দুর্ভাগ্যজনক সময় থেকে আমাদের যদি কোনো শিক্ষা নিতে হয়, সেটা হবে- প্রকৃতিকে অসুস্থ করে তোলা মানে নিজেদের জন্যই অসুস্থতা ডেকে আনা।”